প্রবাসীর বর্ণমালা

সে হাঁটে। ওভারকোট, ভারী জুতো, মোটা দস্তানা। হাত জড়িয়ে খুকীটি। স্নোসুটে, রামধনু উলের গলাবন্ধে।পায়ের নীচে বরফ। তুষারাবৃত নিষ্পত্র বৃক্ষশাখা। আকাশের রঙে ছাই ওড়ে যেন।
সে হাঁটে, সঙ্গে খুকীটি। খুকীর হুডটিতে আলতো হাত রাখে সে-কি ভাবিস খুকী? কি ভাবিস?
-Poem, mummy. A poem. Just came to my mind.
************
ই-মেইল ১
মা,
অভ্যস্ত হয়ে উঠছি আবার দৈনন্দিন ব্যস্ততায়। বরফে। মেইল করা হয় নি ক'দিন। ভালো আছ তো?
খুকী ভালো। আজ পদ্য বাঁধলো মুখে মুখে। তবে ইংরিজিতে।
'Skating on the snow/ on a pair of broken skis/The snow is turning red/ I think , am nearly dead.'
সকালের মুডটা ভালো ফুটেছে, বলো? বাংলায় কি ও আরো ভালো এক্সপ্রেস করতে পারতো নিজেকে? জানি না, আমি খুব বেশি জোর করছি কি না এব্যাপারে! বাংলা এখন আর বলতেই চায় না।
পরে লিখছি আবার। এখন ইউনিভার্সিটির তাড়া।

ই-মেইল ২
অরিত্র,
অনেকদিন মেইল করা হয় নি তোকে।কলকাতা থেকে ফিরেছি অনেকদিন।তারপর আবার মানিয়ে নেওয়া রুটিনে, ব্যস্ততাও গেল নানাভাবে। খুকীকে নিয়েও একটু ঝামেলা গেল কদিন। সেরকম কিছু না। আসলে এখন একদম বাংলা বলতে চায় না। সমস্তদিন ডে কেয়ারে কাটায়, সমস্তদিন ইংরিজি। বন্ধুদের সঙ্গে, টিচারের সঙ্গে-ইংরিজি।বাড়ি ফিরেও তাই। কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে বাংলায় কথা বলতে বললাম কদিন। উল্টো বিপত্তি হল। কথা বলতে গেলেই তোতলামি। ওদের স্কুলের টিচারের সঙ্গে কথা বললাম।ভদ্রমহিলা স্ট্রিক্টলি বারণ করলেন।ঘরে বাইরে দুরকম ভাষা নিয়ে কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে নাকি!আর তাতেই তোতলাচ্ছে। আর একটু বড় হওয়া অবধি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বললেন। তাই আর জোর করছি না। এখানে আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। অনেকেই বললেন,'কি দরকার বাংলা শেখার?'
কি উত্তর দেব, বল্‌? কোনও উত্তর হয়?
মেইল করিস। আমিও করব।


**************
সে হাঁটে। বালিকাটি পা মেলায় তার সঙ্গে। বিকেলের এলোমেলো হাওয়া। বেগুণী জ্যাকারান্ডা বদলে দিচ্ছে আকাশের রং। ফুল ঝরছে। বেগুণী আস্তর পায়ের তলায় বিছানো।
সে বলে, খুকী, একটা গান আছে জানিস? তুমি যে গিয়াছ বকুল-বিছানো পথে। জানিস?
বালিকা মুখ তুলে চায়-'I like to write something. A prose.'
সে জিগ্যেস করে-'ভেবেছিস কিছু?'
বালিকাটি হাসে- 'It's all about a purple carpet. Somebody spreads a carpet all over. A carpet. A purple carpet.’
খুকী, তোর বাংলায় লিখতে ইচ্ছে করে না? বাংলা পড়তে? বাংলা বলতে? বাংলায় ভাববি না কোনদিন?

ই-মেইল ৩

মা,
কাল সুপ্রিয়ামাসিরা এসেছিল হঠাৎ। একটা খুব ইন্টারেস্টিং বই দিল, জানো?
পড়তে পড়তে মনে হ'ল-বোধ হয় পথ পেয়ে গেছি আমি। একদম অন্যধরনের কনসেপ্ট, বাংলা শেখানোর। প্রবাসের প্রতিটি অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে। ক-এ কেক, ক্রিসমাস, , ব-এ বরফ, স-এ স্যান্টা!
পরে লিখছি আবার।

ইমেইল ৪

অরিত্র,
কেমন আছিস? সেই যে বইটার কথা বললাম তোকে সেদিন, আজ লিখি একটু তার কথা?

ক্যানাডা ওন্টারিও মিনিস্ট্রি অফ সিটিজেনশিপ অ্যান্ড কালচারের ফান্ডিংএ একটা বাংলা স্কুল চালু হয়েছিল , সেই প্রজেক্টের জন্যই এই বইটি লেখা। বাংলা শেখার বই। নাম-'সহজ বই'।
মুখবন্ধে কয়েকটা দারুণ তথ্য পেলাম।এই যে সকলে বলেন, ছোটোবেলায় এভাবে আর একটা ভাষা শেখার একটা নেগেটিভ এফেক্ট আছে, সম্পূর্ণ কাউন্টার করা হয়েছে মুখবন্ধে। ক্যানাডায় কিছু কেস স্টাডি উল্লেখ করা আছে । মϾট্রয়লে প্রায় ৩০০ ইটালিয়ান ছাত্রকে নিয়ে করা একটি স্টাডি, এডমন্টনে উক্রেনিয়ান-ইংলিশ বাই ল্যাঙ্গুএজ প্রোগ্রামের স্টাডি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, 'language retention...should lead to higher academic adjustment, better facility in the host language, and better social relations of immigrant children.'
দারুণ না?
বাংলা শেখানোর ধরণটাও একদম আলাদা। পরে বিশদ লিখব। এখন মুখবন্ধের বক্তব্যটুকু শোন্‌, তাহলেই ধারণা করে নিতে পারবি।
'The author has tried to relate learning of the language with the familiar environmental exposure of the child as far as possible.Folk tales and rhymes in English have been rendered into Bengali, with a low vocabulary, in order to hold the interest of the child who would find his everyday experience in the outside world enjoyable to share in the language spoken at home...The whole process is geared to building a common and continuous pattern of experience for the child, instead of leaving a dichotomy between his home and the world.'
পথ পেয়েছি রে।
পরে আবার।

ইমেইল ৫

... বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের একজিকিউটিভ কমিটির সকল সদস্যকে নমস্কার প্রথমেই।


 দেশ ছেড়েছি প্রায় আট বছর। এদেশেই হয়ে গেল প্রায় বছর চার। এই মুহূর্তে বছর নয়েকের কন্যাটি আমার।
তাকে মাতৃভাষা শেখাতে গিয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আর মতামত আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। সংক্ষেপেই সারবো।
যে কোনো ভাষা শিখতে গেলে ভালোবেসে শিখতে হবে, জোরাজুরির প্রশ্নই নেই কোনো। এজন্য চমস্কি বা রবি ঠাকুরকে উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই। আপনারা সকলেই মানবেন এ'কথা আশা করি। এখন এই প্রবাসে এই ভালবাসাটুকু কোথা থেকে আসবে? আসতে পারে নানাভাবে-ধরুন দেশে দাদু দিদা মাসি পিসিকে ভালোবেসে যাদের সঙ্গে মাতৃভাষাই যোগাযোগের সর্বোত্তম পন্থা, গুপি বাঘা কে ভালোবেসে , গান ভালোবেসে .. এইরকম। তো, এই ভালোবাসাটা চারিয়ে দিতে হবে। শুধু অ, আ, ক, খ শেখানো নয় তার সঙ্গে বাংলা গান , সিনেমা, গল্প -র সঙ্গেও পরিচিত করা...আর হ'ল 'পীয়র প্রেশার'। সেটাই বা কি করে সম্ভব? আমার মনে হয়েছে যে যদি একটি বাংলা স্কুল খোলা যায় যেখানে সমবয়সী বাচ্চারা বাংলা শিখবে, গান শুনবে, গল্প , কবিতা শুনবে, সিনেমা দেখবে-কেমন হয়?

আমি সামান্য মানুষ। একক প্রচেষ্টায় রবিবারের সকালে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেই খুব ছোটো আকারে শুরু করেছিলাম আমার কন্যা, তার দু তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।বাঙালী সকলেই বলাই বাহুল্য। কোনো টাকাপয়সা নেই নি কারোর থেকেই। দেশ থেকে আনিয়ে নিয়েছিলাম হাসিখুশি, শিশু, তুতুভুতু, কিছু ডিভিডি। কিন্তু আমার পেশাগত ব্যস্ততা এবং বেতনহীন স্কুলে অভিভাবকদের কমিটমেন্টের অভাব(রবিবার অনেকেই অন্য প্রোগ্রাম রাখেন)-সব মিলিয়ে স্কুল একেবারেই খুঁড়িয়ে চলছে। এভাবে বোধ হয় একক প্রচেষ্টায় আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না।বা হলেও খুবই ছোটো আকারে হবে।
তাই আপনাদের আমার আন্তরিক আবেদন, আপনারা বিদগ্ধজন এই ব্যাপারে যদি কিছু চিন্তাভাবনা করেন। শুধু দুর্গাপুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজো আর রবীন্দ্রজয়ন্তীর বাইরেও অনেক কিছু করার থাকে। আবেগ নিয়ে বললে মাতৃভাষার ঋণ। একটু ভেবে দেখবেন? একটা স্কুল? বাংলা স্কুল? কেমন হয়?

উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

ইমেইল ৬

মা,

নাঃ আজ অবধি বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন কোন যোগাযোগ করেন নি। ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি। ওঁরা উৎসাহী নন। তবে হাল ছাড়িনি আমি, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। স্কুল হবেই। একদিন না একদিন।আমি জানি।

ভালো থেকো।

*************
খাঁড়ির শান্ত জলে একঝাঁক বোট। শহরের সান্ধ্য স্কাইলাইন। আকাশের দক্ষিণ পশ্চিমে মেঘ জমছে যেন। সে হাঁটে,বালিকাটি পাশে হাঁটে।
-গাছ ভরা ফুল দেখেছিস কেমন?
-চন্ন ফু!
-মনে আছে গল্পটা!আচ্ছা, এবারে বল্‌, যদি কবিতা লিখিস বা গদ্য, গাছ ভরা ফুল কি করে বোঝাবি?
-গাছগুলো হাসছে, মা।
-আকাশে মেঘ করেছে দেখেছিস? চল, বাড়ি গিয়ে একটা গান শোনাবো তোকে। মেঘের রং, ফুলের হাসি-সব পাবি।কেমন করে লিখতে হয় , বুঝবি।
-কি গান?
-নীলাঞ্জনছায়া, প্রফুল্লকদম্ববন।নীলাঞ্জন মানে কি বলতো? প্রফুল্লকদম্ববন কি জানিস?
-আমি একটা স্টোরি ভেবেছি। সামারের একটা স্মেল আছে, না মা? যদি এরকম করে লিখি- every summer comes with its own smell। লিখব? আচ্ছা মা, সামার মানে তো গরমকাল, স্মেল হল গন্ধ।বাংলায় লিখলে সেন্টেন্সটা কেমন হবে? এইরকম করে শুরু করব?...'গরমকালের একটা গন্ধ আছে, একদম নিজের গন্ধ।...


বালিকাটি হাঁটে। বর্ণমালার হাত ধরে। গল্পটি রচিত হতে থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস