ট্রফি

 Tame birds sing of freedom, wild birds fly....

 

হাওয়াবিহীন দিনগুলিতে আকাশকে চুপসানো বেলুনের খণ্ড মনে হয় - ফ্রেমে  আটকানো; যেদিন বাতাস ওঠে,  নীল বেলুনের টুকরো ঢাউস শামিয়ানা হয়ে উড়তে থাকে,  মেঘ আর ডানারা মোটিফ তৈরি করে -  সাদা কালো লাল নীল মেঘ ছেনে  ছোটো ডিঙি,  বড় বড় পালতোলা  নৌকো, বিশাল সব দুর্গ,  হাতি, উট  আর বুড়ো মানুষ। তার ওপর ঘুড়িরা লাট খায়, জেট চলে যাওয়ার ঘন সাদা লাইন ফিকে হতে হতেই একগুঁয়ে উড়োজাহাজরা উড়ে যায় আচমকা। পাখিরা চক্কর কাটে আর চক্কর কাটে,  শেপ ফর্ম করে - ভি, ওয়াই, এম, এ, ডব্লিউ; কখনও তারা  মানুষের কাছাকাছি নেমে আসে এমন,  যেন ডানার কথা ভুলেই গিয়েছে। ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে  আকাশ দেখি- ডান হাত মাথার নিচে, বাঁ হাত শুরু হয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে, কাঁধের খুব কাছেই চেটো- তাতে তিনটে আঙুল। যেন ডানা। আমি হৃদয়রাম, পঁয়ত্রিশ বছরের এক্ট্রোড্যাকটাইলি পেশেন্ট। উড়তে পারি না অথচ  বাঁ কাঁধে কারো হাত ঠেকলে খাঁচায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় পাই।

আসলে এ'সবই ডানার গল্প।

 

  ১

- ভাবো কোনান ডয়েলের সঙ্গে এই রকম ভোরবেলায় হাঁটছ তুমি, হাতে ইয়াব্বড়ো গোল্ডেন স্ট্যাচু -  ন্যুড অবভিয়াসলি। তোমার প্রাইজ।

'আর্থার কোনান ডয়েল? মানে শার্লক..." - কিউবিকলের ছোটো জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে অবাক হয়ে মুখ ফেরাই  ক্রিসের দিকে। কফির  মাগ থেকে ধোঁয়া উঠছিল। ডানা চুলকোতে চুলকোতে আকাশের রং দেখছি- ঘোলাটে থেকে গোলাপী হয়ে ক্রমশ কমলা আর লাল -  পাড়ার 'কান্ট্রি মীটস' এর জন লি র অ্যাপ্রনের রঙ বেলা বাড়ার সঙ্গে  যেমন বদলে বদলে যায়।

- দুনিয়ায় কিস্যু অসম্ভব নয় হার্ডি, বলা যায় না তুমি প্যারা-পাওয়ারলিফটিংএ গোল্ড পেলে-

- একেবারে গোল্ড মেডেল!

- হ্যাঁ হে -এখন তো গলায় ঝুলিয়ে দেবে, তোমার সমস্যা হবে না।পুরোনো দিনের কথা ভাবো- মহা ভারি সোনার মূর্তি - তুমি একহাতে সামলাতেই পারবে না। সরি মেট। ডিড্নট ওয়ান্ট টু হার্ট ইউ।

- না না বলো - কোনান ডয়েলের কথা কী বলছিলে?

"বোয়ার যুদ্ধ জান? এইটিন নাইনটি নাইন। তো চ্যারিটির জন্য টাকা তুলতে অ্যালবার্ট হলে বডি বিল্ডিং কম্পিটিশন। ফার্স্ট হয়েছিল যে মক্কেল, ঐ ভারি সোনার মূর্তি নিয়ে যাতে  সে নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছতে পারে, কোনান ডয়েল ট্যাক্সি ডাকতে বললেন। আরে, ডয়েলের আত্মজীবনীতেই আছে। পুরো গল্প। সেদিন জাজ ছিলেন তিনজন- ডয়েল, চার্ল্স বেনেট আর অবভিয়াসলি মাই অলটাইম হিরো- "  স্যান্ডোর ছবিতে তিনবার টোকা দিলো ক্রিস। বিড়বিড় করল চোখ বুজে।

ক্রিসের ডেস্কের বাঁধানো ছবিতে ইউজেন স্যান্ডো ঈষৎ বেঁকে দাঁড়িয়ে, এক হাতে বিশাল ডাম্বেল, অন্য হাত বারবেলে ভর  দিয়ে রাখা। বাইসেপ্স, কোয়াড্রিসেপ্সের ওপর সাতটার রোদ এসে পড়েছে। ব্যাঁকাচোরা ডানা আড়চোখে দেখে নিচ্ছিলাম। ক্রিস ঠিক খেয়াল করেছে। বলল-" এই জন্যই তো বলছি-কিছুই অসম্ভব নয়। যেমন যেমন বলছি এক্সারসাইজ করে যাও, মাসল বাড়াও-"

ওয়ারহাউজের বাঁদিকের ছোটো কিউবিকলে কফি খাচ্ছি ক্রিসের সঙ্গে। লো ভল্যুমে এফ এম চলছিল।

Mama said home is where the heart is

When I left that town

I made it all the way to West Virginia

And that's where my heart found

ভারি গলা খাঁকরে নিয়ে ক্রিস শিস দিচ্ছিল।

Exactly where I'm supposed to be

It didn't take much time

It's just south of the Mason Dixon line

It's just south of the Mason Dixon line…..

মা র কথা মনে হল আমার। নানীজী আর মামার কথা। আসলে, ক্লাস টেনের পরেই স্পেশাল টেনিং নিয়েছিলাম ফর্ক আর বুম লিফটিং এ। তারপর কন্ট্রাক্টে বা পার্ট টাইম কাজ করছিলাম টুকটাক। বড় ওয়ারহাউজের চাকরি পেয়ে দেড় হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে এই শহরে চলে আসি -কেউ আপত্তি করে নি। যার একটা হাত, ঠোঁটের ওপরটা কাটা, খোনা গলায় কথা বলে- তার "যেও না" বলার কেউ থাকে?  মা আর নানী, মামাজীর সঙ্গে রয়ে গেল। বাবা ছিল না। দেখিনি কোনদিন।

আজ আমার শিফ্ট শুরু হয়েছে সবে, নাইটডিউটি শেষ করে ওভারটাইম করছে ক্রিস ;  ওয়ারহাউজের এমুড়ো ও মুড়ো চষছিল এতক্ষণ,  আমাকে ঢুকতে দেখে  ফর্কলিফ্ট পার্ক করে কফির জল বসিয়ে দিয়েছিল। ভোরের বাতাস সামান্য মন্থর  , কফির গন্ধে আরো ভারি হয়ে নিচে ঝুঁকে এলো।

" আরে ওদের সব মাথার কাজ। যত ফালতু। আসল হল বডি। ভাবো তো প্রাইজ হাতে  একজন মহান মানুষের সঙ্গে  ভোরবেলা হাঁটছ" - উল্টোদিকে কাচঘেরা ল্যাবে সাদা অ্যাপ্রনের মানুষজনকে দেখতে দেখতে ক্রিস বলছিল।

-ট্যাক্সি ডাকার কথা কী যেন বললে না?

" ক্যাব কি আর পাওয়া যায় অত রাতে?"  যেন ক্রিস দেখতে পাচ্ছে গোটা ঘটনা- " হোটেল পাওয়া গেল একটা , তাও ভোর রাতের দিকে। স্যার ডয়েল আর ফার্স্ট বয় ব্রাহ্মমুহূর্তে হেঁটে হেঁটে হোটেলে গেল। ভাবো একবার। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কার সঙ্গে হাঁটতে চাও হার্ডি?" আকাশে বুচারদের অ্যাপ্রন উড়ে উড়ে আসছিল - একটা দুটো তিনটে;  মুখ ফিরিয়ে বললাম- "ইউ, দ্য  এক্স স্টেট চ্যাম্পিয়ন মিস্টার ক্রিস হ্যাডলি, তুমিই বলো না"। " আমার গুরু। আবার কে " ছবিতে টোকা দিয়ে আবার বিড়বিড় করল ক্রিস; সিঙ্কে  মাগ রেখে  বলল- "আই নো মেট,  হু ইয়োর হিরো ইজ। হাউ ইজ ইয়োর গ্র্যান্ডপা ডুইং?"

আমার হিরোর ছবি ইউজেন স্যান্ডোর বিপরীত। একটাই ছবি দেখেছি। মাসল নেই, সিঙ্গলেট নেই, বেল্ট নেই। ঢোলা কোট প্যান্ট পরা ঘনকালো মানুষ, মুখময় বিষাদ, একটা ধবধবে পায়রার গায়ে বাঁ হাত রেখেছেন, অন্য হাতে বাঁধানো বাইবেল- আমার নানাজী। সত্যিকারের পায়রা, পুঁতির মতো চোখ -  নানাজীর দিকে তাকিয়ে আছে। জ্বর হলে মা যেমন কপালে হাত রাখে, সেই রকম নানাজীর ঘন কালো ভারি আঙুল ওর ডানায়।

আমার মা র দাদাজী বিহার থেকে ফিজি এসেছিলেন, আখ চাষ করতে করতে একসময় খ্রীষ্টধর্ম নিলেন।  তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র, আমার নানাজি সুভার কাছাকাছি একটা চার্চের প্যাস্টর হয়েছিলেন বেশ অল্প বয়সেই। তারপর মা আর মামাজী যখন স্কুলে,  গোটা পরিবারের অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেট করার কথা চলছে-  একদিন সকালে আর নানাজীকে পাওয়া গেল না। ফিজি পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিল-  লাভ হয় নি।  মা আর মামাকে নিয়ে নানী এ দেশে চলে এল তার পরেই, ট্রেনিং নিয়ে হাসপাতালের নার্স হল।  এই সব গল্প আমি মা'র কাছে শুনেছিলাম।  নানীজী চুপ করে থাকত। এখনও  তাই।  নানাজীর কথা উঠলে, রান্নাঘরে গিয়ে আটা মাখতে বসে, চোয়ালের পেশি শক্ত হয়ে যায় তারপর দ্রুত ওঠে, নামে  যেন মাংসের হাড় চিবিয়ে ছাতু করে ফেলতে হবে পাঁচ মিনিটে। আমার মা অবশ্য গল্প বলত তার পাপার -একটাই ছবি ছিল মা র কাছে আর অনেক গল্প - হরপ্রসাদ মানুষের উপকার করতেন খুব- এই জলে ঝাঁপ নিয়ে ডুবন্ত বালিকাকে বাঁচাচ্ছেন, তো এই আগুন লাগা ক্যাটল ফার্ম থেকে গরু বের করে আনছেন অবলীলায়। স্পাইডারম্যান যেন। তাই মনে হত ছোটোবেলায়।

- তোমার পাপাজী চলে গেলেন কেন?

 - থ্রোট মে ক্যানসার হুয়া থা। আই স ব্লাড-

- ব্লাড?

- ইয়েস, পাপাজীর কোটের পকেটে রক্তমাখা রুমাল ছিল-

- চিকিৎসা করালেন না?  পালিয়ে গেলেন?  ভয়ে?

"ডোন্ট ইউজ দ্যাট ওয়র্ড এনি মোর। আমরা তখন অস্ট্রেলিয়া চলে আসার কথা ভাবছি, টাকা দরকার, সঞ্চয় দরকার। নিজের চিকিৎসার জন্য খরচ যাতে না হয়...আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে চলে গিয়েছিলেন। হি ইজ এ হিরো বেটা। এ হিরো।" কপালে বুকে আঙুল ছুঁইয়ে যোগচিহ্ন এঁকেছিল  মা।

স্কুলে তখন প্রাইমারি সেকশন;  স্লাইডে চড়তে ভয় পাই , অথচ ইচ্ছেও খুব। ঝোড়ো হাওয়ার দিন ছিল সেদিন- লাঞ্চ আওয়ারে স্লাইডে উঠেছি আর পিছন থেকে বন্ধুরা সুর করে  "হেই হার্ডি, বী কুইক, বী কুইক " বলছে;  স্লাইডের একদম ওপরে আমি, হাওয়ার ঝাপট লাগছে শরীরে , একটানা "কুইক কুইক" মাথার ভিতরে হাতুড়ির ঘা মারছে, আর আমার ডানা কাঁপছে থরথর করে - তখনই  দেখি স্কুলগেটের সামনে নানাজী- কোট পরা কালো দুঃখী মুখমণ্ডল, হাতে বাইবেল।  হুস করে নেমে গেলাম স্লাইড দিয়ে -"নানাজী, নানাজী, হিয়ার আই কাম"।  দেখি, স্কুলের গেট শুনশান- বাইরের রাস্তায় ললিপপ লেডি ট্রাফিক রেগুলেট করছে অ্যাজ ইউজুয়াল।

ভাবলাম, বাড়ি ফিরে দেখব নানাজী চা খাচ্ছেন সোফায় বসে।

-নানাজী আসেন নি?

-কি বলছিস কি?

-নানাজীকে দেখলাম তো স্কুলের সামনে-

-কোথায়?

-স্কুলের সামনে, দুপুরে-

নানী আটা মাখতে বসে গিয়েছিল। মা বলল- "ভুল দেখেছিস বেটা"।  মামা বলেছিল, নানাজীকে কেউ নাকি ইন্ডিয়ায় স্পট করেছে;  হরদোয়ারে  সাধু হয়ে ঘুরছে- গেরুয়া আলখাল্লা, রুদ্রাক্ষ।

- ইজ হি অ্যালাইভ?

- আই ডোন্ট থিঙ্ক সো। ক্যানসার হয়েছিল। চিকিৎসা করান নি। বেঁচে থাকা নেক্স্ট টু ইমপসিবল।

ক'দিন স্কুলের আশেপাশে নানাজীকে খুঁজেছিলাম। ললিপপ লেডিকে , আলির দোকানে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম- "আমার মত কালো, হাতে বাইবেল, কোট পরা বুড়ো মানুষ - দেখেছ?" স্লাইডের মাথায় উঠে নিজেই এদিক ওদিক দেখেছি, নেমে এসেছি, বারবার নেমেছি, উঠেছি এই ভেবে - যদি আবার দেখতে পাই । লাভের মধ্যে স্লাইডিংএর ভয়টা বেমালুম হাপিস হয়ে নানাজী আমারও হিরো হয়ে গিয়েছিলেন।

নানাজী যে আমার হিরো -ক্রিসকে বলেছিলাম;  তৎসহ,  মায়ের কাছে শোনা হরপ্রসাদের নানাবিধ বীরত্বের গল্প;  ওঁর হারিয়ে যাওয়ার কথা ক্রিস জানে না-গোপন রেখেছিলাম। আসলে, এই কাজে জয়েন করে নানাজীকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল। অফিসের জমায়েত, পার্টি অ্যাভয়েড করতে চাইতাম। গুটিয়ে থাকতাম বড় শহরে, অফিসে। একবার কম্পানি প্রচুর প্রফিট করায়, সবাই বোনাস পেলো -খুব বড় করে ক্রিসমাস পার্টি হবে এক জাহাজে। আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না এমনিতেই, তার ওপর বন্দর অবধি যাওয়া আসা- অনেকটা পথ। ক্রিস বলেছিল- "আমি তোমাকে লিফ্ট দেবো। লেট্স গো। হ্যাভ সাম ফান।" ক্যাথি আমার পিঠে  হাত রেখে বলেছিল –“আমাদের তোমার পছন্দ নয়? " আমার ডানা কাঁপছিল , গুটিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল;  গল্পটা তখনই বানাই- "গ্র্যান্ডপা কে নিয়ে ডাক্তারের যেতে হবে ঐদিন।"

-ওকে দেন। তাহলে তো কিছু বলার নেই। টেক কেয়ার অফ ইয়োর গ্র্যাণ্ডপা। সে হেলো টু হিম অন আওয়ার বিহাফ।

নানাজীকে  বাঁচিয়ে তুলে ডানা গুটিয়ে বসি।  নানাজী - আমার নেস্ট।  ইদানিং অবশ্য গুপিও নেস্টের অংশ হয়ে গেছে।

" গ্র্যান্ডপা ইজ ডুইং ওয়েল, হি ওয়াজ অ্যাকচুয়ালি আস্কিং অ্যাবাউট ইউ দ্য আদার ডে"  বলে মাথা নেড়ে রাইডার ফর্কলিফটে উঠে বসি-  এই ভেহিকলটা কম্পানি থেকে আমার জন্য স্পেশালি অ্যাড্জাস্ট করে দিয়েছে- একটা হাত নিয়ে কাজ করতে অসুবিধে হয় না। ওয়ারহাউজে একটা সাপোর্টিং ফ্রেমের ওপর ঈষৎ ঢালু ছাদ। স্কাইলাইট। লট নাম্বার চেক করি, ম্যানুফ্যাকচারার ব্যাচ নাম্বার। ফর্ক লিফটে তুলে নিই প্যালেট,  তার ওপর নীল প্লাস্টিকের ড্রাম, বাদামী কার্ডবোর্ড বক্স । স্ট্র্যাপড। ওয়ারহাউজের বাইরে রাখা শিপিং কনটেনার থেকে আনলোডিংএর পরে,  নির্দিষ্ট শেল্ফে স্ট্যাক করি; প্রডাক্টের বাক্স ওঠাই নামাই, এক এক করে প্যালেটে তুলি, ফর্কলিফট দিয়ে বাইরে এনে রাখি। স্কাইলাইট বেয়ে  ধীরগতিতে আলো চুঁইয়ে ঢোকে । ছোটো ছোটো আলোর বৃত্ত তৈরী হয়। আজকের আলোর রং শেড বদলাচ্ছে আশ্চর্যরকম দ্রুতগতিতে ; জানলার কাছে গিয়ে দেখি রাস্তা ঘাট শিপিং কনটেনারের রঙ  ততক্ষণে সিপিয়া , আকাশে রক্তের ছিটে লাগা অ্যাপ্রনের সংখ্যা বেড়েছে,  আর উত্তরদিকের আকাশে যেন গেরিলা অ্যাটাক শুরু হতে চলেছে- ঘন কালো ধোঁয়ার দল গুঁড়ি মেরে আকাশে উঠছে।  ক্রিসকে চেঁচিয়ে ডাকি- "হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং হিয়ার? ইজ ইট আ বুশফায়ার ? না স্রেফ  ব্যাকবার্নিং? কোনো নোটিফিকেশন পেয়েছিলে?" ঠিক তখনই পি এ তে  সাইরেন বাজে একটানা, তারপর ঘোষণা  হয় - কাছাকাছি অঞ্চলে বুশফায়ার। স্প্রেড করছে দ্রুত। বড় রাস্তা ঘন্টা খানেকের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে । সমস্ত কর্মচারীকে অবিলম্বে বাড়ি চলে যেতে বলা হচ্ছে।

মুহূর্তের মধ্যে হুড়োহুড়ি। ল্যাবের দিক থেকে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে মানুষজনকে দ্রুত নামতে দেখি, ওয়ারহাউজ পেরিয়ে তারা কার পার্কের দিকে দৌড়ে যায় । ফর্কলিফ্ট, স্লাইড লোডার পরপর দাঁড়িয়ে পড়ে। কিউবিকল থেকে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে আসে ক্রিস- "তোমার পাড়ার দিকটাতেই লেগেছে মনে হয়, থেকে যাও এখানেই না কি?  নয়তো চলো মেট , চলো আমার সঙ্গে। আমার বাড়ি। গ্র্যান্ডপা উইল বি অলরাইট। নেবারদের কাউকে ফোন করে দাও। আছে নাম্বার?"

-  না না, গুপিও আছে । বাড়ি যেতেই হবে

-ঘুপি? গুফি? হোয়া.. সরি ইউ নেভার মেনশনড।  ইউ হ্যাভ আ পেট? হাউজমেটরা আপত্তি করে নি? এনি ওয়ে টেক কেয়ার মেট। ড্রাইভ সেফ।

 

 ২

গাড়ির রেডিওতে ইমার্জেন্সি বুলেটিন শুনছিলাম- আমাদের পাড়ার কাছাকাছি এমবার অ্যাটাক শুরু হয়েছে -জ্বলন্ত কাঠকুটো, ডাল পালা উড়ে আসছে, লোকজন যেন সতর্ক থাকে, এমার্জেন্সি ব্যাগ রেডি রাখে, প্রয়োজনে ইভ্যাকুয়েশন শুরু হবে কোনো কোনো অঞ্চলে। অবস্থা আয়ত্বে আনার চেষ্টা চলছে ।

মিনিট চল্লিশের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাওয়া উচিত। শেয়ার্ড হাউজ। দুজন স্টুডেন্ট, একজন কার্পেন্টার- আমার হাউজমেট। কমন কিচেন, টয়লেট আর চারটে ঘুপচি বেডরুম। বাড়িওলা ,তার পরিবার অন্য পাড়ায় থাকে, প্রতি ক্রিসমাসে আমাদের নেমন্তন্ন করে বড় হলঘরে বসায়, ক্রিসমাস ট্রীর তলা থেকে ছোটো ছোটো প্রেজেন্ট তুলে আমাদের হাতে দেয়- কফি মাগ,রুমাল,  তাসের প্যাক, জলের বোতল।  অনলাইনে রেন্ট দিই আমরা। আমাদের ডানদিকে একটা বাড়ি, লিও, নিকোল , তাদের  চার খোকাখুকী আর দু দুটো পেল্লায় কুকুর- বীস্ট আর ডাস্টি- আমাকে দেখলেই তারা একটানা ডেকে চলে। বাঁদিকটা রাস্তা। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে একদা যে বাগান ছিল, আমাদের অযত্নে তা স্রেফ ঝোপঝাড় হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। এখানেই গুপিকে দেখি  মাস ছয় আগে।

 

সেদিন কাজ থেকে ফিরে  পার্ক করছি। স্পিনার নব লাগানো গাড়ি, অসুবিধে হয় না তবে একটু স্লো চালাই; পার্ক করতে সময় লাগছিল- অন্ধকার, পার্কিং লাইটটা বোধ হয় খারাপ হয়ে গেছে-  কাচ নামিয়ে মুখ বের করে সাবধানে পার্ক করছিলাম- ডাস্টি আর বীস্টের তর্জন গর্জন কানে আসছিল। গাড়ি থেকে নেমে লক করছি, ডানায় লাঞ্চ বক্স ঝুলছে, নিকোল ছুটতে ছুটতে এসে বলল- একসকিউজ মি,  আপনাদের বাগানে ওকে ছেড়ে দেব? দেখুন দেখুন, কুকুরদুটোর তাড়ায় রাস্তা অবধি এসে থরথর করে কাঁপছে। " দেখি- চ্যাপ্টা মুখ,  কালো আর ছাই ডোরাকাটা মোটাসোটা ব্লু টাং লিজার্ড নিকোলের কোলে জিভ বের করছে, ঢোকাচ্ছে,লম্বাটে শরীর হেঁচকি তোলার মত কেঁপে কেঁপে উঠছে,  দেহের আয়তনের অনুপাতে বেখাপ্পা রকম ছোটো হাত পা, ঠিক আমার ডানার মতই -

লাঞ্চবক্স নামিয়ে রেখে কোলে নিলাম- আমার ডানা ওর সামনের পায়ে ছুঁয়ে গেল, কেমন শিরশির করে উঠল - আলতো করে ঝোপের মধ্যে নামিয়ে দিলাম। তারপর বাড়িতে ঢুকতে গিয়েও ফিরে এসে দেখি, একই জায়গায় বসে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে জিভ বের করে। কিচেন থেকে ছোটো বাটি তে জল এনে ওর সামনে রাখলাম। ব্লু টাং তাকালো আমার দিকে যেন কতদিনের চেনা- "কী নামে ডাকি তোকে? "

স্কুলে আমার ক্লাসমেট ছিল সুজয়। বাঙালী। প্রতিবছর ওর জন্মদিনে নেমন্তন্ন করত, খাওয়া দাওয়ার পরে সিনেমা দেখতাম ওদের বাড়িতে। ওখানেই দেখেছিলাম গুপি গায়েন, বাঘা বায়েন;  ইংরিজি সাবটাইটেল ছিল, বুঝতে অসুবিধে হয় নি। গুপি আর বাঘা হাতে হাতে তালি দিলেই ম্যাজিক হয়ে যাচ্ছিল; সবাই এত মজা পেয়েছিলাম যে পরের বছর আবার একই সিনেমা দেখেছিলাম আমরা।-

-জল খা, অ্যাই গুপি।

পরদিন সকালে কাজে বেরোনোর আগে জলের বাটিতে জল দিলাম- "গুপি?" ঝোপের ভিতরে আওয়াজ হল- সরু জিভ চ্যাপ্টা মাথা, সরু চোখে এক চিলতে হাসি- মনে হল। অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল ব্যাপারটা - দুবেলা জল, আপেলের টুকরো, ভাঙা  বিস্কুট ঝোপের সামনে রেখে আসি। সরসর আওয়াজ ওঠে- ডোরাকাটা লম্বাটে শরীর বুকে হেঁটে বেরিয়ে এসে মুখ বাড়ায়, একহাতে তুলে নিয়ে,  ডানায় ডানায় ঠেকাই- "শুন্ডী....ই"- যেন কিছু একটা ঘটে যাবে এখনই, যেন এক্ষুণি টেক অফ করে আকাশে উড়ব। গুপি কী করছে এখন? ভয় পাচ্ছে?

এই পথে এখনও বিপদজনক কিছু চোখে পড়ছিল না। তবে ট্রাফিক স্লো, নড়ছে না বললেই চলে। শহরের সমস্ত গাড়ি যেন পথে নেমে পড়েছে, সবাই অফিস থেকে অসময়ে বাড়ি ফিরছে একসঙ্গে ; হাউজমেটরা কি ফিরেছে? নিকোলদের উডেন ডেকের পাশেই ঝোপজঙ্গল- গুপির ঘরবাড়ি- যদি কিছু উড়ে আসে? যদি আগুন ধরে যায়?

গাড়ির লাইন অসম্ভব ধীরে এগোচ্ছিল- পরের ট্রাফিক লাইটে পৌঁছে বোঝা গেল কারণ - সামনে ব্যারিকেড; গাড়ির লাইন পিঁপড়ের মতো বাঁ দিকে বেঁকে যাচ্ছে,  বিরাট  গ্লো সাইনে আলো জ্বলছে, নিভছে- ডিট্যুর  ডিট্যুর-সোজা পথে গেলে  আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব- আর এতখানি ঘুরে যেতে  ঘন্টা দেড়েক লেগে যাবে-

সময় বয়ে যাচ্ছে হু হু করে -এতক্ষণে  হয়তো উল্কার মতো এমবার পড়ছে নিকোলদের ডেকে, ঐ হয়ত আগুন ধরে গেল...ঘাস জ্বলছে, বাড়ি ঘর জ্বলছে, গুপি পুড়ে যাচ্ছে, ওর ছোটো ছোটো পা, আঙুল... ফ্র্যাকশন অফ এ সেকন্ডে ডিসিশন নিলাম; ডান হাতে স্টীয়ারিং বোঁ করে ঘুরিয়ে আচম্বিতে ইউ টার্ন - পিছনের গাড়ি হঙ্ক করে রুড ফিঙ্গার দেখালো- আর একটা টার্ন নিয়েই অ্যাক্সিলারেটরে চাপ  দিলাম, তারপর,  ব্যারিকেড ভেঙে সোজা দৌড়- রিয়ার ভিউতে চোখ রাখিই নি আর-

এখন দেখছি। কালো ধোঁয়ার পর্দা গোট পৃথিবী থেকে আমাকে আলাদা করে দিয়েছে- একটা গাড়িও আমার পিছনে নেই, রিয়ার ভিউতে ধোঁয়া, সাইড মিররে ধোঁয়া- কালো ধোঁয়া পাক খেতে খেতে তাড়া করেছে আমাকে, সামনে রাস্তার দুপাশে আগুন- গাছে আগুন, ডালে আগুন , পাতায় আগুন; মরা পাখি, প্রজাপতি ছাই হয়ে গাড়ির বনেটে ঝরে পড়ছে-  আরো স্পীড বাড়ালাম;  ধোঁয়ার দল তবু ধরে ফেলল আমাকে- গাড়ির ভিতরে  ঢুকে পড়ল গলগল করে; উইন্ড শিল্ডে ছাই জমে জমে ভিজিবিলিটি এখন প্রায়  জিরো, ওয়াইপার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে; আন্দাজে,  ডাইনে শার্প  টার্ন নিতেই প্রচণ্ড আওয়াজ - জোর ধাক্কায় স্টীয়ারিংএ ঠুকে গেল কপাল।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে  স্প্রিন্ট টানলাম - ততক্ষণে, ডানদিকের রাস্তায় গাড়িতে গাড়িতে ঠোকাঠুকি চলছে- কে বাড়ি ফিরছে কে বাড়ি ফেলে পালাচ্ছে গুলিয়ে যাচ্ছে নিজেদেরই- আকাশ থেকে ছাই পড়া শুরু হয়েছে- ফায়ারট্রাকের সাইরেন একটানা - লাল আলো নীল আলো- টানা সাইরেন-  উড়ে আসছে আগুনমাখা ছোটো ডাল পাতা - আগুন আর ধোঁয়া ক্রমশ দখল নিচ্ছে শহরের- ফায়ার ফাইটাররা লম্বা হোস  হাতে নিয়ে পাল্টা দিতে রেডি- মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টর-

অ্যান্ড দ্যাট' স হোয়ার মাই হার্ট ফাউন্ড

একজ্যাক্টলি হোয়ার আই অ্যাম সাপোসড টু বী

ইট ডিডন' ট টেক মাচ টাইম-  হা-আ  আ-আ

গুপির কাছে পৌঁছতেই হবে আমাকে - রান হার্ডি রান- দৌড়ছি আর দৌড়চ্ছি- ডানা কাঁপছে থরথর করে- দম ফুরিয়ে আসছে- সামনে কী? এত জল এলো কোথা থেকে?

জলের তোড় রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথায় পোঁছে যাচ্ছিল অবলীলায়- অজস্র জলবিন্দু  আগুন আর রোদের প্রতিফলন নিয়ে ঝমঝম করে রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। ঠিক তখনই দেখলাম নানাজীকে;   টকটকে লাল ফায়ার ট্রাকের মাথায়  দাঁড়িয়ে রেভারেন্ড হরপ্রসাদ, মোটা হোস হাতে-

-দিস ইজ হৃদয়রাম! হিয়ার আই কাম নানাজী-

ঘাড় ঘোরালেন হরপ্রসাদ।

-নানাজী ই ই !!

হোস নামিয়ে রেখে হাত নাড়লেন -" আসছি , দাঁড়াও।"

ট্রাক থেকে নেমে আসছেন হরপ্রসাদ, টিউনিকের ওপর হাই ভিসিবিলিটি জ্যাকেট, ওভার ট্রাউজার, হেলমেট, কোলে গুপি- কুতকুতে  চোখ, চ্যাপ্টা মাথা- জিভ বের করছে ঢোকাচ্ছে- বুকের কাছটা দপদপ করছে , বোতল থেকে নানাজী জল ঢালছেন ওর শরীরে-

- আর ইউ লুকিং ফর হিম?

-ইয়েস। থ্যাঙ্কিউ নানাজী থ্যাঙ্কিউ । হাউ ডিড ইউ ফাইন্ড হিম?

নানাজী হাসেন-" তুমি কোথায় যাবে হৃদয়রাম?

-বাড়ি যাবো, আমি আর গুপি বাড়ি যাবো নানাজী, কিন্তু রাস্তা তো বন্ধ -

- এই তো সামনে নদী। নদী পেরোলেই বাড়ি। আর সামান্য পথ বাকি। চলো।

চালচিত্রে  আগুন। গুপিকে কোলে নিয়ে নদীর দিকে হাঁটি আমরা। নানাজী আর আমি। রেভারেন্ড হরপ্রসাদ আমার কাঁধ ছুঁয়ে হাঁটছেন , অন্য হাত প্রসারিত  রেখেছেন- পায়রাটি এসে বসবে ।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস