কূজনহীন কাননভূমি


আমি জন্মেছি কলকাতায় - পড়াশোনা , বড় হওয়া, প্রথম যৌবন। এখন থাকি যেখানে, কলকাতা থেকে  দূরত্ব দশ হাজার কিলোমিটার। স্কাইলাইন, গাছপালা, পথঘাট, হাটবাজার -সব অন্যরকম।  শুধু একটা ক্রেন -একটা উঁচু ক্রেন-দিনের বেলায় দেখি নি কখনও- রাত হলেই আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া একলা উঁচু ক্রেন চোখে পড়ে-কলকাতার রাতের আকাশেও সে আছে। বোধ হয় ছিল বরাবর - আর তখনই কাচের গোলক হাত থেকে পড়ে চৌচির  হয়।আসলে একটা ভঙ্গুর গোলক নিয়ে সমস্তদিন তো কেউ লোফালুফি খেলে - ডান হাত থেকে বাঁ হাত, বাঁ থেকে ডান - খুব সাবধানে খেলে সারাদিন - হয়তো সারাজীবন-মাটিতে পড়তে না পায়  -পড়ে গেলেই ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবে, অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসবে যাব জমাট বাঁধা কুয়াশা , মেঘ, জলকণা -ঘিরে নেবে চারদিক- এই আকাশ, এই গাছপালা,  এই সব  রাস্তাঘাট-অনন্ত কুয়াশায়  তখন একলা আমি, সামনে অতল খাদ।

এই সব সময়ে জলের কাছে যেতে  হয়। কথা বলতে। এলোমেলো অগোছালো কথা। এই যাপন, এই পরবাস। এই জল, এই মাটি, এই মানুষ-



জল-মাটি-মানুষ


বসতখানি  জনপদে।  আকাশ ছুঁয়ে যায় সেন্ট্রাল পয়েন্ট টাওয়ার। অপেরা হাউজ, হারবার ব্রিজে সাজানো আমার স্কাই লাইন। ঝকঝকে পথঘাট, সাইডওয়াক। সবুজ ছাতার তলায় কফি খাওয়া চলে। সিটি রেল ব্রিজ পেরোচ্ছে, নিচে খাঁড়িতে শান্ত জলে  একঝাঁক বোট। শপিং মলে ম্যানিকুইন। ছুটির দিনে টরঙ্গা জু, ডার্লিং হারবার, মোনোরেল। গ্রীষ্মসন্ধ্যায় খোলা ঘাসজমিতে জ্যাজ ফেস্টিভ্যাল। হাইড পার্কের ফোয়ারা। ব্যস্ত মানুষজন। চেনা মানুষ। চেনা শহর। চেনা আখ্যান। অচেনার সঙ্গে সাক্ষৎহীন যাপন।

পুরোনো বইটি হাতে ঠেকেছিল লাইব্রেরিতে। সাদামাটা মলাটে বৃদ্ধ মানুষ, না কামানো গোঁফ দাড়ি, ইস্ত্রিবিহীন জামা। কনসারটিনা হাতে। মলিন ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে ধূসর ল্যান্ডস্কেপ। বইটির নাম লম্বা  এবং জটিল। জন মেরেডিথের ফোক সং অফ অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড দা মেন অ্যান্ড উইমেন হু স্যাং দেম।

' বইতে  নাগরিকের  অজানা পরিবেশ, অচেনা মানুষ, অপ্রচলিত বাদ্যযন্ত্রগুলি। হারমনিকা, ফিডল, টিন হুইশল, বাটন অ্যাকরডিয়ানের সঙ্গে ব্রুম হ্যান্ডেল আর বটল টপ দিয়ে লগারফোন। কেরোসিন টিন ডালসিমার। জনপদে এভাবে দেখা হবে জানতাম না তো-

জ্যাক লাসকোম্ব যেমন- ভেড়ার লোম ছাঁটতেন - পঞ্চাশের দশকে তিনি আশি ছুঁই ছুঁই। জনের সঙ্গে তাঁর কথা রেকর্ড করা, এই বইটিতে তার ট্র্যান্সক্রিপশন। অন্যরকম ইংরেজি। -নাগরিক।

জ্যাকের একটি গান ওয়েস্টার্ন ভিক্টোরিয়ায় এখনও গাওয়া হয় -- দা ম্যান অন দা ফ্লাইং ট্রাপিজের সুরে --

You take off the belly-wool,

Clean out the crutch,

Go up the neck -

For the rules they are such.

You clean round the horns,

First shoulder go down,

One blow up the back

And you then turn around.'

এরপর কোরাসে --

'Click, click,

That's how the shears go,

Click, click,

So awfully quick.

You pull out a sheep,

He'll give a kick,

And still hear your shears going

Click, click-click.'

বাল্যাবধি ভিন্ন ভিন্ন শেডে ঘুরে ঘুরে গানগুলি শেখা। কার বাঁধা, কার সুর -- জ্যাক জানেন না সবসময়।

কিংবা ইনা পপলওয়াল। পুরোনো ছোট্ট ব্রিক কটেজ, একটি স্টকিং দিয়ে গেটটি বাঁধা। কেরোসিনের কুপি জ্বলে। পাওয়ারের অভাবে রেকর্ড করা যায় না। জন অতি যত্নে লিখে আনেন সেইসব গান -- কোনওটির উপজীব্য এক অপরাধী, কোনওটিতে প্রেমিকের আহ্বান, কোনওটি বা আইরিশ ব্যালাডের অনুকরণ অথবা "বটানি বে' --

'Farewell to old England for ever ...

Singing tooral-i-ooral-iaddiday,

Singing tooral-i-ooral-i-ay ...'

জ্যাক লি, এডউইন গডউইন, আর্থার বুকনান, জো ক্যাশমেয়র, ফ্রেড হল্যান্ড, বিলি কফলিন ।।। মুখে মুখে ফেরে গানগুলি। বুশ ব্যালাডস।

অসংখ্য গান। অনেক কথা। স্বরলিপির সুর কখনও চেনা, কখনও অচেনা। গানের কথায় এসেছে বুড়ো ঘোড়া, রেললাইন, পাড়ার মেয়েটি, ডোল অফিস, জঙ্গল, মানুষ, জল ...

দেখে ফেলি  অ্যানা রিভসের সিনেমা অয়েস্টার ফারমার। সিডনি শহর থেকে ঘন্টাখানেকের ড্রাইভে হক্সবেরি নদী। মাম্বল আর ছেলে ব্রাউনি সেখানে আটপুরুষের অয়েস্টার ফারমার। সিডনি ফিশ মার্কেট লুঠ করে জ্যাক, বোনের চিকিৎসার জন্য। সেই টাকা মেইল করে দেয় হক্সবেরির ঠিকানায়, ব্রাউনির অয়েস্টার ফার্মে কাজ নেয়। টাকার প্যাকেটটির অপেক্ষায় থাকে। ক্রমশ তার অস্থিরতা, সন্দেহ বাড়ে। ওদিকে ব্রাউনির দাম্পত্য অস্বচ্ছলতায় টলমল।

আমরা দেখি নদীতীরে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, হাসপাতালের নির্জন জেটি, পোস্ট অফিস, অয়েস্টার চাষের খুঁটিনাটি। উল্কি, ছেঁড়া ফাটা পোশাক, অক্ষৌরিত মুখগুলি, দুর্বোধ্য অ্যাকসেন্ট।

সাঁকোর ওপর মিলিত হয় জ্যাক আর পার্ল। নদী আর কুকুরটি সাক্ষী থাকে। মাম্বল বানিয়ে চলে একখানি বাথটব -- অজস্র মার্বেল আর সেই লুণ্ঠিত ডলার দিয়ে সাজায় পুত্রবধূর জন্য। অয়েস্টার চাষে ব্রাউনি প্রথম পুরস্কার পায়, বৌকে বাথটবটি উপহার দেয়। সহস্র চোখের মতো চেয়ে থাকে মার্বেলগুলি।

জ্যাক চাকরি ছেড়ে শহরে চলে যেতে চায় কিন্তু শেষ অবধি ফিরে আসে। মাথার ওপর রাতের আকাশ, সেই বাথটবে শুয়ে থাকে জ্যাক আর পার্ল।


এইভাবেই হঠা কখনও দেখা হয়ে যায় চারণে আর নাগরিকে, অয়েস্টার ফারমার আর শহুরে মানুষে। বইয়ের পাতায় কিংবা সিনেমায়। চেনা শহরের ভেতর তখন উঁকি দিয়ে যায় অন্য শহর।

রেডফার্ন স্টেশনের কাছে চোখে পড়ে  অন্যরকম মুখ, ক্যাফের এককোণে পোষা কুকুর নিয়ে বসে থাকেন মলিনবেশ বৃদ্ধ। জল জঙ্গলের ঘ্রাণ আসে তখন। নদীটি বেশি দূর নয়। 



জোড়াতালির নকশিকাঁথা


পাড়ার কমিউনিটি নোটিশবোর্ড। পিয়ানো শিক্ষক চাই ... অভিজ্ঞ বেবি সিটারের জন্য এই নম্বরে যোগাযোগ করুন ... যোগ শিখতে আসুন কিংবা ক্যারাটে ... মেদ কমাতে চান? ... আগামী পরশু গ্যারাজ সেল  ...  কুকুরছানা হারিয়ে গেছে ... একখানি কুইনসাইজ খাট জলের দরে বিক্রি হবে ...  তারই মধ্যে চোখে পড়ে একফালি সবুজ কাগজ  - ফ্রম মাদার্স টু ডটার্স অ্যান একজিবিশন অফ প্যাচওয়ার্ক কুইল্টস। ভেন্যু নর্থ সিডনি হেরিটেজ সেন্টার, আমাদের পাড়ার স্ট্যান্টন লাইব্রেরির দোতলায়।

অস্ট্রেলিয়ায় কলোনি পত্তনের গোড়ার দিকেই কুইল্ট আসে। এলিজাবেথ ফ্রাই কয়েদী সংশোধনাগারে কাজ করতেন। জাহাজে করে মহিলা কয়েদীরা যখন অস্ট্রেলিয়ায় আসছেন, এলিজাবেথ তাঁদের হাতে তুলে দিলেন প্যাচওয়ার্কের টুকরো, সূঁচ-সুতো। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তৈরি হতে লাগল প্যাচওয়ার্ক কুইল্ট। নকশা করা ছোট ছোট কাপড়ের ফালি সাজিয়ে প্রথম স্তর। তার তলায় ইনসুলেশন আর ব্যাকিং। একসঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে সূঁচ সুতোয় -- তৈরি হয়ে যাচ্ছে প্যাচওয়ার্ক কুইল্ট।

নয়খানি সিল্কের ফালি, 'রকম রঙ, জুড়ে জুড়ে গড়ে ওঠা হীরকাকৃতি টুকরোগুলি পরপর সেলাই করা। এইভাবেই প্রথম স্তর। কিংবা "ইংলিশ পেপার টেম্পলেট পদ্ধতিতে হেক্সাগোনাল প্যাচ -- দুশো বছর আগে যা বিলেতে তুমুল জনপ্রিয় ছিল; মোটা কাগজ বা কার্ড ব্যবহার করে হেক্সাগোনাল প্যাচটি তৈরি করা, তারপরে কাগজটি সরিয়ে নেওয়া। কখনও হয়তো ভুল হয়েছে, কাগজ সরিয়ে নেওয়া হয়নি, কুইল্ট ততদিনে ঠাকুমা থেকে নাতনীর ঘরে, কাগজটি অটুট তখনও। অথবা লগ কেবিন কুইল্ট। চৌকোনা প্যাচওয়ার্কটি ব্লকটি মাঝখানে। তাকে ঘিরে লম্বাটে ফালিগুলি -- কখনও ডায়মন্ড, কখনও ক্রস, কখনও হার্ট, গাঢ় বা হাল্কা শেড মেলানো মেশানো। একটি লগ কেবিন কুইল্ট দেখেছিলাম ১৮৮৭ নাগাদ তৈরি -- মধ্যিখানে তিনটি রিবন, একটিতে ক্রাউন, পরেরটিতে রানি ভিক্টোরিয়া, তার পরেরটিতে ভিক্টোরিয়ার জুবিলি সন ১৮৮৭। রিবন তিনটিকে ঘিরে রোজ, শ্যামরক, থিসল আর লিক-ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওয়েলসের প্রতীক। মহারানির মহার্ঘ্য বালাপোষ। আর ওয়াগ্গা কুইল্ট। অনভিজাত, খেটে খাওয়া মানুষের দিনযাপন। অস্ট্রেলিয়ার ওয়াগ্গা ওয়াগ্গার একটি ময়দার মিলের বস্তা ব্যবহার করা হত কুইল্টগুলির ব্যাকিং মেটেরিয়াল হিসেবে। সেই থেকে এই নাম। দর্জির দোকান অথবা সেলসম্যানের ফেলে দেওয়া স্যাম্পল বুক থেকে নেওয়া হত কাপড়ের টুকরো। প্যাচওয়ার্কের জন্য। আর পুরোনো ছেঁড়া মোজা, সোয়েটার ভরে দেওয়া হত ইন্সুলেশনের জন্য।

আঠেরোশো ছেচল্লিশ সালের একখানি কুইল্ট - সেলাই করেছিলে এক পুরুষ। নাবিক  তিনি - হামেশাই জাহাজের বিশাল বিশাল পালে রিফুকর্ম করতে হত। সেই দক্ষতাই কাজে এসেছে এক্ষেত্রে। পেপার টেম্পলেট ঘরানার সিল্কের এই কুইল্টটির চারপাশে সাদা লেস। বড় যত্নে বসানো।

কুইল্টের ভিড়ে ব্যতিক্রম ছিল একটি ড্রেসিংগাউন। ইটালি থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসে একটি মেয়ে, জুমা কারও। হাইস্কুলে পড়ার সময় সে নিমন্ত্রিত হত বন্ধুদের বাড়ি, রাতে থাকত সেখানে। বড়লোক বন্ধুরা সব। সিল্কের রাতপোশাক, ড্রেসিংগাউন। জুমার সাধ হোত। সাধ্য ছিল না। একদিন সে নিজেই বানিয়ে নিল নিজের ড্রেসিংগাউন। পুরোনো কাপড় কেটে। প্যাচওয়ার্কের কাজ সারা গায়ে।

ক্রেজি কুইল্ট ঘরানায় প্যাচগুলি ইচ্ছেমতো সাজানো। প্যাটার্নহীন। আপাত। তবু একটা নকশা কোথাও থেকেই যায়। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী আর শরণার্থীদের তৈরি কুইল্টের মোটিফে গোড়ার দিকে এসেছে তাঁদের ফেলে আসা দেশ, বাড়ি, ঘর, প্রকৃতি ... শ্যামরক, থিসল, লম্বা ডাঁটি সাদা লিলি- ক্রমে তা বদলে গেছে অস্ট্রেলিয়ান মোটিফে ।।। ক্যাঙারু, কোয়ালা, সাদার্ন ক্রস, নক্ষত্রপুঞ্জ ...

তো, ব্যাপার সেই একই দাঁড়ায়।

সাগরপারে রানিমা বালাপোষ মুড়ি দিয়ে 'উব্বুত' তো  ওদিকে বরিশাল থেকে গোয়ালন্দ হয়ে বনগাঁ সীমান্তে ট্রেন থামছে। মোটিফ বদলে যাচ্ছে ছুটির দুপুরে জানলার খড়খড়ি বেয়ে ঘরে ঢোকে মায়াবী আলো, সাদা দেওয়ালে কালচে ডোরা আড়াআড়ি, নারকেল গাছের সিল্যুয়েট। আবার বদলাচ্ছে মোটিফ- ব্লাইন্ডের আড়াআড়ি ডোরা, সিল্যুয়েটটি মেপল ট্রির। মোটিফ বদলে যায় আবার। খাঁড়ির শান্ত জলে ঝাঁক বাঁধা বোটগুলি। মোটিফ বদলায় আবার ... রাতে আকাশে তারা ফোটে একটি দুটি -- সেই আকাশে হেলান দেয় নিঃসঙ্গ ক্রেন। ব্রিজ কাঁপিয়ে ট্রেন চলে যায় কোথায় ... মোটিফ বদলে যেতেই থাকে প্রবাসীর জোড়াতালির নকশিকাঁথায়।




স্মারক অথবা


একটা সময় পোস্টারে ছয়লাপ পাড়া। ল্যাম্পপোস্টে সাঁটা, উঁচু দেওয়ালে টাঙানো অথবা ফুটপাথে ইষ হেলিয়ে দাঁড় করানো চড়া হলুদের ওপর কালো মোটা হরফে লেখা পোস্টার -- সেভ আওয়ার অ্যানজ্যাক হেরিটেজ বা সেভ গ্রেথওয়েট অথবা  স্টপ  সেলিং আওয়ার অ্যানজ্যাক হেরিটেজ - এইসব।

লেখার সঙ্গে কোথাও একটি ম্যাপ বা পুরোনো বিশাল বাড়ির ছবি, কোথাও বা একটি অতি প্রাচীন সিপিয়া রঙের গ্রুপ ছবি-সৈনিকের বেশে, নার্সের পোশাকে নারী, পুরুষ-পরিচ্ছদ, কেশবিন্যাস সবই বেশ প্রাচীনকালের অন্তত একশো বছরের পুরোনো তো বটেই।

' পুরতে আর সামান্যই বাকি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু। অস্ট্রেলিয়া একটি ফেডের্যাল কমনওয়েলথ সেই সময় - বয়স বছর পনেরো। নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার সেনা মিলে তৈরি হল অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড আর্মি কর্পোরেশন বা অ্যানজ্যাক - মিত্রশক্তির নৌবাহিনীর অবাধ প্রবেশের জন্য অ্যানজ্যাক আক্রমণ করল গ্যালিপলি পেনিনসুলা। উনিশশো পনেরোয়। প্রায় আট হাজার অস্ট্রেলিয়ান সেনা নিহত আর আহতের সংখ্যা অগণন।

সেই সময় নর্থ সিডনি অঞ্চলের জনৈক স্যার থমাস ডিবস নিউ সাউথ ওয়েলসকে দান করলেন তাঁর বিশাল ভিক্টোরিয়ান ম্যানসন 'গ্রেথোয়েট', আহত অ্যানজ্যাক সেনাদের শুশ্রুষার জন্য। উনিশশো ষোলো থেকে উনিশশো আশি রেডক্রস ব্যবহার করে গ্রেথওয়েটকে। আশি থেকে স্বাস্থ্য দফতর দায়িত্ব নেয় এই বাড়ির একটি নার্সিং হোম চালু করে।

এখন এই বিশাল বাড়ি, সংলগ্ন বাগান ব্যবহারের অযোগ্য সর্বতোভাবে স্বাস্থ্যদফতর চাইছে গ্রেথওয়েট বিক্রি করে দিতে, চাইছে ম্যানসনটি ভেঙে গড়ে উঠুক একটি কারপার্ক, কিছু টাউনহাউস। এর আগেও, চুরানব্বই নাগাদ, সরকার একই প্রস্তাব এনেছিল কিন্তু জনমত ছিল এবারের মতোই অর্থা প্রস্তাবের বিপক্ষে। সেই সময় ইলেকশনের মুখে তাই বিক্রির প্রস্তাবে ধামাচাপা পড়ে। এখন আবার উদ্যোগী হয়েছে গভর্নমেন্ট। তবে, এই সময়, শুধু প্রতিবাদ নয়, নর্থ সিডনি কাউন্সিল এবারে সরকারের থেকে বাড়িটি কিনতে চেয়েছে - রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাউন্সিলের। একটি হেরিটেজ পার্ক গড়ে তুলবে কাউন্সিল, ম্যানসনটি অটুট রেখে। হলদে কালো পোস্টারগুলির পশ্চাৎপট এইটুকুই।

এক বিকেলে স্যান্ডস্টোনের এই ভিক্টোরিয়ান ম্যানসনটির সামনে এসে দাঁড়ালাম। পোস্টারের ম্যাপ দেখে পৌঁছে গেছি। প্যাসিফিক হাইওয়ের মতো অতি ব্যস্ত রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ অথচ নাগরিক কোলাহল ফেলে আসছি রাস্তার মুখের পাবটিতে। প্রাচীন বাড়ি, প্রাচীন দুয়ার, অজস্র পাখি ডাকছে - কুলায় ফেরা পাখি সব, সূর্য অস্তগামী। হাল্কা হিমভাব।

প্রবল অযত্নের চিহ্ন সর্বত্র। আগাছা, ঝোপ-ঝাড়, কুকুরের বর্জ্য, বিয়ারের ক্যান, প্লাস্টিক ইতস্তত - ভারী ট্রাকের টায়ারের দাগ ঘাসে। দুটি অতি প্রাচীন ডুমুর গাছ। তিনতলা প্রাসাদোপম বাড়িটির জীর্ণ,  অতি জীর্ণ দশা। প্রাচীন উদ্যানটিতে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল একটি ঘটনা।

এই যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণ নিয়ে ভারী গন্ডগোলে পড়ি একবার। সেদিন বাড়িতেই ছিলাম। একাই। দুপুরের দিকে জানলা দিয়ে হঠা দেখি অ্যাম্বুলেন্স, দমকল, পুলিশের গাড়ি - কার কি হল ভাবতে ভাবতেই দরজায় করাঘাত। সিনেমায় যেমন দেখি তেমনই সপ্রতিভ ভঙ্গিতে আইডেন্টিটি কার্ড দেখান তরুণ পুলিশ অফিসার -'যে অবস্থায় আছেন, সেই অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে আসুন, নীচের স্টোরেজে গুটিকয়েক গ্রেনেড পাওয়া গেছে।' অগত্যা পাসপোর্ট আর ল্যাপটপটি হাতে, চটি পরেই সটান বাইরে। জানা গেল, আমারই ওপরতলার বাসিন্দার কিছু জিনিসপত্র রাখা ছিল স্টোরেজে - বৃদ্ধ মারা গেছেন বহু বছর, বৃদ্ধাও অসুস্থ নার্সিংহোমে। তাঁদের পুত্রটি এসে স্টোরেজ পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্রেনেডগুলি দেখে ৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেয়। অফিসার নাম-ধাম খাতায় লিখে কাছের থানায় কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, থানায় কফি খেলে কত - এরকম কোনও কাল্পনিক মানসাঙ্ক কষে অকুস্থলেই দাঁড়িয়ে থাকি আমি। অতঃপর বম্ব স্কোয়াড আসে। জানা যায়, এই গ্রেনেড বিশ্বযুদ্ধের সময়ের - বৃদ্ধ ছিলেন সৈনিক, তিনি নাকি গ্রেনেডগুলি স্মারক হিসাবে তুলে রেখেছিলেন সযত্নে। পুলিশের মত সেরকমই। সত্যি কথা সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ স্বর্গে গেছেন বহুদিন, বৃদ্ধাও অসুস্থ। অতএব ...

এই জীর্ণ ম্যানসন, প্রাচীন বৃক্ষদ্বয়, সিপিয়া রং-এর গ্রুপ ছবিটি, গ্রেনেডসমূহ যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণের একটি কোলাজ হতে পারত। আদ্যন্ত। অথচ, সেদিন, শেষ বিকেলে, সেই ডুমুর গাছের তলায় কোলাজের এই ফ্রেমটিতে ঢুকে পড়ে আরও একজন। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ফর্সা। চোখা, সাহেবি গড়ন - হারবার্ট। হারবার্ট সরকার।

মুহূর্তে, প্রাচীন গাছটি শমীবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আয়ুধসকল অপেক্ষায় থাকে।



পিনহোল ক্যামেরা


মেয়েটি ছবি আঁকে। ছবি তোলেও। এটুকু জানা ছিল। ক্লেয়র কনরয়। আমার পড়শি। দেখা হয় লন্ড্রিতে। সিঁড়িতে। দেখা হয়। কথা হয় কম। মেয়েটি স্বল্পবাক। আমি মুখচোরা প্রবল। একটু হাসি-কুশল বিনিময় -- আজ গরম বেজায় ।।। বিকেলে বৃষ্টি নামবে ।।। এই ফিরলেন বুঝি?

গত শীতের সকালে মস্ত এক ট্রাক এল বাড়ির দোরগোড়ায়। চারদিক বন্ধ বিশাল রেন্টাল ট্রাক। বাড়ি বদলালে লোকজন যেরকম ট্রাক ভাড়া করে সেরকম। ক্লেয়র সেই ট্রাক নিয়ে বেরোয় প্রায়ই। ছবি তুলতে যায়। কোনওদিন সঙ্গীসহ। কখনও একা। গ্রীষ্মে ওর একজিবিশন। এত বড় ট্রাকে কি এত সরঞ্জাম নেয় -- জিগ্যেস করতে ভুলে যাই।

শীত চলে যায়। বসন্তও। ক্লেয়র আমাকে কার্ড দেয় ওর একজিবিশনের -- "লাইট স্পিড -- জার্নি অ্যাক্রস সিডনি ইন পিনহোল ক্যামেরা।'

আসে শনিবারের দুপুর। ডে স্ট্রিটে মোরি গ্যালারি। সাদামাটা ব্যবস্থাপনা। দেওয়ালে ফ্রেমহীন ছবিগুলি। আট ফুট বাই তিন ফুট মোটামুটি। সাদা-কালো। প্রতিটি ছবির সঙ্গে সাউন্ডট্র্যাক। এম পি থ্রিতে। ছবি তোলার এক্সপোজারের সমান সময় সাউন্ড ট্র্যাকেরও।

ছবিগুলি সিডনি শহরের। বা শহর থেকে সামান্য দূরের। যেমন, কুড়ি মিনিট এক্সপোজারের এম টু ট্রান্স -- আরবান টোলগেটের ছবি -- সাউন্ডট্র্যাকে ট্যাক্সি স্টার্ট নিচ্ছে, খুচরো পয়সার আওয়াজ উঠছে টোলগেটে বা পনেরো মিনিট এক্সপোজারের কন্সট্যান্স ক্লোজ ছবিটি -- একটি পরিত্যক্ত কারখানা -- সাউন্ড ট্র্যাকে গেট খোলা-বন্ধ, মেশিনের আওয়াজ গা ছমছমে -- এইরকম, গোরে পয়েন্ট অয়েল টারমিনাল, বেরি আইল্যান্ড রিজার্ভ, লাইটহর্স এক্সচেঞ্জ, সিনক্লেয়ার মোটোরস ... আদ্যন্ত নাগরিক ছবি। চূড়ান্ত ব্যস্ত, ক্লান্ত, নির্জন। বন্ধ গেট, পরিত্যক্ত কারখানা, কাঁটা তারের বেড়া, বজ্রগর্ভ মেঘরাজি ফিরে ফিরে আসে ছবিগুলিতে। নেপিয়ান নদীর ছবিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে উদাসীন ক্লেয়র-বেরি আইল্যান্ড রিজারভেও একটি শূন্য বোট বাঁধা থাকে পাড়ের কাছে -তিনটি বোট উল্টে রাখা ঘাসজমিতে -আবছা জঙ্গল-বিজনতরুমূলে জল ছলছলিয়ে উঠছে ...


গ্যালারির এককোণে ক্লেয়রের পরিকল্পনার ভিডিও বিবরণঃ ক্লেয়র অঙ্ক কষছে - পিনহোলের মাপজোক, এক্সপোজার টাইমের হিসেবনিকেশ। ট্রাক ভাড়া করছে। তারপর ট্রাকটিতে ঢুকে শাটার বন্ধ করছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেতরে। সে টর্চ জ্বালায়। ড্রিল করে তৈরি করে সুগোল ছিদ্র। বাকি ফুটোফাটা ব্ল্যাকটেপ দিয়ে ঢাকে ...অর্থা? অর্থা ট্রাকখানি- আদতে পিনহোল ক্যামেরা! সকালে-সন্ধ্যায় কতবার ট্রাকটি বাড়ির দোরগোড়ায় - কল্পনাও করিনি তার পিনহোলনয়নের।


গ্যালারি থেকে বেরিয়ে ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। ব্যস্ত শহর একলা ঝলসাচ্ছে। ক্রসিংয়ে সিগনাল সবুজ। কালো, সাদা, লাল, রুপোলি গাড়ি, মোটরবাইক, বিরাট ট্রাক ...  বাসা বদলায় কেউ। আর, তার লটবহরের সঙ্গে, বন্ধ শাটারের সুগোল রন্ধ্র বেয়ে কখন ঢুকে পড়ে ফেলে আসা শহর। ট্রাকের ভিতর। কাঁটাতারের বেড়া ... বন্ধ কারখানা ... একলা তরীখান ... এক্সপোজার বদলে বদলে যায়। শাটার পড়ে। নির্মাণ চলে। পড়শির পিনহোল ক্যামেরায়।



আইকম বাইকম গপ্পগাড়ি


রোববারের সকালটি ঈষ অন্যরকম যেন। যদু মাস্টাররা আজ শ্বশুরবাড়ি যাবেন না। ছেলেপিলের হাত ধরে সোজা এসেছেন সিডনি সেন্ট্রালট্রাল স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে স্টিমে টানা পুরোনো ইঞ্জিন, সঙ্গে ছোট ছোট আটখানি বগি। সেন্ট্রাল থেকে স্ট্র্যাথফিল্ড, লিডকোম্ব, ব্যাঙ্কসটাউন, সিডেনহ্যামের বৃত্তপথে আবার সেন্ট্রালে ফিরে আসা। বসন্তের বই সপ্তায় চিল্ড্রেন্স বুক কাউন্সিল অফ অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগ এই স্টোরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস। গপ্পগাড়ি।


প্ল্যাটফর্মে কাউন্সিলের স্টল। যদু মাস্টারের পকেট কিছু খালি হল শুরুতেই। বাচ্চাদের হাতে এল এক ব্যাগ বই, ব্যাজ, পেন্সিল কেস, বেলুন, এটা সেটা। প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়ায় বই-এর পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র সব। ব্যাগি গ্রিন ইউনিফর্মে গল্পগাড়ির কর্মীদের হাসিমুখ। উষ্ণ অভ্যর্থনা। অল অ্যাবোর্ড। সিগনাল সবুজ। গপ্পের চাকা নড়ে উঠল।


ছোট ছোট পুরোনো বগি। আনাচে কানাচে ভিড় করে আছে গপ্পরা। অবয়বহীন আপাতত। অন্দরসজ্জায় মনে হয় এই বুঝি গোঁফ চুমরে বেরিয়ে এলেন এরকুল পোয়ারো। না, এরকুল নন, কামরায় ঘুরে বেড়ায় উইচ, ডরোথি, অ্যালিস, কাকতাড়ুয়া। অথবা স্টোরিটেলারের ব্যাজ এঁটে স্বেচ্ছা-গল্পবলিয়ে। বাচ্চার ঘিরে ধরেছে তাদের। একধারে টেবিলে রাখা বই। বিস্তর। বিক্রির জন্য। এক এক করে কামরায় আসছেন এখানকার শিশু কিশোর সাহিত্যের বিখ্যাত সব লেখক আর ইলাসট্রেটর। পামেলা ফ্রিডম্যান, অ্যালান বেইলি, সুজান জার্ভে, দেভ অ্যাবেলা, জুলি ভাইভাস, ক্রিস চেং। অকাতরে অটোগ্রাফ বিলোন। গল্প বলেন। নিজের লেখা পড়ে শোনান। প্রশ্নের উত্তর দেন। কু ঝিক ঝিক গল্পগাড়ি স্ট্র্যাথফিল্ড পেরোয়।


একটি কামরায় দেখা হয়ে যায় সুজান জার্ভের সঙ্গে। হাসিমুখ, একমাথা এলোমেলো সোনালি চুল। জমিয়ে গল্প করেন। কিশোর সাহিত্যে সুজানের বেস্ট সেলার "আই অ্যাম জ্যাক' এবং সিকোয়েল "সুপারজ্যাক' আর "বাটারফ্লাই' "আই অ্যাম জ্যাক' পড়তে পড়তে মনে হতেই পারে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির কথা। সুজান নিজেই বললেন, "আই অ্যাম জ্যাক অ্যান্ড সুপারজ্যাক আর ইনস্পায়ার্ড বাই মাই ওয়ান্ডারফুল ক্রেজি ফ্যামিলি।'


"বাটারফ্লাই' আবার সম্পূর্ণ বিপরীত -- নিতান্ত শৈশবে দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া একটি মেয়ের বয়ঃসন্ধিকালীন একাকিত্ব এবং তা অতিক্রম করে যাওয়া। অনেক গল্প করলেন সুজান। লেখার কথা বললেন বারেবারে। বাচ্চাদের বললেন লিখে যেতে, শুধু লিখে যেতে - "জাস্ট লেট ইয়োরসেল্ফ গো'


এরপর, -কামরা থেকে সে-কামরা। বই কেনা। লেখকের মুখোমুখি হওয়া। কুইজের উত্তর দেওয়া। গপ্পের চাকা সিডেনহ্যাম তক। পথ ফুরোচ্ছে দ্রুত। যাবত কোকের ক্যান আর কমিক্সে ডুবে থাকা সহযাত্রী কিশোরের হাতে উঠে আসছে "বাটারফ্লাই' কিশোরীর আকুল জিজ্ঞাসা "লিখতে চাই, লিখতে চাই, কেমন করে লিখব?' এই সব।


লেখক-পাঠক কথোপকথনে ছেলেপুলের তুলনায় বাবা-মাদের ৎসাহই বেশি যদিও। তবু, হয়তো এইভাবেই, একদিন দেখা হয়ে যাবে জামাল ওয়ালেস আর উইলিয়াম ফরেস্টারে গল্পগাড়ির কামরায়। দাগা বুলোতে বুলোতে নিজস্ব লেখাটি লিখে ফেলবে নবীন কিশোর। স্বেচ্ছানির্বাসন ভেঙে বেরিয়ে আসবেন অভিমানী লেখক। উত্তরাধিকার বাহিত হবে। হয়তো।


হয়তো, সেই বিশ্বাসেই, যাত্রা শেষের সামান্য আগে, কামরার আনাচ-কানাচে লুকিয়ে থাকা গপ্পের একটি সামনে আসে। হঠাৎ। একটি লিফলেট। জানা গেল, এই স্টিম ইঞ্জিন, এই কামরা সব যাবত থ্রি ওয়ান জিরো এইট লিমিটেড কোম্পানি দেখাশোনা করে এসেছে। হেরিটেজ ট্রেন ট্রিপ চালু রেখেছে আজ কুড়ি বছর -- সিডনি থেকে সেনট্রাল কোস্ট বা সাদার্ন হাইল্যান্ড-জর্জেস রিভারের পাশ দিয়ে, আঁধারময় ওটফোর্ড টানেলের ভেতর দিয়ে উলংগং-এর পাহাড় আর সমুদ্রে। আর মাত্রই তিন মাস। তারপর বন্ধ হয়ে যাবে থ্রি এইট জিরো ওয়ান লিমিটেড। স্টিম ইঞ্জিনটি চলে যাবে নিউ সাউথ ওয়েল্স ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়ামে। কামরাগুলি নিয়ে নেবে নিউ সাউথ ওয়েলস রেলকর্প-ব্যাকপ্যাকাররা থাকবে এসে। বিশিষ্ট লেখককুল, পাঠকবৃন্দ যদি নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ারকে অনুরোধ করেন, তবে যাত্রা গপ্পটির পরিণতি বিয়োগান্ত হয় না। লিফলেটের বক্তব্য এইটুকুই।


লক্ষণ তেমন নয় যদিও। সেনট্রালে কোঁচা সামলে নেমে যাচ্ছেন যদু মাস্টার। জামাল আর ফরেস্টার ঠিকানা বিনিময় করছেন। ঝোলাব্যাগের দুরূহ কোণে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে লিফলেট,  দুয়েকটি হাত ফস্কে হাওয়ায় লাট খাচ্ছে অথবা ঝকঝকে নতুন বইয়ের পেজমার্ক হিসেবে উঁকি দিচ্ছে। প্ল্যটফর্ম ফাঁকা হচ্ছে ক্রমশ।


তাহলে? থ্রি এইট জিরো ওয়ানের কর্মীদের ভবিষ্য? প্রিমিয়ারমশাইকে লিখে কাজ হবে? আদৌ লিখবেন কেউ? যদু মাস্টার সামান্য অন্যমনস্ক এই মুহূর্তে। পকেটের কলমটি সুড়সুড়ি  দেয়।

গল্পগাড়ি তার বাঁশি বাজায় - টুউউট, টুউউট। স্টিম মিশে যায় রবিবারের বাতাসে। মুচকি হেসে পষ্ট বলে যায় - ' অমাবস্যা। ঘোড়ার ডিম।'



অকালবোধন


দেখা হওয়ার সময় হয় নি এখন। কথা ছিল না কোনই। তবু দেখা 'ল। হঠাৎ। এই সময়।

যখন নীলকন্ঠ পাখিটি ওড়ে নি-শিউলি ফোটে নি-কাশের গোছা দুলছে না কোত্থাও-পদ্মটি নাই- পদ্মটি নাই -

অস্ট্রেলিয়ান সামার তুঙ্গে,পারা ছুঁয়ে যাচ্ছে চল্লিশ প্রায়-বুশফায়ারে ঝলসাচ্ছে ভিক্টোরিয়া-ঘাম জবজবে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন - অথচ তিনি এলেন।সিডনিতে।শুধুই সিডনিতে।


প্রস্তুতি ছিল। পরিকল্পনামাফিক দু'হাজার ছয়ের অক্টোবরের মাঝামাঝি শুরু হয়েছিল প্রদর্শনী-'গডেস-ডিভাইন এনার্জি' নিউ সাউথ ওয়েলস আর্ট গ্যালারিতে।ভারত, তিব্বত আর নেপালের ' দেড়েক ছবি আর ভাস্কর্য্য। কোনটি বৃটিশ মিউজিয়ম, কোনটি সানফ্রানসিস্কো,কোনটি বা ভারতের সংগ্রহশালা থেকে এসেছে এই প্রদর্শনীতে। দশটি কক্ষে সাজানো ছবি আর ভাস্কর্য্য-ভিন্ন শিরোনামে-'আর্লি গডেস', 'রাধা', 'দেবী', কালী', 'পার্বতী', 'তারা','কালী', 'তন্ত্র', 'বুদ্ধিস্ট গডেস' এবং 'বজ্রযান'

প্রদর্শনীর পাশাপাশি, নাচের আসর-ওড়িশি, ভরতনাট্যম। সেমিনার, ওয়ার্কশপ।আর সিনেমা।থীম-'গডেস'

এই থীমসরণি বেয়েই তাঁর আবির্ভাবের সূচনা দু'হাজার সাতের - জানুয়ারি-'দুর্গা-ক্রিয়েটিং গডেস'

মূর্তি গড়তে কৃষ্ণনগর থেকে এসেছেন নিমাইচন্দ্র পাল মশাই তাঁর আরো দুই সঙ্গীকে নিয়ে।মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছেন ঢাকী ছয়জনা। আর ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রাফট্স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে উপস্থিত শ্রীমতী রুবি পালচৌধুরী।

একচালা ট্র্যাডিশনাল প্রতিমার মিনিয়েচার ভারশানটি রাখা থাকে একপাশে আর মূল প্রতিমার খড়ের কাঠামো বাঁধা হয়, মাটি পড়ে তাতে,একমেটে, দো'মেটে... ক্রমে আদল গড়ে ওঠে..লাল রঙের গণেশটি... সবুজ অসুর...আর বাদামী সিংহমশাইএর পিঠে চড়ে কি অপরূপ রূপে বাহির 'লে জননী-

নির্মাণের জাদুতে বিদেশী দর্শককুল হতবাক।

সবিস্ময়ে আর্ট গ্যালারি অপেক্ষায় থাকে ২৬ তারিখের। গ্র্যান্ড ফিনালে। পুজো আর বিসর্জন।


২৬শে অস্ট্রেলিয়া ডের ছুটি।আর্ট গ্যালারি উপচে পড়ে মানুষে-ধুতি, শাড়ী,জীন্স, ট্রাকস্যুট, শর্টস-কে আসে নি একচালাটির সামনে? ষোড়শোপচারে পুজো। ধূপ, ধুনো, ফুলমালা, মঙ্গলারতি, অঞ্জলি-

ঢাকের বাদ্যির তালে শরীর দোলায় বাঙালী আর বিদেশী , মাথা নামিয়ে শান্তিজল নেয়, হাত 'রে প্রসাদ।বিসর্জনের সময় হয়ে আসে।


আর্ট গ্যালারির সামনে নিয়ে আসা হয় প্রতিমা -ট্রাকে করে। ঢাকের তালে শুরু হয়ে যায় বিসর্জনের নাচ-রাস্তার উল্টোদিকের ঈষ উঁচু ঘাসজমিতে আমরা ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াই।

এই যে অসময়ের পুজো অথচ না-পুজো, এই যে খেলা খেলা বিসর্জন-ঢাকের বোলে মনে আসে না সে'কথা। প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া হাত জোড় করছেন, রুমালে চোখ মুছছেন।আর এই যে আমরা-চোখে চালশে, চুলে পাক-অবশ্যম্ভাবী মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের ছোটবেলা, আমাদের প্রথম যৌবন, মৃত প্রিয়জনসকল-ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা দেখাচ্ছে। হয়তো রোদ, হয়তো ধুনুচির ধোঁয়া, হয়তো প্রবাসীর ন্যাকামি কেবল-


আর্ট গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি-ভুবনমনোমোহিনী-ডাকের সাজে,ঢাকের বোলে, ধুনোর গন্ধে।রাস্তার 'পারে দাঁড়িয়ে আমরা। মুঠিতে পরের প্রজন্মের হাতখানা।

পাশে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ। বিদেশী।শুধোন-'আর ইউ হিন্ডু?'

'ইয়েস আই অ্যাম।' অ্যাম আই? অ্যাম আই?

হিন্দুধর্ম-ছাতার তলায় ছাতা-বড় ছাতা, মেজ ছাতা, ছোটো ছাতা-কেমন করে কোন ছাতার তলায় ঢুকে যাচ্ছি আমাহেন ব্যক্তি-এই সব দার্শনিক কচকচি শুরু হয়ে যায়। অর্থহীন ঠেকে নিজের কানেই।

মাঝের রাস্তাটুকু জুড়ে বিসর্জনের উদ্দাম নাচ চলছে তখন-সেখানে অস্ট্রেলিয়া ডের প্যারেড ফেরত ভীড় করছে মানুষ, হাতে অস্ট্রেলিয়ান ফ্ল্যাগ-বাঙালী, চীনা, বৃটিশ, অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান-সাদা, কালো, বাদামী, পীতবর্ণ-মিলেমিশে যাচ্ছে সব-মানুষ, মানুষ, মানুষ শুধু-

আমরা রাস্তায় নেমে আসছি।আলগা হচ্ছে মুঠো। হারিয়ে ফেলছি-খুঁজে পাচ্ছি-হারাচ্ছি আবার-

ঢাকের বোল ঘা দিচ্ছে বুকে.... ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন-ভুবনগ্রাম ভুবনগ্রাম ভুবনগ্রাম...



বসন্তের উত্তর


শীতের শুরুটা এরকমই। শিরশিরে হাওয়া। পাতা ঝরতে থাকে। শুকনো মরা পাতা। বাদামি, হলদে। হাওয়ায় পাকসাট খায়, তারপর মাটি ছোঁয়। কম্যুনিটি নোটিসবোর্ডে গাঁথা কাগজগুলি হাওয়ায় ওড়ে। লম্বাটে, চৌকোনা, আয়তাকার, লাল, গোলাপি, সবুজ কাগজ। আয়তাকার কাগজখানিতে চোখ যায়। তিব্বতী শ্রমণদের অনুষ্ঠান ঞ্ছমন্ডলাঞ্চ -- নর্থ সিডনি কাউন্সিলের একটি সভাগৃহে। পাঁচদিনের অনুষ্ঠানের প্রথম দিনই উপস্থিত হই। যেতে বেলা হয়ে যায়। ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে "মন্ডলা' নির্মাণ। সুবিশাল সভাগৃহের মাঝখানে বর্গাকার বিশাল একটি নকশার হালকা আভাস, তিনজন ভিক্ষু আসনপিঁড়ি, পাশে পিতলের বেশ কয়েকটি শঙ্কু রাখা, ভিন্ন রঙের সূক্ষ্ম মসৃণ প্রস্তরচূর্ণ ভরা শঙ্কুগুলি ...

তিব্বতী বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী "মন্ডলা' স্বপ্নসম্ভব, অলীক আদর্শ জগ সকল জীবের ঠাঁই সেথায় এবং ধ্যানে কেবল ধ্যানেই উপলব্ধি করা যায় 'মন্ডলা' প্রাচিন পুঁথিপত্র মেনে অতি যত্নে তৈরি হয় 'মন্ডলা' দেখলাম, শ্রমণত্রয় আসনপিঁড়ি অবস্থায় সামনে ঝুঁকে ছোট ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষ ঘর্ষণ করছে, সেই মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দিচ্ছে নকশার ছোট ছোট অংশগুলি -- লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ... এইভাবেই ধীরে ধীরে "মন্ডলা' নির্মাণ। তারপর এই অসাধারণ আলপনাটি এক নিমেষে পরিষ্কার করে ফেলা হবে -- অনিত্য জীবন বোঝাতে। ভাসিয়ে দেওয়া হবে নদীতে। নদী বহন করবে ওই প্রস্তরচূর্ণ, বালি -- সকল প্রাণীর কাছে বয়ে নিয়ে যাবে শুশ্রুষা, শান্তি, সম্প্রীতি -- ওঁদের বিশ্বাস তাই।


শীতের শুরুতে "মন্ডলা' নির্মাণশেষে ভিক্ষুরা যখন নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন আলপনার অবশেষ, সেই সময়ে শোনা গিয়েছিল "সেক্রেড ফুটস্টেপস ফ্রম দ্য রুফ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' - অস্ট্রেলিয়ায় এসে পৌঁছেছিলেন দলাই লামা, জন হাওয়ার্ড টালবাহানা করছিলেন শীতের এই বিশিষ্ট অতিথির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে, হাওয়ার্ডকে চাপে রাখতে রোজ হুমকি দিচ্ছিল চিন, চিনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মুক্ত বাণিজ্যের ভবিষ্য নিয়ে চিন্তিত হচ্ছিলেন সবাই, আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঠিক এই কারণে দলাই লামার বেলজিয়াম সফর বাতিল হওয়ার কথা। অবশেষে চিনের হুমকি উড়িয়ে দিয়ে হাওয়ার্ড দেখা করেছিলেন শীতের অতিথির সঙ্গে। দশদিনের সফর নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টায় নেমেছিলেন হাওয়ার্ড। ততদিনে অলীক ভুবনের অবশেষটুকু ভাসিয়ে নিয়েছিল নদীটি।


এই সময় পেঙ্গুইনটি এসেছিল। শীতের আর এক অতিথি। এসেছিল আড়াই হাজার কিলোমিটার সাঁতার কেটে। কোস্টাল নিউজিল্যান্ড থেকে। খাবারের খোঁজে বেরিয়ে, সিল আর হাঙরের হাত থেকে বাঁচতে দলছুট হয়ে। অর্ধমৃত অবস্থায় পৌঁছেছিল অস্ট্রেলিয়ার সে¾ট্রাল কোস্টে। অত্যন্ত দুষপ্রাপ্য প্রজাতির পেঙ্গুইনটি -- ফিওর্ডল্যান্ড ক্রেস্টেড। তার এই দুঃসাহসিক সমুদ্রযাত্রার পরই জানা গিয়েছিল আর মাত্র ২০০০টি পেঙ্গুইন আছে এই প্রজাতির। টরঙ্গা জুতে আশ্রয় হয় তার - নাম হয় মিস্টার মুনরো, নিউজিল্যান্ডের তার বাসস্থান মুনরো বিচের নামে। জু' বিশেষজ্ঞরা চাইছিলেন এখানে একটি মিলন ঘটুক, নতুন প্রাণ আসুক। টরঙ্গা জুতে আমি যখন তাকে দেখতে যাই, সে তখন অনেকটাই সুস্থ; ছোট ছোট ফেয়ারি পেঙ্গুইনদের কর্যকলাপ ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছিল কিঞ্চি অবজ্ঞাভরে। কমলা ঠোঁটটি তার, চোখের ওপর দিয়ে হলদে পালকের বাহার। শেষ বিকেলের সূর্যের আলোর পড়েছিল তার ওপর। সেই ছবি তুলতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছিলাম ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ।


ফুরনো ব্যাটারি, ভিজে ঠান্ডা হাওয়া, সেনট্রালকোস্টের সাইক্লোন, খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে প্রিজনভ্যানে মুখ গুঁজে বসে থাকা মানুষটি - আমাদের শীতকাল এইভাবেই কেটে যেতে থাকে। ফুরিয়েও আসে এক সময়। মরা ডালে পাতার অঙ্কুর দেখি। খবর আসে - মিস্টার মুনরোর মিলন ঘটেছে সেই ছোট ছোট পেঙ্গুইনদের দুই মহিলা চকি আর মিলফোর্ডের সঙ্গে। ডিম ফুটবে শিগগিরি। এই বসন্তেই।


...শ্রমণত্রয় আসনপিঁড়ি অবস্থায় সামনে ঝুঁকে, ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষ ঘর্ষণ করবেন, সেই মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দেবে নকশার ছোট ছোট অংশগুলি - লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ... এবং নদীটি বয়ে চলবে।



নেমসেক


বছর কয়েক আগে আমার হাতে নেমসেকের যে কপি এসেছিল তার হাল্কা রঙের মলাটে আড়াআড়ি একটি বৃক্ষশাখা দেখেছিলাম। বাসাবদলের কালে বইটি হারাই। সে সময় নেমসেক রিলিজ করেছে - টিকিট কাটার আগে আবার পড়ে নিতে গিয়ে দেখি মলাটের কেন্দ্রে আলম্ব চৌখুপিতে ইরফানের কাঁধে টাবুর নত ললাট। পাশের খোপে বিহ্বল কাল পেন। বাঁদিকের কোণে তাজমহল। সিনেমার বিভিন্ন স্টিলের কোলাজ আর কি। চৌকোনা। লালে-হলদে আর নীলে। গ্লসি। মলাট বদলে গিয়েছে। বেমালুম।


চ্যাটসউডের মাল্টিপ্লেক্সে ম্যাটিনি শো। আমি ছাড়া ভারতীয় আর জনা দুই, দুটি চিনা তরুণী, বাকিরা শ্বেতাঙ্গ। ছবি শুরুর আগে হলের আলো আঁধারিতে চোখ সইয়ে বই-এর পাতা উল্টে যাচ্ছিলাম। আমার ঠিক পরের সারির একাকী প্রৌঢ়া আলাপ জুড়লেন .. কি বই  ... ঝুম্পা ... পুলিৎজার ...কলকাতা ...কতদিন দেশছাড়া ... অস্ট্রেলিয়ায় কদ্দিন? আলো নিভে গিয়ে ছবি শুরু হয়ে গিয়েছিল।


ভালো লাগছিল না প্রথমটায়। ইরফানের  ঈষ ফোলা চোখের কোল, বাংলা উচ্চারণে কেমন একটা টান, পাত্রপক্ষের সামনে আসার আগে টাবুর  শাড়ি বদলাতে গিয়ে শরীর দেখানো মিলছিল না মনে পড়ছিল-  'And so, obediently but without expectation, she had untangled and rebraided her hair ... patted some cuticura powder from a velvet puff onto her skin''

মিস করছিলাম  ডিটেইলস - 'She saw the size, eight and a half, and the initials U.S.A ... Ashima, unable to resist a sudden and overwhelming urge, stepped into the shoes at her feet. Lingering sweat from the owner's feet mingled with hers, causing her heart to race ... on the left shoe she had noticed that one of the crisscrossing laces had missed a hole, and this oversight set her at ease.'

হোঁচট খাচ্ছিলাম এয়ারপোর্টে মালা গলায় নবদম্পতিকে দেখে, আমেরিকার অ্যাপার্টমেন্টে শাড়ি পাজামায় মিলনদৃশ্যে। মিস করছিলাম  অসীমার বাবার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে পেন্টব্রাশ আর সোয়েটার ট্রেনের কামরায় রেখে আসা। মিস করছিলাম  ছোট্ট গোগোলের সেমেট্রিতে ফিল্ডট্রিপ   'The children begin to scamper between rows of the dead, over leathery leaves, looking for their own names, a handful triumphant when they are able to claim a grave they are related to ... Gogol is old enough to know that there is no Ganguli here. He is old enough to know ... that no stone in this country will bear his name beyond life.'


গোগোল হিসেবে কাল পেনকে অসম্ভব মানিয়েছিল। সামান্য জড়তা মাখানো ঈষ টেনে বলা ইংরেজিতে, "লিটিল' উচ্চারণে, শান্ত চাহনি, ক্লান্ত পদক্ষেপে টাবু আর ইর্ফান ক্রমশঃ অসীমা আর অশোক হয়ে উঠছিলেন- ভালো লাগছিল। কষ্ট হচ্ছিল।

 ক্রিসমাস কার্ড লেখার দৃশ্যটি যখন এলো, মীরা নায়ার বইটি হুবহু অনুসরণ করলেন। অসীমার টেলিফোনে যখন অশোকের চলে যাওয়ার খবর এল, সমস্ত হলে পিনড্রপ সাইলেন্স। শুধু আমার পিছনের সারির প্রৌঢ়া ককিয়ে উঠেই চুপ করে গেলেন।


একসময় আলো জ্বলে উঠেছিল। শেষ হয়ে গিয়েছিল  ছবি। প্রৌঢ়া এগিয়ে এসে বলেছিলেন -- "ওয়ান্ডারফুল!' আমি বলেছিলাম, "কেন এত ভাল লাগল ? '  ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন প্রৌঢ়া -- "আই ক্যান ফিল দ্যাট টু, আই ক্যান ফিল দ্যাট। আয়াম অলসো অ্যান ইমিগ্র্যান্ট।'  প্রৌঢ়ার পিঠে হাত রেখেছিলাম।

হলের বাইরে তখনও বিকেল। তুমুল রোদ। কালো চশমায় চোখ ঢেকে  হাঁটতে থাকি। আমি। সেই একাকী প্রৌঢ়া। চিনা তরুণীদ্বয়। ভিড়ে মিশে যাচ্ছিলাম আমরা। আমরা সবাই।


 Will you remember this day, Gogol? ...

... How long do I have to remember it? ...

... Try to remember it always ... Remember that you and I made this journey, that we went together to a place where there was nowhere left to go.'

ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাথরে, ঢেউ ভেঙে ফেণা, জলকণা। ভঙ্গুর গোলকটি চূর্ণ বিচূর্ণ এই সময়। তখন অনন্ত কুয়াশায় পাকদন্ডীতে  দাঁড়িয়ে আমি সামনে  খাদ।  যার নাম পরবাস। 

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস