প্রস্তুতিপর্ব


এই খেলাটা একা খেলতে হয়। একা একা। নিজে নিজে। শুধুই নিজের সঙ্গে।খুব কিছু লম্বা নয় খেলার সময়টুকু। আধঘন্টামত।কিছু কমই হয়তো। খেলাটা একদিন নিজেই শুরু করেছিল ও। নিয়মকানুন ঠিক করেছিল। কিম্বা হয়তো খেলতে খেলতেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। শুধু এখনও জানে না খেলা আরম্ভের সময়টা। ঠিক কখন্ শুরু হয়। একটা হুইশলের আওয়াজ হয় কোথাও। কোথাও একটা। আর ও খেলতে শুরু করে দেয়।
আজ যেমন, এই যে মধ্যরাত এখন, সব কিছু চুপচাপ,-একটু আগে অন্য একটা খেলা খেলছিল ও। ওরা। সেটা দুজনের খেলা। সে খেলারও নিয়মকানুন আছে। সব খেলার মতই। নিয়মকানুন, শেষ, শুরু। হয়তো একটা ছোঁয়া দিয়ে শুরু হওয়া-হাত কিম্বা ঠোঁট কিম্বা কোমর। জিভ, আলজিভ। কপাল চোখের পাতা গলা বেয়ে বুক। তলপেট ঊরু পায়ের পাতা। আলাপ মধ্যলয় ঝালা। তুমুল ঝালা। খেলা শেষের সিক্ততা, অবসাদ। এই যে এখন, খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ওরা শুয়ে রইল, -শুয়েই রইল-এর মুখ ওর কণ্ঠার কাছে। নি:শ্বাসের আওয়াজ। বুকের ওঠাপড়া। কাঁধ, গাল আর বালিশ নিয়ে একটা ছোট্ট ত্রিভুজ-তিনকোণা ফোকর একটা-সেখান দিয়ে রাস্তার আলো এসে পড়ল ওর আধবোজা চোখে। ও চোখ খুলল, ঈষত্ ঝাপসা দেখল সব। চোখ পিটপিট করে আবার চোখ বুজল। চোখ খুলল। মাথা তুলল সামান্য। দেওয়ালের ওপর দিয়ে যেন একটা বিড়াল হেঁটে গেল। ঠিক তক্ষুণি হুইশলটা বাজল। ও সোজা হয়ে শুল। বালিশে মাথা রাখল। খেলতে শুরু করল।

******

এতক্ষণে কফি খাওয়ার ফুরসত্ পেল সুহাসিনী। কোন্ সকালে দুধ, কর্নফ্লেক্স। স্নান। তারপর থেকেই নাগাড়ে ল্যাবে। মুখ তোলার সময় অবধি পায় নি। এক্সপেরিমেন্টের প্রথম চারঘন্টা ক্রিটিক্যাল। একটু এদিক ওদিক হ'লেই এক্সপেরিমেন্টের বারোটা। জুনিয়র ছেলে দুটো একদম নতুন; স্যাম্পল নেওয়া ওদের হাতে ছেড়ে দিতে ভরসা পায় নি সুহাসিনী। সুহাসিনী ল্যাবকোটটা খুলে বাইরে এল। লম্বা করিডোর শুনশান। লাঞ্চ আওয়ারের পরের সময়টা এমনই। একটু ঝিমোনো মত। সুহাসিনীর খিদে মরে গেছে অনেকক্ষণ, শুধু কফির জন্য আনচান। প্যান্টিতে কফি বানিয়ে নিজের কিউবিকলে ঢুকল সুহাসিনী। ল্যাপটপে লগ অন ক'রে কফিতে চুমুক দিল। ভালো লাগল। ধোঁয়াওঠা কফির গন্ধ, ওম্। সুহাসিনীর ডেস্কের ওপর একটা হাল্কা খয়েরী বৃত্ত।কফিমাগের অবস্থানচিহ্ন। মাগটা ঐ বৃত্তেই রাখল সুহাসিনী। ইয়াহু খুলল। মা-র কোন মেইল আসে নি আজও। কাল-ও মেইল ছিল না কোনও।কাজু বা শিমূল-কারোরই কোন মেইল নেই। ওরা অবশ্য খুব রেগুলার নয়। মা-ই লেখে রোজ। সবার খবর দেয়। নিয়ম করে। প্রতিদিন। দু'দিন মেইল নেই। রাতের দিকে ফোন করতে হবে একটা। না কি এখনই একবার চেষ্টা করে দেখবে লাইন পায় কি না। সুহাসিনীর সামান্য টেনশন হ'ল। টয়লেটে গিয়ে ঘাড়ে মুখে জল দিল। এ'রকম অবশ্য আগেও হয়েছে- মেইল আসে নি। আসলে লোডশেডি,ং ভি এস এন এলের গন্ডগোল। কিম্বা কম্পুটারটাই বিগড়েছিল। অথচ সুহাসিনী প্রভূত টেনশন করে উদ্ভ্রান্তের মত বাড়িতে ফোন ক'রে বকুনি খেয়েছে। কখনও শিমূল বা কাজুও মেইল করে দিয়েছে অফিস থেকে। দিদি এমনকি সন্দীপদাও মেইল করেছে -সবই অবশ্য মা-র নির্দেশে, সুহাসিনীকে নিশ্চিন্ত করতে। অথবা মা নিজেই ফোন করেছে সুহাসিনীর মোবাইলে। সুহাসিনী সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে চোখ কুঁচকোল। কফিতে চুমুক দিয়ে ভারী জুতো, মোজা থেকে বের করে আনল পায়ের খালি পাতা। আরাম লাগল সুহাসিনীর। তারপর তর্জনীর টোকায় নেমে আসা চশমাটা ঈষত্ তুলে ল্যাপটপের মনিটরে চোখ রাখল।

******

সব জানালা বন্ধ ছিল। সারারাত। রাতের রান্নার আমিষ্গন্ধ কিম্বা বসবাসের উষঞ্ঝতাজাত জলীয় বাষ্প ঘরের কার্পেটে , জানলায়। গন্ধটা তাড়াতে জানলা খুললো ও। কনকনে হাওয়া ঢুকলো তত্ক্ষণাত্। ও জানলা বন্ধ করে রান্নাঘরে ঢুকে ধূপ জ্বালালো। বাথরুমে ঢুকল।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ও। চুল আঁচড়াবে। আয়নায় নিজেকে দেখছে ও। চোখের পাতায় জল লেগে আছে। কানের লতিতে দু'বিন্দু জল। কপালের ওপর একগোছা ভিজে চুল। ও চিরুণী টানল চুলে। চিরুণীর দাঁত ওর রগ ঘেঁষে নীচে থেকে ওপরে উঠ্ছে ক্রমশ:- ভেজা চুল, শুক্নো চুল-তলায় তলায় কত চুলে যে পাক্ ধরেছে। ব্রাশে পেস্ট লাগাল। জোরে জোরে ঘষ্ল দাঁত। কুলকুচি করল এন্তার জলে। তারপর আদুল গায়ে শাওয়ারের তলায় দাঁড়াল। সাবান মাখল। দেওয়ালে একটা ছোটো মাকড়শা চোখে পড়ল ওর। জল ছিটোলো মাকড়শাটার দিকে। অমনি গুটগুটিয়ে মাকড়শাটা দেওয়াল বাইতে শুরু করল। ওর বুকের মধ্যেও আচম্বিতে সৃষ্টি হ'ল জলকণা, বাষ্পরাজি। একটা মাকড়শা বাইল শিরশিরিয়ে। ও শাওয়ারের অঝোর ধারায় দাঁড়িয়ে খেলতে শুরু করল। খেলা শেষ হ'ল। ভেজা চোখ ভেজা শরীর মুছল ও। আয়নার সামনে দাঁড়ালো আবার। বাষ্পে অস্বচ্ছ আয়না।নিজেকে দেখতে পেলো না ও।আঙুল দিয়ে আয়নার ওপর দাগ টানলো। একটা মুখ। প্রিয় মুখ। চোখ, কপাল। মুখের আদল। অবয়ব। আচ্ছাদন। খুব আবছা। খুব আবছা। অস্পষ্ট।



******

এয়ারপোর্টে সুহাসিনীকে নিতে এসেছিল কাজু আর শিমূল। একহাতে ট্রলি ব্যাগ; কাঁধের ঝোলাটা এ' কাঁধ থেকে ওকাঁধে নিল সুহাসিনী। কে আসবে এয়ারপোর্টে? দিদি? সন্দীপদা? শিমূল? কাজু? নার্ভাস লাগছিল সুহাসিনীর। নেমে আসা চশমাটা তর্জনীর টোকায় সামান্য তুলল সুহাসিনী। আর সঙ্গে সঙ্গেই শিমূলকে দেখতে পেল। হাত নাড়ছে। শিমূলের পাশেই কাজু। একটু গুটিয়ে যেন। সুহাসিনী হাত তুলল। নাড়ল না। বেরিয়ে আসতেই কাজু ওকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। সুহাসিনীর ভেতর থেকেও ডুকরে কান্না এল। কাজু আর সুহাসিনী পরস্পরকে আঁকড়ে রইল খানিক। শিমূল ট্রলি ব্যাগটা নিল, ঝোলাটার জন্য হাত বাড়াল। সুহাসিনী বলল, 'না রে, তেমন ভারি নয়। পারব।' শিমূল মাথা নেড়ে হাসল। ঝোলাটা কাঁধছাড়া করলে কেমন একটা কনফিডেন্স কমে যাওয়া মত ব্যাপার হয় সুহাসিনীর। পার্কিং লট থেকে গাড়ি আনতে গেল শিমূল। কাজুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল সুহাসিনী। জেব্রা ক্রসিংএর সামনেটায়। কাঁধে ঝোলা নিয়ে।
কাজু ততক্ষণে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। সুহাসিনী জিগ্যেস করল, 'বাবা কেমন আছে? বাবা?' কাজু রুমাল বার করে চোখ মুছছিল। নাক ডলছিল সামান্য। রুমালের ভেতর থেকেই জবাব দিল,' কেমন আর? যেমন থাকার কথা। তবে শরীর মোটামুটি ঠিক আছে।' 'আর দিদি? সন্দীপদা?' ঝোলাটা আবার কাঁধবদল করল সুহাসিনী। কাঁধটা টাটাচ্ছে সামান্য। শিমূল গাড়ি আনতে এত দেরী করছে কেন কে জানে? সুহাসিনী সামান্য বিরক্তিবোধ করে লজ্জিত হ'ল। কাজু বলল,' দিদিরা লেকমার্কেট যাবে। ফুল অর্ডার করতে। ওখান থেকে যাদবপুর যাবে দিদি। সন্দীপদা বেহালা যাবে একটু। বিকেলের মধ্যেই চলে আসবে। ওদেরই তো আসার কথা ছিল এয়ারপোর্টে। রুবিকে নিয়ে শিমূলের আজ মানসীদির কাছে যাওয়ার ছিল। কাল রাতে আবার মানসীদি ফোন ক'রে বললেন, আজ নয়, কাল আসতে। তাই শিমূল চলে এল।' সুহাসিনী কাজুর দিকে ফিরল। ছোটোখাটো গোলগাল কাজু। নাক ডলছে আর কথা বলে চলেছে অনর্গল। সুহাসিনী কাজুর হাত ধরে টানল। শিমূল এসে গেছে। মোবাইলে কথা বলছে। স্টিয়ারিংয়ে অন্যহাত। সুহাসিনীদের দেখে ভুরু তুলল শিমূল,'নয়নদা। কথা বলবি?' সুহাসিনী বলল,'না।' আর সামান্য কথা বলে মোবাইল বন্ধ করল শিমূল।বলল,'নয়নদা তোর কথা জিগ্যেস করছিল। তুই ওখানে একাই থাকিস কিনা জিগ্যেস করছিল।'কাজু ভীতু ভীতু মুখে সুহাসিনীর দিকে ফিরল। সুহাসিনী গাড়ির সিটে পিঠ ঠেকাল। চশমায় তর্জনী রেখে বলল,'চল্। বেলা হয়ে গেছে।'

******

ওর তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ডটপেনটা নিয়ে খেলা করছিল। নিবটা ঢোকাচ্ছিল। আবার বের করছিল। নখ গাঁথতে চাইছিল কলমের গায়ে। আঙুল কলম বেয়ে পিছলে নামছিল শাদা পাতার ওপরে। পাতা জুড়ে অজস্র নীল বিন্দু। ও কিছু লিখতে চাইছিল। অন্যমনস্ক হচ্ছিল। একটা শব্দ চাইছিল ও। কিম্বা শব্দবন্ধ। পাচ্ছিল না। অন্যমনস্ক চোখ জানলার বাইরে যাচ্ছিল বারেবারে। আকাশজুড়ে বিকেল পড়ে আসছিল ক্রমশ:। পাতা ঝরছিল হলুদ ও বাদামী। ও টেবিল ছেড়ে উঠল। গেট খুলে বেরোল বাইরে। ওর আজ এই মুহূর্তে খেলতে ইচ্ছে করছিল খুব। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কি ভাবে শুরু করবে ভাবছিল। এক এক দিন একেক জনকে নিয়ে খেলে ও। ইদানীং যাকে নিয়ে বেশি খেলছে, মনে আনছিল তার মুখ, তার অবয়ব। খেলার নিয়মমত বদলে দিতে চেষ্টা করছিল সেই মুখ। কল্পনা করছিল সেই দৃশ্যের। চন্দনের সাজ পরাচ্ছিল সেই মুখে। অনেক লোক, অজস্র ফুল। মালা। ওর চোখে জল আসছিল । বুক মুচড়ে কান্না আসছিল। খেলতে খেলতে কষ্টটা সয়ে যায়। সেটাই খেলা। বা সেজন্যই খেলা। ঝাপসা চোখে হোঁচট খাচ্ছিল ও। কপালে ঘাম জমছিল। কোথাও বসা দরকার এখন। সামনে পার্ক,। গাছের তলায় বেঞ্চ। ছেলেরা খেলছিল। ও দ্রুত হেঁটে বেঞ্চে বসল। রুমালে কপাল, চোখ মুছতেই অভিজ্ঞান শব্দটা মনে এল ওর। সঙ্গে আরো শব্দ, শব্দবন্ধ, বাক্য। ও বন্ধ করল খেলা। ফেরার পথ ধরল। লিখতে বসবে।

******

কাল শ্রাদ্ধ। আজ ঘাটকাজ। বাবলু এসে গেছে সকালেই। বাবলুর সেলুন কাছেই একদম। মহা উত্সাহে মোড়া পেতে বসেছে বাগানে। নরুণ ছুঁইয়েছে কাজু, সুহাসিনীর নখে। এখন শিমূলকে নিয়ে পড়েছে। সুহাসিনী একটা নতুন শাড়ি পরে বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিল। এই সকালেই অনেক লোক। বাবার পুরোনো দু তিনজন বন্ধু-যাদের সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনটা শুরু করেছিল বাবা; এঁরা শ্রাদ্ধের দিনে আসতে পারবেন না -তাই সকালেই। পাশের বাড়ির কাকিমা এসেছেন নিয়মকানুনের তদারকির জন্য। সব ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কি না। এই নিয়মকানুন নিয়েই সুহাসিনী বিরক্ত - এসে থেকেই।
সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ঢুকতেই, ছাদে,বাগানে প্যান্ডেলের বাঁশ দেখেছিল সুহাসিনী। কাজুকে জিগ্যেস করেছিল, 'এই সব করতেই হবে?' কাজু কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল সুহাসিনীর দিকে। বলেছিল,'তুই চাস না? দিদিরাও চায় নি বোধ হয়। কিন্তু বাবা চায়। শিমূলও।' সুহাসিনীর এই নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না সেই মুহূর্তে। বাড়িতে ঢুকতেই বাবা বেরিয়ে এসেছিল। একমুখ দাড়ি। কে জানে কেন ধুতি পরেছিল বাবা। সুহাসিনীর মাথায় হাত রেখে বলেছিল, 'কেমন আছিস?' সুহাসিনী কাঁদে নি। বাবাকে দেখেছিল, পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে ঘরে ঢুকে যেতে। রুবি বেরিয়ে এসেছিল, ঈষত্ স্ফীত পেট নিয়ে। পাঁচ মাস চলছে রুবির। শিমূল ট্রলিব্যাগটা তিনতলায় সুহাসিনীর ঘরে রেখে নেমে এসেছিল। রুবি শিমূলকে বলেছিল,'এই, হাসনুদের সঙ্গে কথা হয়েছে? ওরা ফোন করেছিল তুমি এয়ারপোর্টে বেরোতেই। টিকিট কাটবে কিনা জিগ্যেস করছিল'। শিমূল সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে রুবিকে চোখ দিয়ে ইশারা করেছিল। রুবি চট করে সামলে নিয়ে বারান্দায় এসে সুহাসিনীর হাত ধরেছিল। রুবির শরীরের খোঁজ নিতে সুহাসিনী সামান্য জড়তাবোধ করেছিল সেই মুহূর্তে। রুবি নিজের থেকেই পরিস্থিতি সহজ করে দিয়েছিল। নিজেই বলেছিল,' কাল ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, এমনিতে সব নর্মাল।' শিমূল বলেছিল,' কাল ডাক্তার দেখিয়ে, ওখান থেকেই কসবা আর বেহালায় কার্ড দিয়ে আসব।' সুহাসিনী আবারও বলেছিল, 'এইসব না করলে কি হয়? করতেই হবে?' রুবি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল,' ওমা, সে বললে কি হয়?' আবার শিমূল ইশারা করেছিল আর রুবি চুপ করে গিয়েছিল। শিমূলই বলে চলছিল নিজে থেকে, ' বাবা চায় খুব। তা' ছাড়া বাড়িতে লোকজন এলে মনটাও অন্যরকম হবে সবার। তবে স্ট্রিকটলি তো' কিছু মানা হচ্ছে না। আমি তো দ্যাখ্ ধড়াও পরি নি। মাথাও কামাবো না।' সুহাসিনী সটান তিনতলায় উঠে এসেছিল। ছবিটার দিকে তাকিয়েই নামিয়ে নিয়েছিল চোখ। সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকেছিল দিদি। বেশ বুড়িয়ে গেছে দিদিটা-সুহাসিনীর মনে হয়েছিল। দিদি আঁচলে মুখ মুছে বলেছিল,' লেকমার্কেটে গিয়েছিলাম ফুলের খোঁজে। দেরী হ'ল খুব। তাই যাদবপুরে আর গেলাম না। ফিরে এলাম।' সুহাসিনী সেই একই কথা বলেছিল, ' কেন করছিস এ'সব? এইসব কাজ টাজ?' দিদি অধ্যাপিকার খোলসে ঢুকে গিয়েছিল মুহূর্তে-' তুই স্নান টান সেরে নে। একটু রেস্ট নিবি না? এই নিয়ে কথা হবে পরে। তবে খুব কি দরকার এই নিয়ে কথা বলার?' সুহাসিনীর মাথায় হাত ছুঁইয়ে দিদি বেরিয়ে গিয়েছিল পর্দা সরিয়ে।সুহাসিনী বালিশে মুখ গুঁজে পড়েছিল অনেকক্ষণ। নিজের ঘরে। স্নান সেরেছিল।কি ভেবে একটা শাড়িই পরেছিল। আজও স্নানের পর শাড়িই পরে আছে সুহাসিনী। রোদের তাপ বাড়ছে। বাড়ছে লোকজনের আসা যাওয়া। ডেকরেটর, কেটারারের লোক। চেয়ার আসছিল, পেডেস্টাল ফ্যান, ক্রেট ভরা কোকের বোতল, কার্পেট। স্বাতীমাসি ধূপ জ্বালাচ্ছিল। গোছা ধরে। এক গোছা নিভতেই আর এক গোছা ধরিয়ে নিচ্ছিল। সুহাসিনীর দিকে ফিরে বলেছিল,'অর্ক এম আই টিতে চান্স পেয়েছে। জানিস তো? তোর ই-মেইল, ফোন নম্বর সব লিখে দিস তো একটু।' সুহাসিনী ঘাড় নেড়েছিল অন্যমনস্কভাবে। ভাবার চেষ্টা করছিল, অর্ক কে, অর্কর ডাক নাম কি। পাশের বাড়ির কাকিমা জিগ্যেস করছিলেন,' তুমি বিয়ে করবে না?' সুহাসিনী খবরের কাগজে চোখ আটকে রাখার চেষ্টা করছিল। কানদুটোর জন্য একটা ওয়াকম্যানের দরকার হয়ে পড়ছিল।
কাজু এসে বসল সুহাসিনীর পাশে। সুহাসিনীর আনমনা চোখ কাজুর কানের পাশের পেকে ওঠা চুল ছুঁয়ে যাচ্ছিল। গোলগাল কাজু। সবে স্নান সেরেছে। সাদাখোলের সবজে পাড় শাড়ি। অগোছালো করে পরা। সুহাসিনী কাগজ সরিয়ে রাখল-'ওষুধ খেয়েছিস?' কাজু মাথা হেলালো। বার দুয়েক তাকালো সুহাসিনীর দিকে। উশখুশ করতে লাগল। তারপর বলল,' একটু শুনে যা। ভেতরে।' সুহাসিনী কাগজ রেখে উঠে গেল কাজুর সঙ্গে। বারান্দাঘেঁষা কাজুর ঘর। কি ভীষণ অগোছালো। খাটের পায়ের দিকে মশারিটা গোটানো যেমন তেমন, সোফার কাভারে দুটো বেশ বড়সড় ফুটো। জানলার গ্রীলে ছেঁড়া ছেঁড়া মাকড়শার জাল। টেবিলে ওষুধের শিশি। ঘুমের। ডিপ্রেশনের। একপাতা জেলুসিল। একটুও সময় নষ্ট করল না কাজু। সুহাসিনী ঘরে ঢুকতেই জিগ্যেস করল,' বালিগঞ্জে নেমন্তন্ন করেছিস তোরা?' সুহাসিনী অবাক হয়ে চশমায় তর্জনী রাখল। বলল, 'আমি জানি না। দিদিকে জিগ্যেস কর্।' কাজু ভীতু ভীতু গলায় বলল,' তুই জিগ্যেস কর্ না রে একটু। আমাকে দিদি বক্বে।' সুহাসিনী প্রচন্ড বিরক্তি অনুভব করছিল। কাজু নরম গলায় বলেই চলছিল,' এক্টু জিগ্যেস করিস দিদিকে। কে কে আসবে দিদি জানে কি না। বাবা ওদের খবর দিতে বলেছিল, আমি জানি। একদিন রাত্রে, জানিস তো, ও এসেছিল বোধ হয়। বাবার সঙ্গে কথা বলছিল বাইরের ঘরে বসে। আমাকে তো ডাকে নি কেউ। ভেবেছিল ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।'কাজুর ওপর যুগপত্ বিরক্তি আর মায়া বোধ করছিল সুহাসিনী। বলল, 'এত কিছুর পরে, তুই এখনও এরকম করিস কেন?' কাজু বিড়বিড় করে বলছিল,'তুই তো বিয়ে করিস নি। বুঝিস না তাই। ওর জন্য আমার কষ্ট হয়।' তারপর টেনে ধরেছিল সুহাসিনীর হাত-' তুই কি কারোর সঙ্গে থাকিস? এ'সব জানিস? বল্। বল্ না!' সুহাসিনী বেরিয়ে এসেছিল কাজুর ঘর থেকে। লম্বা টানা বারান্দা পেরিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। বাথরুম, রান্নাঘর, শিমূলদের ঘর, বাবার ঘর। শিমূল আর রুবি ঘরেই ছিল। পর্দাটানা ঘরের ভেতর থেকে ওদের হাসির আওয়াজ পেয়েছিল সুহাসিনী। আর বাবার ঘর থেকে টিভির আওয়াজ। খেলা দেখছে বাবা।

******

এ'খেলার হারজিত্ অন্যরকম। নিজের সঙ্গে নিজের খেলা। নিজের কাছেই হেরে যাওয়া। আবার নিজেকেই হারিয়ে দেওয়া।
ও রাস্তা ক্রস করল সিগন্যালের কাছে। জেব্রাডোরা পেরিয়ে এসে ট্যাক্সি ধর্ল। জানলা দিয়ে চোখ ভাসাল বাইরে। উল্টোদিকে সরে যাচ্ছিল দোকানপাট, মানুষজন, বাতিস্তম্ভ, নিয়ন সাইন। কোথা থেকে ভেসে এল একটা বেলুন। হলুদ বেলুন একটা। আলতো ভেসে এলো রাস্তার এপার থেকে ওপার। আচমকা গতি কমালো ট্যাক্সি। ও ঝাঁকুনি খেল সামান্য। হলদে বেলুনটাকে অবাধে ফুটপাথে উঠ্তে দেখল ও। অমনি খেলাটা শুরু হয়ে গেল। একটা অ্যাক্সিডেন্টের কথা ভাবতে চাইছিল ও। একটা অ্যাক্সিডেন্ট। অনেক ভিকটিম। বা একজন। রক্ত মাংস ঘিলু থ্যাঁতলানো শরীর চটি ছাতা টিফিনবক্স। নাইলনের ব্যাগ থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে কমলালেবু। খেলার এইখানে এসে জিততে চাইছিল ও। আপ্রাণ চেষ্টা করছিল একটা মুখে ফোকাস করতে। প্রিয় মুখ। বদলে দিতে হবে মৃত মুখে। বোজা চোখ। ঈষত্ হাঁ মুখ। সমস্ত মন দিয়ে ও ফোকাস করতে চাইছিল। সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল । জেতার ভূত সওয়ার হয়েছিল ওর মাথায়। আজ জিততেই হবে।


******

তিনতলার ঘরে সুহাসিনী ব্যাগ গোছাচ্ছিল। রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। কাল ভোরেই ফ্লাইট। গোছানো হয়েই গিয়েছিল। টুকটাক জিনিস ঢোকাচ্ছিল। লক করে দেবে। চিরুনী, টুথব্রাশ, ক্রীম সকালে ইউজ করে ঢুকিয়ে নেবে কাঁধের ঝোলায়। দিদি ডাকল,'আয়, বাইরে বসি। ডাকি সবাইকে। ঠান্ডা আছে বাইরে। চাদর নিয়ে নেমে আয়।' আলনার ওপর পাট করে রাখা নীল চাদরটা টানল সুহাসিনী। গায়ে জড়াতেই বসন্তমালতীর গন্ধ পেল। চেনা গন্ধ। চাদরটা আঁকড়ে ধরল সুহাসিনী। চাদরটার পাড়ে লম্বা রুপোলী চুল লেগে ছিল একটা। আঙুল বোলালো সুহাসিনী। তারপর চাদর থেকে ছাড়িয়ে উড়িয়ে দিল। চুল উড়ে পড়ল ঘরেরই কোণে। কাজু ডাকলো,'কই? আয়।'
একতলার বারান্দার সিঁড়ির ধাপে বসে শিমূল, কাজু, দিদি। চেয়ারে বাবা। রুবি এসে মোড়ায় বস্ল। সন্দীপদা বাগানে পায়চারি করছে। সুহাসিনী একটা মোড়া টেনে বসল দিদির কাছ ঘেঁষে। দিদি অধ্যাপিকাসুলভ গলা ঝেড়ে কথা শুরু করে। সামান্য ঘুরে সুহাসিনীর কোলে হাত রাখল দিদি-'তুই তো চলে যাবি কাল ভোরে। এরপর আবার কবে সবাই একসঙ্গে হ'ব। আমরা এই ক'জন।' কাজু নাক টানল। রুবি সামান্য নতমুখী ছিল। কিন্তু এইসময় শিমূলের দিকে তাকালো রুবি। মুহূর্তের জন্য। মুখ নামিয়ে নিল। বাবা বলল, ' আবার কবে আসতে পারবি?' সুহাসিনী হেসে বলল,' রুবির মেয়েকে দেখতে আসব।' রুবি সামান্য গলা তুলল, ' মেয়েই যে হবে তা-' সুহাসিনী সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিল,' ওটা কথার কথা। আসব আমি ঐ সময়। ঠিক।' সুহাসিনী চটি থেকে পায়ের পাতা বের করল। বারান্দার মেঝে ছুঁল। ঠান্ডা মেঝে। পা ঘষে ঘষে ছোট্টো সুগোল গর্তটা খুঁজে পেল। সুহাসিনী ওর বুড়ো আঙুলের নখ ঢোকালো গর্তে। কাজুকে বলল,' তোর মনে আছে, কাজু, এই গর্তটা?' কাজু বলল,'বারান্দার নাভি।' দিদি বলল,' কাজু আর তুই ছোটবেলায় , পেনসিল দিয়ে পেনসিল দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে ধুলোবালি বের গর্তি গর্তটা থেকে-বলতি প্রাণভোমরা খুঁজছি। কিসের বীচি রেখে জলও ঢালতি ফুটোটায়।' সন্দীপদা বাগান থেকে চেঁচিয়ে বলল,' তোমাদের সেই স্টার অফ বেথলেহেমের গল্পটা কিন্তু দারুণ।' দিদি অমনি গলা খাঁকরে শুরু করল,' কাজুটা তো চিরকালের বোকা। কে বলেছে যেন স্টার অফ বেথলেহেম, চব্বিশে ডিসেম্বরের রাতে ফুটবে। কাজু তো সেই টবশুদ্ধ গাছ বারান্দায় রেখেছে। রোজ জল দেয়। কোথায় কুঁড়ি? কোথায় কি? কাজু তবু চব্বিশে ডিসেম্বরের রাতে টর্চ নিয়ে বসেছিল-রাতেই নাকি কুঁড়ি ধরবে আর ফুলও ফুটবে! কাজুকে বোঝায় কার সাধ্যি। শীতের রাতে বারান্দায় বসে আছে টর্চ নিয়ে-রাত বারোটায় ফুল ফোটা দেখবে বলে! শেষে বোধ হয় বোঝা গেছিল, সে অনেক পরে যদিও-গাছটা টগর জাতীয়। কাঠটগর বা ঐরকম কিছু। ' দিদি হাসছিল। শিমূলও। কাজু চুপ করে ছিল। সুহাসিনী বলল, 'টবটা রমামাসি দিয়েছিল, না? যোগাযোগ আছে রমামাসির সঙ্গে?' কাজু বলল,' এতদিন তো বেঁচে থাকার কথা নয়। যখন আসতেন আমাদের গান শেখাতে, তখনই তো অনেক বয়স রমামসির। আমাদের খুব ভালোবাসতেন কিন্তু। বল্?' সুহাসিনী ঝটিতি বলল,'তোরা সবাই তৈরি ছিলি?' কাজু বলল,'কেন বলছিস? রমামাসির জন্য বললি?' সন্দীপদা বাগান থেকে গলা তুলল,' সব কাজ স্মুদলি হয়ে গেল, তাই বলছ?' সুহাসিনী তর্জনী ছোঁয়ালো চশমায়-' না, আমি সবাইকে মানে তোদের অন্যরকম দেখব ভেবেছিলাম।' দিদি বল্ল-যথারীতি অধ্যাপিকার খোলসে ঢুকে গিয়ে বলল,' তৈরী তো থাকতেই হয়। তাই না? যে যেরকম ভাবে নিজেকে তৈরী রাখতে পারে'। শিমূল বলল,' ঠিক বলেছিস।'রুবি মুখ তুলল। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। বাবা বলে উঠল,'কে কেমন ভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখে,তা তো' আমরা জানি না। স্কুল কলেজের পরীক্ষার জন্য যেমন সবাই তৈরী হয়, লক্ষ্য মোটামুটি এক, তৈরী হওয়ার ধরণও এক। আবার ঠিক এক নয়। 'কাজু হু হু করে কেঁদে উঠল আচমকা। দিদি, কাজুর পিঠে হাত রেখে সুহাসিনীর দিকে ফিরল-'আর তুই? তুই নিজে?' সুহাসিনী চুপ করে রইল। মাথা নাড়ল অন্ধকারে।

******

লাঞ্চ আওয়ারের পরের থমথমে করিডোর। দীর্ঘ করিডোর পেরিয়ে সুহাসিনীর নিজস্ব জায়গাটুকু। কিউবিকলটা। কফির গন্ধ, কফির ওম্। ডেস্কে একটা হাল্কা খয়েরী দাগ। বৃত্ত। সুহাসিনীর কফিমাগটা সেই বৃত্তে বসানো। ল্যাপটপ খোলা। মেঝে ছুঁয়ে আছে খোলা পায়ের পাতা। তর্জনী চশমা ছুঁয়ে। মনিটরে চোখ ।।।

।।।রাত নামছিল কোথাও। অথবা বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। কোথাও সকাল হচ্ছিল। সুখী দম্পতির তৃপ্তমুহূর্তমধ্যে বেড়ালের থাবার আঁচড় পড়ছিল। কবি কলম বন্ধ করে উঠে যাচ্ছিলেন লেখার টেবিল ছেড়ে। অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছিল কেউ। অসুখ- বেলুন ভেসে আসছিল। খেলা চলছিল। অথবা প্রস্তুতি।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস