আপন গান
শবদে শবদে বিয়া হয়, সুর বসে, গান জন্মে। কানের ভিতর দিয়া মরমে পশে, থিতু হয়, বসত করে। সুখে সঙ্গ দেয়, দুঃখে হাত ধরে। সে গান বুকের গান। আপন গান। সময়ের পলির তলে তলে গানের ফল্গুধারা-কোন্ মুহূর্তে কখন্ সে আসে, ঘর বাঁধে বুকে, কখন্ আবার হারিয়ে যায়,বুকে চমক দিয়ে হঠাৎ ফিরে আসে কিম্বা ধুয়ার মত ফিরে ফিরেই আসে সারাজীবন...
সে বড় সুখের সময় ছিল না। বাতাসে বারুদের গন্ধ মেলায় নি তখনও। সদ্যোজাত বাংলাদেশ। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ মস্তক হারাচ্ছেন ক্ষণে ক্ষণে। আমাদের শহরতলীতে শিশুরাও পরিচিত বোমা, পাইপগানের গঠনে।নিষিদ্ধ শব্দরাজিতে যুক্ত হচ্ছে পার্টি, লাশ, নকশাল এবং চারুবাবু। স্কুল যাওয়ার পথ জুড়ে উদ্বাস্তু ভিখারিনী, যাতায়াতের পথে বাসে থ্যাঁতলানো কুকুর, রেললাইনের পাশের বস্তি, কুমোরটুলির খড়ের কাঠামো,নিষিদ্ধধ্বনিমাধুর্যে পূর্ণ অজস্র দেওয়াল লিখন। নিতান্ত অনলৌকিক। শৈশব হারিয়ে ফেলার কাল সে সময়। ঠিক সেই সময়েই আমাদের ইশকুলের প্রেয়ারহলে একটি শব্দবন্ধ আমার হাত ধরে-'বিকচকমলাসনে'। লাইনটি মাথায় পাক খায় সর্বক্ষণ-'তুমি যদি থাকো মনে, বিকচকমলাসনে/.. তুমি যদি দুখ পরে রাখো কর স্নেহভরে,তুমি যদি সুখ হতে দম্ভ করহ দূর'। অলৌকিক শব্দবন্ধ, ততোধিক অলৌকিক বাক্যের গঠন, ধ্বনিমাধুর্য-শব্দ-বাক্য-সুর-গান। রবীন্দ্রনাথের গান। আপন গান। নিষিদ্ধশব্দরাজি পিছু হটে যায়।
ক্রমে আমাদের শৈশবে ঢুকে পড়ে কালো চাকতিগুলি-থার্টিথ্রী, ফর্টিফাইভ, সেভেন্টিএইট-ছেলেটি বাঁশি হাতে অথবা প্রভুর স্বর শোনা ভক্ত কুকুরটি-ঘুরে চলে। কখনও রত্নাকর গাইছেন-'.... দেবী গো, চাহি না, চাহি না মণিময়ধুলিরাশি চাহি না ... যে বীণা শুনেছি কানে, মনপ্রাণ আছে ভোর'... অথবা চন্ডালিকা গেয়ে উঠছে 'আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেছে জল দাও, জল দাও, জল দাও', কিম্বা মধুশ্রী ... 'যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা', কখনও শান্তা -'না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে',আর বজ্রসেন-'ক্ষমিতে পারিলাম না যে ক্ষম হে মম দীনতা, পাপীজনশরণপ্রভু'। কিছু বুঝি, কিছু না বুঝি, বুকের ভেতর কিছু একটা হয়-আপন গান জন্ম নেয়। এইভাবে। ঠিক এইভাবে।
এল পির কাভারে বাহারি শাল গায়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তীক্ষ্ণনাসা সাগরসেন গাইছেন'ঐ তো মালতী ঝরে পড়ে যায় মোর আঙিনায়, শিথিলকবরীতে তোমার লও না তুলে', ট্রেমেলোটুকু বাদ দিলে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় যেন রূপকথার রাজপুত্র, দুই সুদর্শনা সুচিত্রা, কণিকায় মোহাবিষ্ট আমরা শৈশবে, কৈশোরে। সামান্য আড়ালে চলে যাচ্ছেন প্রচারবিমুখ নীলিমা সেন,অথবা অর্ঘ্য সেন , সুবিনয় রায়-চশমা চোখে, বিরল কেশ, মৃদু কন্ঠ। কন্ঠমাধুর্য, রূপ, গ্ল্যামারে সামান্য ব্যাহত আপন গানটি বেছে নেওয়া ।
সত্তরের মাঝামাঝি টেলিভিশন আসে। সাদা কালো। ঝিরিঝিরি পর্দা।রবিবারের বাংলা সিনেমা আর বৃহস্পতিবারের চিত্রমালা।
'বিভাস' - এ সিনেমায় উত্তমকুমার গাইছেন, 'তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে', অথবা 'চৌরঙ্গী'তে 'এই কথাটি মনে রেখো'র সঙ্গে ঝরা পাতার দৃশ্য, কিম্বা 'বিকেলে ভোরের ফুলে' ডুয়েটে 'আমার সকল রসের ধারা'।
'একটুকু ছোঁয়া লাগে'তে বিশ্বজিৎ বাগানে গাইছেন, 'প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়-হাওয়ায় উড়ছে অ্যালবার্ট কাট', অথবা 'নিমন্ত্রণে' টিলায় বসে নন্দিনী মালিয়া'দূরে কোথায় দূরে দূরে'-'কুহেলী'র অমোঘ ডুয়েট 'তুমি রবে নীরবে',বিশ্বজিৎ আলতো চিবুক ছোঁয়াচ্ছেন সন্ধ্যা রায়ের হাতে- 'দৌড়'এ স্বপ্নদৃশ্যে মহুয়ার ক্রাচ উড়ে যায় 'হা রে রে রে রেরে'র সঙ্গে- 'বিচারক'এর গ্রীনহাউসের জলধারার মাঝে অরুন্ধতী গাইতে থাকেন 'আমার মল্লিকাবনে'-'যদি জানতেম'এ পঙ্গু রূমা শোনান, সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি'- 'আরোগ্যনিকেতনে' রেডিওতে বাজে 'জীবন যখন শুকায়ে যায়'-'ঠগিনী'তে অনুপকুমার তুলি হাতে গাইছেন 'যৌবনসরসীনীরে'-'নীল দিগন্তে'র সঙ্গে মাথায় স্কার্ফ, চোখে গোগো গগল্সএ কাবেরী বসু 'যে যেখানে দাঁড়িয়ে'তে।'শঙ্খবেলায়' বৃষ্টিস্নাত মাধবী আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে শুরু করছেন 'জানি নে জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না। ''মেঘে ঢাকা তারা'য় 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি'র ইন্টার্ল্যুডে কালপেঁচার ডাক-'কোমলগান্ধার'এ' 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে'র সেই আর্তি।সেই অর্থে অপ্রচলিত 'আমার মন বলে চাই চাই গো' আর 'কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায়'কাছে চলে আসে 'আকাশকুসুম'এ।
সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম না হয়েও কখনও ধ্বনিমাধুর্য্যে, কখনও প্রিয় গায়ক, অভিনেতা বা চিত্রদৃশ্যের হাত ধরে গানগুলি অবিরাম ঢুকে যেতে থাকে অন্তরমহলে, আপন গান হয়ে ওঠে ক্রমশঃ।
পরিণত যৌবনে আপন গান তৈরী হতে থাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, মুহূর্তে। নানা দৃশ্যকল্প জড়িয়ে যেতে থাকে গানের সঙ্গে।
সদনে কিশোরী গায়িকার সঙ্গে হয়তো চিরকালের মতো মিশে রইল 'বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে'; সারাজীবন ধরে ধুয়ার মতো ফিরে ফিরে এলো '... বড়ো তৃষা, বড়ো আকিঞ্চন তোমারি লাগি', সঙ্গে হালকা গোলাপী সালোয়ার কামিজে সেই কিশোরী।ঘনঘোর বর্ষণে, শিশির মঞ্চে স্বাগতালক্ষ্মী গাইছেন 'কেন এলি রে' আর দর্শকাসনে মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে 'ভালোবাসিলি, ভালোবাসা পেলি নে..'র সঙ্গে-কিম্বা ট্রেনে দরজায় হেলান দিয়ে ক্লান্ত যুবক গাইতে থাকেন, 'এ মোহ আবরণ খুলে দাও'-নতুন প্রতিবেশীর জানলা দিয়ে আচমকা ভেসে আসে 'ধীরে ধীরে প্রাণে আমার এসো হে'-মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে প্রিয় গায়িকা গেয়ে ওঠেন 'তুমি কিছু দিয়ে যাও'। সদ্য পিতৃহীন কিশোরী আকাশপানে মুখ তুলে গায় 'এই তারাহারা নিঃসীম অন্ধকারে কার তরণী চলে'।
যে গান, যে গায়ক শৈশবে আকর্ষণ করে নি, সেই গান, সেই গায়ক ক্রমে প্রিয় হয়ে ওঠে। রেডিওতে রবিবার রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার আসর। 'এই শ্রাবণবেলা বাদল-ঝরা' শেখাচ্ছেন সুবিনয়-রবিবারের সকালে ট্র্যানজিস্টারে ভেসে আসছে অদ্ভূত মায়াবী উচ্চারণ-'কোন ভোলা দিনের বিরহিণী, যেন তারে চিনি চিনি'-সুবিনয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিল।সেই প্রথম।
আমাদের বয়স বাড়তে লাগল, মায়েদের চুল রুপোলি-আমরা খুঁজে পেলাম মায়েদের দিনলিপির ছেঁড়া পাতা, হলদে হয়ে যাওয়া চিঠিপত্র, ন্যাপথালিনের গন্ধময় পাটকরা ওভারকোটের পকেটে প্রাচীন লবঙ্গ আর এলাচি।
ক্রমে আমরাও মা হয়ে যাই আর সুবিনয়ের প্রেমে পড়ি প্রবলভাবে। ঐ নরম মেদুর মায়াবী কন্ঠ আমাদের আচ্ছন্ন করে। ৪৫ আর পি এম অথবা শঙ্করলাল ভট্টাচার্য্যের প্রবন্ধ জোগাড় করি আর আবিষ্কার করতে থাকি সুবিনয়ের কন্ঠস্বর কি অদ্ভূত ভরাট হয়ে গিয়েছিল আশির দশকে।নব্বইতে আবার সেই মেদুর নরম গলা -নির্জন দুপুরে বিপণিচত্বরে ক্যাসেটের দোকান থেকে ভেসে আসছেন সুবিনয়-'তরী আমার টলোমলো ভরা জোয়ারে'।অথবা 'হাজার লোকের মাঝে /রয়েছি একলা যে...এখনো কেন সময় নাহি হল/ নাম -না-জানা-অতিথি'- সুবিনয় ভিন্ন তখন আমাকে আর কেই বা কাঁদাতে পারেন?
শ্রাবণের আকুল বিষণ্ন সন্ধ্যার সঙ্গে সুবিনয় রায় অঙ্গাঙ্গী হয়ে যান ক্রমশঃ; 'যেদিন ফুটলো কমল'এ গীতা ঘটক-কে পুনরাবিষ্কার করি। এবং রমা মন্ডল ।
সেই অর্থে রমা মন্ডলের ভক্ত কোনদিনই নই, ছিলাম না। 'যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়া গীত' ' নমি নমি চরণে' মোড়কবন্দী হয়েই ছিল বহুদিন। রবিবারের এক দুপুরে, একা বাড়ীতে রান্না করতে করতে মোড়কটি খুলি। প্রথম ছয়খানা গান সম্বন্ধে সেভাবে বলার কিছু নেই। নমি নমি চরণে, বরিষ ধরা মাঝে, আমার যা আছে, হে মহাজীবন এবং চিরসখা শুনতে শুনতেই ডালে সম্বার, মাছের ঝোলে হলুদ দেওয়া আমার।
সপ্তম গানখানি-'ঘাটে বসে আছি আনমনা।'এর আগেও কতবার কতজনের গলায় শুনেছি, কিন্তু সেদিন -
ডালে পোড়া লাগল, মাছের ঝোল শুকিয়ে গেল , স্টোভটপে ছড়িয়ে রইল হলুদগুঁড়ো, ধনে, জিরে ...
এই অতি সাধারণ চারখানি লাইনেও এত বৈরাগ্য ভরা ছিল-
তীর-সাথে হের শত ডোরে বাঁধা আছে মোর তরীখান-
রশি খুলে দেবে কবে মোরে, ভাসিতে পারিলে বাঁচে প্রাণ।
এর পর থেকে সিডির বাকি গানগুলির অদ্ভূত আবেদন এক-খেলার সাথি এবং তুমি জানো ওগো অন্তর্যামী-র পরে আমার পরাণ যাহা চায় আর তার পরেই যে রাতে মোর দুয়ারগুলি-এই কম্বিনেশনে , আমার পরাণ যাহা চায়-এর মত বহুশ্রুত প্রেমের গান অন্য মাত্রা পায়-আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন উচ্চারণ করেন রমা, আমি মৃত্যুর আবাহন শুনি।
এর পরে একে একে আসে আরো পাঁচখানি গান।বরণমালা হাতে ভুবন দাঁড়িয়ে থাকে, গগন আমার জন্য লক্ষ প্রদীপ জ্বালায়, প্রেম জেগে থাকে-তারপর সব ছিঁড়ে টুকরো হয়ে যায়-রমা গেয়ে ওঠেন-'মরণ বলে, আমি তোমার জীবনতরী বাই।' এভাবেই কখন বহুশ্রুত গান হয়ে ওঠে আপন গান। এবং কখনও পূর্ণ গানটিও নয়-একটি দুটি চরণ।'নাই যদি বা এলে তুমি'-তে 'বিরহ মোর হোক না অকূল,সেই বিরহের সরোবরে মিলনকমল উঠছে দুলে অশ্রুজলের ঢেউএর পরে' চরণগুলি বড় নিÖপ্রাণ ঠেকে, গানের থেকে সরে যায় মন। তখনই বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে আসে পরের অমোঘ চরণ-'তবু তৃষায় মরে আঁখি, তোমার লাগি চেয়ে থাকি/ চোখের 'পরে পাবো না কি বুকের 'পরে পাই বলে'। মুহূর্তে গানটি আপন গান হয়ে ওঠে।
আমাদের বয়স বাড়ে।
মণিপুর আসে, আসে বেসলান, সাগর পাখির ডানা ভারী হয় কৃষ্ণতেলে। বন্ধুবিচ্ছেদ , ভোরের টেলিফোনে প্রিয় মানুষের চলে যাওয়া। তীব্র যন্ত্রণার মুহূর্তে আপন গান সঙ্গ দেয় না আর, যদিও তেমন কথা ছিল না।
হঠাৎ আবিষ্কার করি প্রবাসী বালিকাকে , পরবর্তী প্রজন্ম-ঘুরে ঘুরে গাইছে 'আমার পরাণ যাহা চায়' । বারে বারে উচ্চারণ করে চলে 'আমার পরাণ আমার পরাণ'। সেই 'বিকচ কমলাসন'এ মুগ্ধ হওয়ার মতো।
সেই বয়স, সেই বাক্যবন্ধে অপার মুগ্ধতা।
ফিরে আসে।
ফিরে ফিরে আসুক।
সে বড় সুখের সময় ছিল না। বাতাসে বারুদের গন্ধ মেলায় নি তখনও। সদ্যোজাত বাংলাদেশ। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ মস্তক হারাচ্ছেন ক্ষণে ক্ষণে। আমাদের শহরতলীতে শিশুরাও পরিচিত বোমা, পাইপগানের গঠনে।নিষিদ্ধ শব্দরাজিতে যুক্ত হচ্ছে পার্টি, লাশ, নকশাল এবং চারুবাবু। স্কুল যাওয়ার পথ জুড়ে উদ্বাস্তু ভিখারিনী, যাতায়াতের পথে বাসে থ্যাঁতলানো কুকুর, রেললাইনের পাশের বস্তি, কুমোরটুলির খড়ের কাঠামো,নিষিদ্ধধ্বনিমাধুর্যে পূর্ণ অজস্র দেওয়াল লিখন। নিতান্ত অনলৌকিক। শৈশব হারিয়ে ফেলার কাল সে সময়। ঠিক সেই সময়েই আমাদের ইশকুলের প্রেয়ারহলে একটি শব্দবন্ধ আমার হাত ধরে-'বিকচকমলাসনে'। লাইনটি মাথায় পাক খায় সর্বক্ষণ-'তুমি যদি থাকো মনে, বিকচকমলাসনে/.. তুমি যদি দুখ পরে রাখো কর স্নেহভরে,তুমি যদি সুখ হতে দম্ভ করহ দূর'। অলৌকিক শব্দবন্ধ, ততোধিক অলৌকিক বাক্যের গঠন, ধ্বনিমাধুর্য-শব্দ-বাক্য-সুর-গান। রবীন্দ্রনাথের গান। আপন গান। নিষিদ্ধশব্দরাজি পিছু হটে যায়।
ক্রমে আমাদের শৈশবে ঢুকে পড়ে কালো চাকতিগুলি-থার্টিথ্রী, ফর্টিফাইভ, সেভেন্টিএইট-ছেলেটি বাঁশি হাতে অথবা প্রভুর স্বর শোনা ভক্ত কুকুরটি-ঘুরে চলে। কখনও রত্নাকর গাইছেন-'.... দেবী গো, চাহি না, চাহি না মণিময়ধুলিরাশি চাহি না ... যে বীণা শুনেছি কানে, মনপ্রাণ আছে ভোর'... অথবা চন্ডালিকা গেয়ে উঠছে 'আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেছে জল দাও, জল দাও, জল দাও', কিম্বা মধুশ্রী ... 'যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা', কখনও শান্তা -'না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে',আর বজ্রসেন-'ক্ষমিতে পারিলাম না যে ক্ষম হে মম দীনতা, পাপীজনশরণপ্রভু'। কিছু বুঝি, কিছু না বুঝি, বুকের ভেতর কিছু একটা হয়-আপন গান জন্ম নেয়। এইভাবে। ঠিক এইভাবে।
এল পির কাভারে বাহারি শাল গায়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তীক্ষ্ণনাসা সাগরসেন গাইছেন'ঐ তো মালতী ঝরে পড়ে যায় মোর আঙিনায়, শিথিলকবরীতে তোমার লও না তুলে', ট্রেমেলোটুকু বাদ দিলে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় যেন রূপকথার রাজপুত্র, দুই সুদর্শনা সুচিত্রা, কণিকায় মোহাবিষ্ট আমরা শৈশবে, কৈশোরে। সামান্য আড়ালে চলে যাচ্ছেন প্রচারবিমুখ নীলিমা সেন,অথবা অর্ঘ্য সেন , সুবিনয় রায়-চশমা চোখে, বিরল কেশ, মৃদু কন্ঠ। কন্ঠমাধুর্য, রূপ, গ্ল্যামারে সামান্য ব্যাহত আপন গানটি বেছে নেওয়া ।
সত্তরের মাঝামাঝি টেলিভিশন আসে। সাদা কালো। ঝিরিঝিরি পর্দা।রবিবারের বাংলা সিনেমা আর বৃহস্পতিবারের চিত্রমালা।
'বিভাস' - এ সিনেমায় উত্তমকুমার গাইছেন, 'তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে', অথবা 'চৌরঙ্গী'তে 'এই কথাটি মনে রেখো'র সঙ্গে ঝরা পাতার দৃশ্য, কিম্বা 'বিকেলে ভোরের ফুলে' ডুয়েটে 'আমার সকল রসের ধারা'।
'একটুকু ছোঁয়া লাগে'তে বিশ্বজিৎ বাগানে গাইছেন, 'প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়-হাওয়ায় উড়ছে অ্যালবার্ট কাট', অথবা 'নিমন্ত্রণে' টিলায় বসে নন্দিনী মালিয়া'দূরে কোথায় দূরে দূরে'-'কুহেলী'র অমোঘ ডুয়েট 'তুমি রবে নীরবে',বিশ্বজিৎ আলতো চিবুক ছোঁয়াচ্ছেন সন্ধ্যা রায়ের হাতে- 'দৌড়'এ স্বপ্নদৃশ্যে মহুয়ার ক্রাচ উড়ে যায় 'হা রে রে রে রেরে'র সঙ্গে- 'বিচারক'এর গ্রীনহাউসের জলধারার মাঝে অরুন্ধতী গাইতে থাকেন 'আমার মল্লিকাবনে'-'যদি জানতেম'এ পঙ্গু রূমা শোনান, সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি'- 'আরোগ্যনিকেতনে' রেডিওতে বাজে 'জীবন যখন শুকায়ে যায়'-'ঠগিনী'তে অনুপকুমার তুলি হাতে গাইছেন 'যৌবনসরসীনীরে'-'নীল দিগন্তে'র সঙ্গে মাথায় স্কার্ফ, চোখে গোগো গগল্সএ কাবেরী বসু 'যে যেখানে দাঁড়িয়ে'তে।'শঙ্খবেলায়' বৃষ্টিস্নাত মাধবী আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে শুরু করছেন 'জানি নে জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না। ''মেঘে ঢাকা তারা'য় 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি'র ইন্টার্ল্যুডে কালপেঁচার ডাক-'কোমলগান্ধার'এ' 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে'র সেই আর্তি।সেই অর্থে অপ্রচলিত 'আমার মন বলে চাই চাই গো' আর 'কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায়'কাছে চলে আসে 'আকাশকুসুম'এ।
সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম না হয়েও কখনও ধ্বনিমাধুর্য্যে, কখনও প্রিয় গায়ক, অভিনেতা বা চিত্রদৃশ্যের হাত ধরে গানগুলি অবিরাম ঢুকে যেতে থাকে অন্তরমহলে, আপন গান হয়ে ওঠে ক্রমশঃ।
পরিণত যৌবনে আপন গান তৈরী হতে থাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, মুহূর্তে। নানা দৃশ্যকল্প জড়িয়ে যেতে থাকে গানের সঙ্গে।
সদনে কিশোরী গায়িকার সঙ্গে হয়তো চিরকালের মতো মিশে রইল 'বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে'; সারাজীবন ধরে ধুয়ার মতো ফিরে ফিরে এলো '... বড়ো তৃষা, বড়ো আকিঞ্চন তোমারি লাগি', সঙ্গে হালকা গোলাপী সালোয়ার কামিজে সেই কিশোরী।ঘনঘোর বর্ষণে, শিশির মঞ্চে স্বাগতালক্ষ্মী গাইছেন 'কেন এলি রে' আর দর্শকাসনে মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে 'ভালোবাসিলি, ভালোবাসা পেলি নে..'র সঙ্গে-কিম্বা ট্রেনে দরজায় হেলান দিয়ে ক্লান্ত যুবক গাইতে থাকেন, 'এ মোহ আবরণ খুলে দাও'-নতুন প্রতিবেশীর জানলা দিয়ে আচমকা ভেসে আসে 'ধীরে ধীরে প্রাণে আমার এসো হে'-মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে প্রিয় গায়িকা গেয়ে ওঠেন 'তুমি কিছু দিয়ে যাও'। সদ্য পিতৃহীন কিশোরী আকাশপানে মুখ তুলে গায় 'এই তারাহারা নিঃসীম অন্ধকারে কার তরণী চলে'।
যে গান, যে গায়ক শৈশবে আকর্ষণ করে নি, সেই গান, সেই গায়ক ক্রমে প্রিয় হয়ে ওঠে। রেডিওতে রবিবার রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার আসর। 'এই শ্রাবণবেলা বাদল-ঝরা' শেখাচ্ছেন সুবিনয়-রবিবারের সকালে ট্র্যানজিস্টারে ভেসে আসছে অদ্ভূত মায়াবী উচ্চারণ-'কোন ভোলা দিনের বিরহিণী, যেন তারে চিনি চিনি'-সুবিনয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিল।সেই প্রথম।
আমাদের বয়স বাড়তে লাগল, মায়েদের চুল রুপোলি-আমরা খুঁজে পেলাম মায়েদের দিনলিপির ছেঁড়া পাতা, হলদে হয়ে যাওয়া চিঠিপত্র, ন্যাপথালিনের গন্ধময় পাটকরা ওভারকোটের পকেটে প্রাচীন লবঙ্গ আর এলাচি।
ক্রমে আমরাও মা হয়ে যাই আর সুবিনয়ের প্রেমে পড়ি প্রবলভাবে। ঐ নরম মেদুর মায়াবী কন্ঠ আমাদের আচ্ছন্ন করে। ৪৫ আর পি এম অথবা শঙ্করলাল ভট্টাচার্য্যের প্রবন্ধ জোগাড় করি আর আবিষ্কার করতে থাকি সুবিনয়ের কন্ঠস্বর কি অদ্ভূত ভরাট হয়ে গিয়েছিল আশির দশকে।নব্বইতে আবার সেই মেদুর নরম গলা -নির্জন দুপুরে বিপণিচত্বরে ক্যাসেটের দোকান থেকে ভেসে আসছেন সুবিনয়-'তরী আমার টলোমলো ভরা জোয়ারে'।অথবা 'হাজার লোকের মাঝে /রয়েছি একলা যে...এখনো কেন সময় নাহি হল/ নাম -না-জানা-অতিথি'- সুবিনয় ভিন্ন তখন আমাকে আর কেই বা কাঁদাতে পারেন?
শ্রাবণের আকুল বিষণ্ন সন্ধ্যার সঙ্গে সুবিনয় রায় অঙ্গাঙ্গী হয়ে যান ক্রমশঃ; 'যেদিন ফুটলো কমল'এ গীতা ঘটক-কে পুনরাবিষ্কার করি। এবং রমা মন্ডল ।
সেই অর্থে রমা মন্ডলের ভক্ত কোনদিনই নই, ছিলাম না। 'যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়া গীত' ' নমি নমি চরণে' মোড়কবন্দী হয়েই ছিল বহুদিন। রবিবারের এক দুপুরে, একা বাড়ীতে রান্না করতে করতে মোড়কটি খুলি। প্রথম ছয়খানা গান সম্বন্ধে সেভাবে বলার কিছু নেই। নমি নমি চরণে, বরিষ ধরা মাঝে, আমার যা আছে, হে মহাজীবন এবং চিরসখা শুনতে শুনতেই ডালে সম্বার, মাছের ঝোলে হলুদ দেওয়া আমার।
সপ্তম গানখানি-'ঘাটে বসে আছি আনমনা।'এর আগেও কতবার কতজনের গলায় শুনেছি, কিন্তু সেদিন -
ডালে পোড়া লাগল, মাছের ঝোল শুকিয়ে গেল , স্টোভটপে ছড়িয়ে রইল হলুদগুঁড়ো, ধনে, জিরে ...
এই অতি সাধারণ চারখানি লাইনেও এত বৈরাগ্য ভরা ছিল-
তীর-সাথে হের শত ডোরে বাঁধা আছে মোর তরীখান-
রশি খুলে দেবে কবে মোরে, ভাসিতে পারিলে বাঁচে প্রাণ।
এর পর থেকে সিডির বাকি গানগুলির অদ্ভূত আবেদন এক-খেলার সাথি এবং তুমি জানো ওগো অন্তর্যামী-র পরে আমার পরাণ যাহা চায় আর তার পরেই যে রাতে মোর দুয়ারগুলি-এই কম্বিনেশনে , আমার পরাণ যাহা চায়-এর মত বহুশ্রুত প্রেমের গান অন্য মাত্রা পায়-আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন উচ্চারণ করেন রমা, আমি মৃত্যুর আবাহন শুনি।
এর পরে একে একে আসে আরো পাঁচখানি গান।বরণমালা হাতে ভুবন দাঁড়িয়ে থাকে, গগন আমার জন্য লক্ষ প্রদীপ জ্বালায়, প্রেম জেগে থাকে-তারপর সব ছিঁড়ে টুকরো হয়ে যায়-রমা গেয়ে ওঠেন-'মরণ বলে, আমি তোমার জীবনতরী বাই।' এভাবেই কখন বহুশ্রুত গান হয়ে ওঠে আপন গান। এবং কখনও পূর্ণ গানটিও নয়-একটি দুটি চরণ।'নাই যদি বা এলে তুমি'-তে 'বিরহ মোর হোক না অকূল,সেই বিরহের সরোবরে মিলনকমল উঠছে দুলে অশ্রুজলের ঢেউএর পরে' চরণগুলি বড় নিÖপ্রাণ ঠেকে, গানের থেকে সরে যায় মন। তখনই বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে আসে পরের অমোঘ চরণ-'তবু তৃষায় মরে আঁখি, তোমার লাগি চেয়ে থাকি/ চোখের 'পরে পাবো না কি বুকের 'পরে পাই বলে'। মুহূর্তে গানটি আপন গান হয়ে ওঠে।
আমাদের বয়স বাড়ে।
মণিপুর আসে, আসে বেসলান, সাগর পাখির ডানা ভারী হয় কৃষ্ণতেলে। বন্ধুবিচ্ছেদ , ভোরের টেলিফোনে প্রিয় মানুষের চলে যাওয়া। তীব্র যন্ত্রণার মুহূর্তে আপন গান সঙ্গ দেয় না আর, যদিও তেমন কথা ছিল না।
হঠাৎ আবিষ্কার করি প্রবাসী বালিকাকে , পরবর্তী প্রজন্ম-ঘুরে ঘুরে গাইছে 'আমার পরাণ যাহা চায়' । বারে বারে উচ্চারণ করে চলে 'আমার পরাণ আমার পরাণ'। সেই 'বিকচ কমলাসন'এ মুগ্ধ হওয়ার মতো।
সেই বয়স, সেই বাক্যবন্ধে অপার মুগ্ধতা।
ফিরে আসে।
ফিরে ফিরে আসুক।
Apurbo
ReplyDelete