চরাচরের কথা

 রামবিলাসের এক একটি দিন

সাত্যকি হালদার
গাঙচিল
দাম ৩০০ টাকা
প্রথম প্রকাশ বইমেলা ২০২০

কুড়িটি গল্পের সংকলনটি হাতে নিয়ে পাতা ওল্টালে এই লাইনগুলি: 
'কথা হয়েছিল এক বছর পরে আসার। কিন্তু তা হল না। ফিরে আসতে একবছর পার হয়ে গেল।' 
এইভাবে একটি গল্প শুরু হচ্ছে। তিনলাইনে গল্পের অনাড়ম্বর চলন, অপার রহস্যময়তা যা কি না জীবনেরই আদতে- পাঠকের চোখে ধরা পড়ে। সে আরো দেখে, গল্পের নাম প্ল্যানচেট- এইখানে গল্পটি তাকে ঘূর্ণির মতো টেনে নেয় নিজের দিকে- গল্পটি তৎক্ষণাৎ পড়ে ফেলা এক প্রকার তার নিয়তির মতো হয়ে দাঁড়ায়। যখন সে গল্পটি শেষ করে, তার অপার কৌতূহলী মন এক গভীর জীবনদর্শনের সামনে হতবাক দাঁড়িয়ে -' আমরা নদীর কাছাকাছি আসি। নদী, নুড়িপাথরের নদী। .... পাহাড়, জঙ্গল, সম্পর্কের ভাঙাগড়া নদী দেখেছে। আরো কত দেখবে কে জানে!'  

ধরুন একটি সবুজ রূপকথা গল্পটি যেখানে 'পুরনো আর নতুন মিলিয়ে অচেনা এক বদলের মধ্য দিয়ে' হেঁটে চলা একটি পাড়ায় পুরনো বাড়ি ভাঙতে গিয়ে পাওয়া গিয়েছিল এক সবুজ বুড়িকে। গল্প বা তার প্রতীকী চিহ্নসমূহ এখানে লিখব না। শুধু শেষের লাইনটি হাইলাইট করব-'পারাপারের লঞ্চ ও পারের আবছায়া থেকে এ দিকের উদ্দেশে রওনা হয়। অল্প বৃষ্টির মধ্যে ইতস্তত কিছু ছাতা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।' এইখানে  শুধুমাত্র ঘুরে না লিখে যেই মুহূর্তে ঘুরে ঘুরে লেখা হল, আখ্যান এক বৃহত্তর চলমানতার অংশ হয়ে গেল।  জাস্ট একটা সাধারণ শব্দ গল্পটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। শব্দর ব্যবহার নিয়ে এই রকম গভীর ভাবনা চোখে পড়ে না।

বা ধরুন- মৃত্যুর পাণ্ডুলিপি। বাবা বলে গিয়েছিলেন, তাঁর চলে যাওয়ার দিন মৃত্যু এসে চুপ করে এই কাঠের জলচৌকিতে বসবে। এসেছিলও সে- নীল শাড়ি, মাঝবয়সি, শ্যামবর্ণ, গোল মুখ, শান্ত গম্ভীর দৃষ্টি। একা বসে আছেন  - কেউ তাঁকে চেনে না।  এই কি মৃত্যু না কি অতীত না প্রেম? এমন অনাড়ম্বর ব্যঞ্জনাময় গল্প বিমল কর ছাড়া আর কেউ লিখেছেন বলে জানা ছিল না।  গল্পটি সঙ্গে থেকে যাবে বাকি জীবন।
 
সংকলনটি যেন একটি  স্বল্পালোকিত কক্ষ, মৃদু ​​​​​​​আলোতে ​​​​​​​অস্বস্তি ​​​​​​​হয় ​​​​​​​প্রথমে , তারপর ​​​​​​​সয়ে ​​​​​​​যায়, ​​​​​​​আর ​​​​​​​বস্তুত ​​​​​​​কিছুক্ষণ ​​​​​​​পরে ​​​​​​​সমস্ত ​​​​​​​নজরে ​​​​​​​আসে- আবিষ্কার করি, কক্ষ স্বয়ম্প্রভ; আপাত- ​​​​​​​অদৃশ্য ​​​​​​​আসবাব, ​​​​​​​মানুষজন, ​​​​​​​তাদের ​​​​​​​চলাফেরা, ​​​​​​​হাসি কান্না, ​​​​​​​বর্তমান, ​​​​​​​অতীত ​​​​​​​সমস্ত অনুভব ​​​​​​​করা ​​​​​​​যায়;   বাতি জ্বালানোর সুইচের কথা ভুলে যাই , একটি ​​​​​​​প্রদীপ জ্বালাতেও ​​​​​​​দ্বিধা হয় ​​​​​​​। ক্রমে পাহাড়ের ঘরদোরের মতো জানলা দিয়ে মেঘ ঢোকে, ছাদ সরে গিয়ে  আকাশ;  একসময় চার দেওয়াল খসে পড়ে- বৃহত্তর জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয় তখন।
​​​​​​​
সাত্যকিবাবুর লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম বহুবছর আগে। গল্পের অনাড়ম্বরতা বিস্মিত করেছিল তখনই। এই গল্প সংকলনটি পড়ার অভিজ্ঞতা অনন্য। অনাটকীয় এক একটি গল্প , শান্ত চলন, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন- অথচ  গল্পের শেষে দৈনন্দিনকে ছাপিয়ে যায় বৃহত্তর জীবন। ছোটো গল্পে এই রকম সমাপ্তি খুব কমই দেখেছি এ যাবৎ। ধ্রুপদী উপন্যাসদের কথা মনে হয়। ছোটো গল্পও এমন করে লেখা যায় তবে!  ইচ্ছে হয়, নিজের সব লেখা ফেলে দিয়ে নতুন করে শুরু করি আবার  ।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস