আমাদের পুনর্মিলন উৎসব, ২০১৪
যতদূর মনে পড়ে, সার্কাসের তাঁবু থেকেই শুরু। আসলে, খেলা দেখাচ্ছিল জাদুকর। টুপি থেকে খরগোশ, রুমাল থেকে ফুল বের করে আনছিল। হাততালির যেন ঝড় বইছিল অ্যারেনায়। সার্কাসের আলোয় মুখ দেখা যায়, চেনা যায় না। আমি ফার্স্ট রোয়ে বসে জাদুকরকে দেখছিলাম, ম্যানড্রেক টুপি, কালো রোবে লাল সোনালী তারার ডিজাইন। হঠাৎই জাদুকর তার জাদুদন্ড নাচিয়ে বলল- কী চাও? ঠিক এই মুহূর্তে কী চাও?
আমি বলেছিলাম-আমার অর্ধেক জীবন আবার দেখতে চাই। সে টুপিওলা মাথা নেড়ে বলল, চোখ বুজে হাত বাড়াও সামনের দিকে। টান করে হাত বাড়ালাম, চোখ বন্ধ করায় সার্কাসের বাজনা যেন আরো উদ্দাম হয়ে কানে আসছিল। চোখ খুলে দেখি লাল নীল আলো জ্বলছে তাঁবু জুড়ে আর আমার হাতের তেলোর ওপর যেন একটি স্বচ্ছ নীল ডিম। তার মধ্যে আমার অর্ধেক জীবন। শৈশব, কৈশোর, প্রথম যৌবন গুটিয়ে এইটুকুনি হয়ে হলুদ কুসুমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে।
ডিম হাতে নিয়ে বসে রইলাম সার্কাসের তাঁবুর বাইরের একটা চেয়ারে, গুটিশুটি মেরে। বাঘ সিংহের আবছা গর্জন শুনছিলাম। সার্কাসের জামায় হেঁটে যাচ্ছিল লোকজন। বেলুন হাতে বাচ্চারা। গায়ে পশমের জামা, মাথায় টুপি কানঢাকা।এমন সময়, আমার পাশে এসে বসল ম্যানড্রেক টুপি, আলখাল্লা। জাদুকর। হাতের তেলোয় রাখা ডিমটা লাট্টুর মত ঘুরিয়ে দিয়ে বলল-কার্নিভাল শুরু হো-ও-ও-ও-ক।
দেখলাম বাগান জুড়ে আজ বড় বড় ডালিয়া ফুটে আছে। বাজির আলো হুউস করে আকাশে উঠে কখনও সিংহের কেশর হয়ে যাচ্ছে, কখনও বাগানের ডালিয়া। এরকম আকাশ আমি দেখি নি আগে। সেই আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মিস মামেন। হাতে বটুয়া। আর আমি পা ছুঁয়ে প্রণাম করছি। আমার মাথায় হাত রাখছেন, খুব ভারি হাত। বলছেন, এখন প্রণাম করছ কেন রে? রেজাল্ট দেওয়া হবে এখনই।দেখলাম, মা ও এসেছে।প্রেয়ারহলের যে ডায়াস, তার পাশে যে দরজা, তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মিস মামেন বলছেন-ক্লাস থ্রী বি, ফার্স্ট ...। ক্লাসরুমে আমার হাতে রেজাল্ট তুলে দিচ্ছেন অমিতাদি-সবুজ কাগজ-সবেতে এ লেখা। এ মানে অ্যাবসেন্ট।আমার তো হাম হয়েছিল।রেজাল্ট দেওয়া হলে অমিতাদি কিশলয় খুলছেন,বলছেন, শোনো, এটা কিন্তু সিলেবাসে নেই- এই বলে পড়ছেন,
'..হয় নি মিছে এই কথাটি বলা
একলা বসে লিখছি তোমায় চিঠি
কাজের শেষে কাজল কালো রতে
যদিও তুমি পড়তে শেখো নি কো
বুঝবে না কি আমার মনের কথা-
তাড়াতাড়ি জবাব কিন্তু লিখো-
কাগজ ভরে খানিক আঁকিবুকি
অর্থছাড়া বানানহারা ভাষা
কালিতে আর ভালোবাসায় মাখা-...'
কেউ বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বলে গেল- বাইরে এসো, ফানুসে আগুন দেওয়া হচ্ছে এ এ এ...
আমিও দৌড়োলাম।
জামরুল গাছের তলায় তুবড়িতে আগুন দেওয়া হবে -সেইখানে ভীড়। তুবড়িতে আগুন দেবার পরে প্রদীপগুলি জ্বলবে, মোমবাতিও।দেখলাম তুবড়িতে আগুন দেওয়ার জন্য হাতের ফুলঝুরি জ্বালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। প্রথমে একটি, তারপর অনেকগুলো। দীর্ঘদেহী, কাঁধ অবধি লম্বা চুল, পরনে জোব্বা-আমার দিকে পিঠ তাই মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। ফুলঝুরি জ্বালিয়ে , এক এক করে বাচ্চাদের হাতে দিচ্ছিলেন। তারপর সবাইকে নিয়ে এগোলেন তুবড়ির দিকে । তুবড়িতে ফুলঝুরি ছোঁয়াতেই সোনালী, নীল আলোর ফুলে গুচ্ছ আকাশ ছুঁলো , সেই সঙ্গে জ্বলে উঠলো সমস্ত প্রদীপ। হাতের মোমবাতিগুলি সেই আগুনে জ্বেলে নিচ্ছিল সবাই -বৃত্তাকারে সেই দীর্ঘদেহী মানুষটিকে ঘিরে গাইছিল-'যাবৎ সাক্ষাৎ না হয় পুনরায়/ ঈশ্বর রক্ষা করুন তোমায়/ তৃপ্ত রাখুন দৈনিক মান্নায়/ঈশ্বর থাকুন তোমারই সহায়।'
আমার হাতে তেলোয় আমার অর্ধেক জীবন লাট্টুর মত ঘুরছিল, ঘুরেই যাচ্ছিল।আর , সেই মুহূর্তে, ৩০ , যশোর রোডের আলোকময় প্রাঙ্গণে এক অনন্ত কার্নিভাল সংঘটিত হচ্ছিল।
Comments
Post a Comment