বসন্ত থেকে

 গতকাল দুপুর থেকেই পূর্বপ্রস্তুতির আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। কোনো উৎসবের। সম্ভবত। কিম্বা খুব বড় কিছু  নয়- হয়তো এমন কিছু, যা সচরাচর হয় না। ঘরের গন্ধই বদলে গিয়েছিল। স্নো পাউডার ভাত ডাল আলুর তরকারি আর ডেটলের গন্ধ সরিয়ে দিয়ে কখনও দুধ ওথলানোর বাস,  কখনও মথবল ,  অথবা ফুলের গন্ধ বাড়ির নিজস্ব বাতাসে জায়গা করে নিচ্ছিল। ছাদের ঘর থেকে বড় কড়াই, হাঁড়ি বেরিয়েছে সকালেই, রোদ পড়ে যাওয়ার আগে সেকেলে  জাজিম ছাদ থেকে  ঘরে তুলে আনা হয়েছে, প্রাচীন ক্যাসেট প্লেয়ারে সেতার। অন্ধকার নামার আগেই ঘরের আলো জ্বালা হয়ে গিয়েছিল- ছোটো, মেজো, বড়ো- সব বাতি।  ফুল আসছিল, মালা, সে সব ফ্রিজের অভ্যন্তরে ঢোকানোর সময় নীল বাষ্পময় আলো দেখা যাচ্ছিল;  সেই আলোয়  চেয়ার সোফাসেট , টেবিলের স্থান পরিবর্তন ঘটছিল অবিরত। যেন মঞ্চ, দর্শকাসন সাজিয়ে ফেলতে হবে, মাইক টেস্টিং সেরে ফেলতে হবে রাতের মধ্যেই।  অথচ লোক বলতে ঐ তো তিনজন- টুসি, নমিতা, ঝন্টু। এই স্টেজে প্রতিদিনের কুশীলব।


পুবের জানলার পর্দা সরানো থাকলে এই দেওয়াল থেকে রাস্তা দেখা যায়। সন্ধ্যের মুখে এখন যেমন। ফাঁকা রাস্তার মাথার ওপরে ঘন নীল মেঘ উঠছে,  উল্টোদিকের বাড়ির দোতলায় আলো জ্বলল, আর যে পাখি তিনটে এতক্ষণ টেলিফোনের তারে বসেছিল, তারা উড়ে গেল এইমাত্র ; দূর থেকে কিছু শব্দ এগিয়ে আসছিল  যেন পথচারীদের সেই সব কথারা মাঝখানের এই ফাঁকা রাস্তাটুকু পেরিয়ে ডানদিকে যাবে কিম্বা উল্টোটা- ফলে এই জনহীন পথের দু’ দিকেই কিছু দৃশ্য  ক্রমাগত ভেঙে যাচ্ছিল অথবা  তৈরি  হচ্ছিল। এখান থেকে যে রাস্তাটুকু দেখা যায় তা এমনই চৌকো আর ফাঁকা যেন এখনই নাটক শুরু পারে সেখানে - ছোটো, একাঙ্ক কোনো নাটক। এই যেমন, এইমাত্র , অনেক কালের মনের কথা জাগল গাইতে গাইতে কেউ বাঁদিক থেকে ঢুকল। তার পিছন পিছন আরো কেউ। তারপর নিউটাউন, কোভিড - এই সব শব্দ, সাইকেলের ঘন্টি, কুকুরের ডাক-  বাকি লাইনগুলো চাপা পড়ল অথবা ফ্রেম থেকে বেরিয়ে গেল লোকটা।

সকালের রোদে পর্দা টেনে দিলে মঞ্চের বর্গক্ষেত্র পথ থেকে সটান এই ঘরে ঢুকে পড়ে। তখন বাঁ দিক থেকে শাদা প্লেটে পাঁউরুটি নিয়ে টুসি আসে, তারপর ফ্রিজ খুলে মার্জারিনের  কৌটো বার করে, পাশের ছোটো ঘর থেকে ভোঁতা ছুরি আনে,  আর চামচ, কাপ, হরলিক্সের শিশি। ডান কোণের বইয়ের তাক ঘেঁষে চেয়ার -সেখানে হেডলাইন বা সম্পাদকীয় পাতায় চোখ বোলায় নমিতা;  হয়তো  পাঁচ মিনিট আগে, বাঁ দিক থেকে ঝন্টু এন্ট্রি নিয়ে, নমিতার সামনে কাগজ রেখে  দিয়ে ঐ বাঁদিক থেকেই বেরিয়ে গেছে। উইংসের ওপারে দিনের বেলাতেও  গাঢ় অন্ধকার, কেবল ঈষৎ হলদে আলো  এ'দেওয়ালে এসে  পড়লে ওপারের আভাস পাওয়া যায়। ঘরের ভিতরের এই স্টেজে টুসি আর ঝন্টু বরাবর বাঁ দিক থেকে ঢোকে, নমিতা ডান দিক থেকেই সচরাচর। দুপুরেও একই প্যাটার্নে, নমিতা ডানদিক থেকে বাঁদিকে স্নান করতে যায় আবার বাঁ থেকে ডাইনে ঢুকে চুল আঁচড়ায়, টুসি বাঁদিক থেকে ঢুকেই বেরিয়ে যায় ছাড়া কাপড় চোপড় নিয়ে তারপর আবার ভাতের থালা  নিয়ে থেকে ঢোকে। সন্ধ্যার পরে নমিতা একাই - গান শোনে, বই পড়ে, লেখে, ফোনে কথা বলে কখনও। ছোটো ডায়রিতে লেখার সময় এই দেওয়ালের দিকে তাকায়। তারপর একসময় টুসি রাতের খাবার রেখে যায়, পাশের ঘর থেকে ছোটো প্লাস্টিকের ঝুড়ি এনে ঢাকা দেয়, জলের গেলাস রাখে। আলো নিভে যায় ঠিক দশটায় ।

ইদানিং নমিতাকে অস্থির দেখাচ্ছিল। বেশ কিছুদিনই এ'রকম। ঘন ঘন বাঁদিকের উইংস দিয়ে বেরিয়ে যায়, কখনও চেয়ার ছেড়ে, পর্দা সরিয়ে জানলার গ্রিলে মুখ রেখে বাইরে দেখতে থাকে। জানলা থেকে সরে এলে, ওর গালের চামড়ায় গ্রিলের কল্কার আভাস আর আর মরচের দাগ থাকে।  নমিতা মুখ দেখে বাঁদিকের আয়নায় ভ পুরোনো,  চটা ওঠা  বড় বেলজিয়ান গ্লাস। পাশেই ছোটো টেবিলে নমিতার মোবাইল চার্জে বসানো। জানলা থেকে সরে এসে ফোন করে কাউকে। নম্বরের বোতামে চাপ দিয়ে যায় বারবার। আর এই দেওয়ালের দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে।
গতকাল দুপুর থেকে , যখন উৎসবের হাওয়াবাতাস বাড়ির দখল নিচ্ছে, নমিতাকে আনন্দিত মনে হয়েছিল-  টুকটাক তদারকি করছিল, কথা বলছিল ফোনে- প্রসন্নচিত্তে।  কখনও হাসছিল। আজ সকালে আবার খুব অন্যরকম - অস্থির নয়, আবার শান্তও নয়। যেন, ও কেমন থাকবে ওর জানা নেই, যেন আজকের দিন  সাব্যস্ত করবে ওর আগামীকাল। নমিতা টুসিকে ডাকল গলা তুলে।  তারপর ফ্রিজ খুলে মালা বের করল,  দেওয়ালের দিকে এগোলো।
 



এই বাড়িটায় কোনো জ্যান্ত পুরুষমানুষ নেই। মানুষ বলতে দোতলায় মাসিমা আর একতলায় আমি। ঝন্টুদা সকালের দিকে আসে , বাগানের কাজ করে, বাজার এনে দেয় , তারপর মাসিমার ওষুধ, ব্যাংক, পোস্টাপিস-  টুকটাক কত কাজ থাকে  সংসারে। আমি মাসিমাকে একা রেখে বেরোতে পারি না। ঘরের ভিতর খুব হাঁপিয়ে উঠলে বাগানে ঘুরি, ছাদে হাঁটি। খুব বেশি কাজ তো নয়-  দুজন মানুষের রান্না- তাও মাসিমার পাখির আহার। আর মাসিমাকে খেতে দেওয়া, একটু ঝাড়াঝুড়ি। ধোয়া পাকলার জন্য আরতিমাসি আসে দুপুরে, বিকেলে চলে যায়।
এ বাড়িতে কাজে ঢোকার আগে মাসিমা বলেছিলেন, ভেবে দেখতে।  অল্প বয়স,  শখ আহ্লাদ আছে, প্রেম ভালোবাসা, বিয়ে , সংসার  করার সময়। একটা বুড়ি মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন কাটানো সোজা কথা নয় তো। কেঁদে ফেলে মাসিমাকে সব বলেছিলাম তখন- কী জীবন পার করে এসেছি,  আর সেখানে ফিরতে চাই না।
বলেছি বটে ফিরতে চাই না, কিন্তু মাঝে মাঝেই হাঁফ ধরে যায়। সকাল থেকেই ঝিম ধরে থাকে বাড়িটা। এমনিতেই পুরোনো বাড়ি, ঠান্ডা মেঝে, দেওয়ালে নোনা লাগা। বাইরে কত রোদ, গরম, অথচ এ বাড়ির মধ্যে সর্বদা মাঘমাস। জষ্ঠিমাসেও এক এ ফ্যান দিয়ে রাখলেই হয়ে যায়, তাও রাতের দিকে একটা কাঁথা লাগে। দেওয়ালে দেওয়ালে সব মরা মানুষের ছবি- সব বুড়ো, বুড়ি ; চশমা, পাকা চুল। এ বাড়িতে জোয়ান মানুষ বলতে শুধু আমি আর একজন ছবির মানুষ।

দোতলায় মাসিমার বড় ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি আছে- প্রথমদিনই চোখ আটকে গিয়েছিল। এমন সুন্দর পুরুষমানুষ কখনও দেখি নি-সা জোয়ান- লম্বা, টান চেহারা, কোমরে বাঁ  হাত, ডান হাতের নিচে নামানো কিন্তু যেন আঙুল তুলে কথা বলে উঠবে এখনই, চুপ করতে বলবে সবাইকে, তারপর নিজের কথা বলবে। কালো চুল, দাড়ি , গোঁফ। মুকুট, গয়না গাঁটি  নেই, তবু রাজা রাজড়ার মতো লাগে। আমার চোখ ছবিতেই ছিল। মাসিমা  বললেন, " চেনো?"
- আমাদের দেশ গাঁয়ে এমন মানুষ তো দেখি না। শহরেও  না। সিনেমার কেউ?
মাসিমা বললেন, "ভালো করে দেখো, চোখ দেখো, চেনো তুমি। বুড়োবয়সের ছবি দেখেছ। "
আমি তার চোখের দিকে তাকালেও  সে মানুষের দৃষ্টি তো অন্যদিকে। মাথা নেড়ে বললাম- "চিনি না।"
-রবি ঠাকুরের ছবি। রবি ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
-সে তো বুড়ো মানুষের ছবি, একতলার ঘরেও সে ছবি আছে। জোয়ানবয়সে এই রকম ছিলেন?
-হ্যাঁ একটা নাটকের ছবি। নাচ আর নাটক।  বাল্মীকিপ্রতিভা।
-সেই বাল্মীকি মুনি? রামায়ণ লিখেছিলেন?
-ডাকাত ছিলেন প্রথমে। রত্নাকর।তারপর কবি হলেন  সে গল্প জানো তো?

প্রথম দিনেই মাসিমা গল্প শুরু করলেন, ক্যাসেট চালিয়ে গান শোনালেন। আমি কাজে লেগে গেলাম। প্রতিদিন সকালে মাসিমাকে চা দিতে এসে ছবিটার দিকে না তাকিয়ে পারি না।  এ'বাড়ির একমাত্র জোয়ান পুরুষ।
অবশ্য ঝন্টুদা আছে, তবে এ'বাড়িতে থাকে না আর জোয়ান না বুড়ো বোঝা যায় না। ঘরে বৌ ছেলে আছে- জানি। বেশি কথা বলে না তো। সকালে এসে বলে- "টুসি, চা দাও।"  ভাঙা ভাঙা খোনা গলা। টুসি শব্দটা একটু টেনে বলে, ফলে আমার নামটা কিছুক্ষণ রান্নাঘরের সামনে ভেসে থাকে -ফ্যানের রেগুলেটর বাড়ালে উড়ে যায়। ঝন্টুদাকে চা দি, রুটি দি। জামা খুলে কাজে লেগে যায় বাগানে - সার দেয়, মাটি খোঁড়ে, নতুন চারা বসায়,  বাগানের কলে হোসপাইপ লাগিয়ে জল দেয়, হাত পা ধোয়। লুঙ্গিতে হাত মুছে শার্ট পরে খোনা গলায় ডাক দেয়- 'বাজারের টাকা দাও। আজ ডিম আনব না মাছ? এঁচোড় দেখেছিলাম, আনব?" মাসিমার থেকে টাকা এনে ঝন্টুদার হাতে দিতে গিয়ে কোনো কোনোদিন এক মিনিটের জন্য এই বাড়িটায় আমার নিজের সংসার মনে হয়।
বাজার থেকে ফিরে বাড়ির টুকটাক কাজ করে, কখ্নও ঘাস কাটে, আগাছা তোলে; ভাত বসিয়ে আমি বাগানে এসে দাঁড়াই।
-কী টুসি, গরম লাগছে?
-না, ঠান্ডা
 ঝন্টুদা খোনা গলায় হাসতে থাকে । গেঞ্জির তলায় বুকের খাঁচার আদল বোঝা যায়। হাত মুছে বলে- টুসি, চা দেবে?
" বিস্কুট খাবে না মুড়ি মেখে দি?" বলে বাড়ির দিকে মুখ ফেরাতেই দেখি মাসিমা দোতলার জানলার গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে এদিকে তাকিয়ে আছেন।
-মাসিমা, আপনাকে চা দেব একবার?
মাসিমা উত্তর দেননা। সরে যান জানলা থেকে।
 
কাল থেকে  বাড়িটা অন্যরকম। কদিন আগেই মাসিমা বললেন, কয়েকজন বন্ধুকে আসতে বলবেন- গান বাজনা হবে দোলের দুদিন আগে।
- সামলাতে পারবে তো টুসি একা হাতে?
- খুব পারব। কী কী রান্না হবে বলুন।
-বিকেলে চায়ের সঙ্গে ফিশফ্রাই, ডিমের ডেভিল এই সব। পারবে?
-রাতে খেয়ে যেতে বলবেন। লুচি মাংস করে দেব। আর পায়েস, চাটনি।
-এত পারবে কী করে?
- পারব আমি। খুব মজা হবে । কোনোদিন তো কেউ আসে না।
-খুব একা লাগে তোমার টুসি?
" না না" টুক করে ছবির দিকে তাকিয়ে নিলাম। মাসিমা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর ছবিতে- "ঝন্টুকে একবার আসতে বলো।  কী কী আনতে হবে বলে দেব।"
-আমাকে বলে দিন। আমি ঝন্টুদাকে..
-তোমার অনেক কাজ টুসি। আমি বলে দেব ঝন্টুকে।

কত ফুল এনেছে ঝন্টুদা-  সাদা, হলুদ, গোলাপি। মালা এনেছে।  সারা রাত ফ্রিজে ছিল। আজ সকালে সাজানো হয়েছে সব। ঝন্টুদাই সাজিয়েছে-ফুলদানিতে, রেকাবিতে ফুল, সব ছবিতে মালা। গোটা বাড়ি ফুলের গন্ধে ভরে আছে। বিয়েবাড়ির মতো লাগছিল আমার। আনন্দ হচ্ছিল খুব, কান্নাও পাচ্ছিল। রান্না বসিয়ে দিলাম। ঝন্টুদা টুকটাক কাজ করছিল, বাজার যাচ্ছিল আসছিল- কোকাকোলা, মিষ্টি, কাগজের ন্যাপকিন। দোতলায় চেয়ার টেবিল সরিয়ে  ঘর মুছে রেখেছি রাতে। ঝন্টুদা সেখানে জাজিম পাতছিল -তার ওপর সাদা চাদরে, হারমোনিয়াম এনে  রাখছিল। মাসিমার গলা পাচ্ছিলাম- "এইরকম করলে হয় না ঝন্টু, ভাসটা আরেকটু সরাও- এই সব শুনতে পাচ্ছিলাম।" রোজ যদি এমন হত!

ঝন্টুদা রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়ালো –“টুসি, চা হবে?  না না থাক। আজ তো অনেক রান্না বান্না।“
- রান্না হয়ে গেছে তো।  চা দিচ্ছি। চেয়ারে বোসো না। পাখা ছেড়ে দি। মাংসটা একটু টেস্ট করে বলবে কী লাগবে?
- একেবারে দুপুরেই খাব। মাসিমা এখানেই স্নান করে খেয়ে যেতে বলেছেন। চারটে  বাজলেই সবাই চলে আসবেন।  তুমি একা সব পারবে না।
চারটে থেকেই সবাই আসতে শুরু করবেন- এরকমই জানি।  সেই মতো কাপ ডিস রেডি করছিলাম। চপ , ফিসফ্রাই গড়ে রেখেছি- লোকজন এসে গেলেই কড়াই বসাব। আজ  আমার  তাঁতের শাড়ি- আগের পুজোয় মাসিমারই দেওয়া। ঝ্ন্টুদার সাদা শার্ট;  প্লাস্টিকে করে এনেছিল-  কোঁচকানো  মোচকানো। ইস্ত্রি করে দিলাম।
 ঝন্টুদা উসখুস করছিল-" সোয়া চারটে বাজল কিন্তু, টুসি।"
-তো কী?  চারটে মানে কী আর চারটে না কি?

একতলার বসবার ঘরে ঘড়ির কাঁটা সরে সরে যাচ্ছিল- সাড়ে চার, পৌনে পাঁচ, পাঁচ। দোতলায় উঠলাম। ঝন্টুদা এলো সঙ্গে। মাসিমার হাতে মোবাইল, একবার কানে দিচ্ছেন, নামাচ্ছেন, আবার কানে দিচ্ছেন।
-মাসিমা, চারটেতেই বলেছিলেন তো?
-তাই তো বলেছি বারবার।
-পাঁচটা বেজে গেল। রাস্তা হারিয়ে ফেলেন নি তো?
-কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। সবার একসঙ্গে বড় ভ্যানে আসার কথা। ঠিকানা দেওয়া আছে, আর এখন তো গুগল ম্যাপেই... হারাবে কেন?
"একসঙ্গে আসবেন তো, তুলতে তুলতে এলে দেরি হয়" ঝন্টুদা বিজ্ঞের মতো বলল।
-ফোন ধরছে না কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না-
-হয়তো গাড়ি চালাচ্ছেন
-সে তো একজন। বাকিরা?
"টুসি, একটু চা করে মাসিমাকে দাও বরং, দুপুর থেকে কিছুই খান নি প্রায়" ঝন্টুদা বলল। মাসিমা ঝন্টুদার দিকে তাকালেন, রবিঠাকুরের ছবির দিকে তারপর। দু দিকে মাথা নাড়লেন। আবার মোবাইল কানে দিলেন।
নিচে নেমে ঝন্টুদাকে চা দিলাম, আমিও নিলাম। তারপর গড়া চপ, ফিসফ্রাই ফ্রিজে তুলে রাখতে দোতলায় এসে দেখি, মাসিমা এলিয়ে বসে, পায়ের কাছে মোবাইল, চোখে জল।
-কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?
চেঁচিয়ে ডাকলাম ঝন্টুদাকে।
-মাসিমা, ডাক্তারবাবুকে ফোন করি?
মাসিমা কেমন করে তাকালেন আমাদের দিকে - জল থেকে ডাঙায় তোলা মাছের চোখের মতো দৃষ্টি- " ওরা কেউ আসতে পারবে না। গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে।"
-ট্যাক্সি করে যদি বা উবের টুবের...
" বলল, সবার বয়স হয়েছে, শরীর খারাপ, অন্য কোনো ঝামেলা করে আসতে পারবে না । পথও অনেকখানি। সব আয়োজন নষ্ট হল"- মাসিমা ফুঁপিয়ে উঠলেন।
ঝন্টুদার চোখ ছলছল করছে দেখলাম। মাসিমার চেয়ারের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলল- " নষ্ট কেন হবে মাসিমা? এই তো আমরা আছি। "
" ফ্রিজে তুলে রাখছি সব, রোজ একটু একটু করে খাব" আমি বললাম।
"টুসি, মাসিমাকে চা দাও। আমি আসছি।"

কোথায় গিয়েছিল জানি না। ফিরে এল বাঁশি হাতে নিয়ে-" বাঁশি বাজিয়ে বাসন বিক্রি করতাম একসময়। বাঁশিটা রয়ে গেছে। বাজাই? তারপর আপনি গাইবেন। টুসি কবিতা বলবে। কী টুসি?"
-ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছি।  ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি পুরোটা বলতে পারব। না দেখে।
"আর দেখে? দাঁড়াও বই বের করি"- মাসিমা উঠে দাঁড়ালেন। 
 



কবে থেকে এভাবে চিঠি লিখছি তোমাকে ডায়রির পাতায়? নির্মলা সেই যে পত্রিকা বের করল কলেজে পড়ার সময়, একটা সংখ্যার বিষয় করল, 'প্রিয় পুরুষ', আর আমি লিখলাম তোমার কথা, তোমার এই চেহারার বর্ণনা দিয়ে লিখলাম, তখন থেকেই সম্ভবত। সমর ঠাট্টা করত, বলত অভ্যাস; বলত, শ্রী দুর্গা সহায় লিখে চিঠি শুরু করার মত নাকী ব্যাপারটা। এই ছবিটা সমরই এনে দিয়েছিল - " রত্নাকরের সঙ্গে আমিও রয়ে গেলাম ফ্রেমের মধ্যে। তোমার জীবনে যেই আসুক, এই ছবি থেকে যাবে, আমিও।" ফ্রেমেই রয়ে গেল। তোমার চোখে যেন ওর দৃষ্টি ,  ছবির খুব কাছে গিয়ে  দাঁড়ালে গা শিরশির করে। টুসি যখন তোমার ছবির দিকে তাকায়, ভাবি, ও কী আর কাউকে খুঁজে পায় তোমার চোখে?

ঝন্টু আর টুসিকে  দিয়ে কদিন বড় অশান্তিতে কেটেছে। লেখা হয় নি ডায়রিতে, কিন্তু  আজ এই সব লিখে রাখা জরুরী। খবরে আজকাল যা সব পড়ি, ভয় করে। মৃত্যুভয় নয়। বীভৎস মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছিলাম -ভয় হচ্ছিল মৃত্যুর ধরণ নিয়ে, ইদানিং ।  টুসি আর ঝন্টুকে একসঙ্গে কথা বলতে দেখলে ভয় করত আমার। প্রথমে এক বিন্দু ভয়, তারপর আরো এক বিন্দু- তারপর গোটা মন ছেয়ে গেল আশঙ্কায়। মনের কোথাও এক ফোঁটা স্বস্তিও যেন আর রইল না। এমনকি টুসির রান্না মুখে তুলতে ভয়  - হোম ডেলিভারিতে খাবার আনানোর কথাও ভেবেছিলাম। তারপর, নিতান্ত বোকার মতো ভাবলাম, আমি যে একা নই, কত বন্ধু আছে- যদি দেখানো যায়,  তাহলে হয়তো নিরাপদ থাকব...
কতখানি ভুল ভেবেছিলাম- আজ সন্ধ্যায় বুঝলাম। ঝন্টু চোখ বুজে বাঁশিতে  মেঠো সুর বাজাচ্ছিল। একের পর এক।  টুসি তাকিয়েছিল ঝন্টুর দিকে যেন এই প্রথম দেখছে।  আমি সবার সামনে হু হু করে কাঁদছিলাম,  যেন একটা  পরিবর্তন ঘটছিল আমার অভ্যন্তরে- যেনএতদিনের  উইঢিপি ভেঙে ভেঙে পড়ছে; সমস্ত অনুভূতিতে শাণ পড়ছিল আমার; ক্যাটারাক্ট সার্জারির পর যেমন সমস্ত কিছু অসম্ভব উজ্জ্বল দেখতাম-  টুসির চোখের জল দেখতে পাচ্ছিলাম, ঝন্টুর শ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। দেখছিলাম,  ফুলদানির ফুলের পাপড়ির রঙের আলাদা শেড, আলোয় ভরা ঘর, রঙীন পর্দা উড়ছে,  সুন্দর দুজন মানুষ আমার এত কাছে বসে ; মনে হচ্ছিল,  যেন অলীক কোনো নিরাময়  আমার দাঁতের গোড়ায়, হয়তো মাড়ির ফাঁকে জমে ছিল, এখন সমস্ত এক সঙ্গে রক্তে মিশছে,  তারপর চেতনায়- যেন চোখের জলে ধুয়ে গিয়েছে সব , যেন সদ্য জন্মে মানুষ এভাবেই জগৎ দেখে।
মোবাইল বাজছিল। ফিরেও তাকাইনি।  টুসিকে ক্যাসেট চালাতে বলেছিলাম- আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে। প্রতিটি লাইনের অর্থ নতুন করে আবিষ্কার করছিলাম। গানে কোথায় সূক্ষ্মকাজ, কোথায় মুড়কি কে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল গোটা পৃথিবীর চলার শব্দ লুপ্ত হয়েছে- রয়েছে শুধু এই বাঁশি, এই গান- তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায় রাখবে কোথায় ঢেকে...

ওরা একতলায় চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ঝন্টু সাইকেল বের করল- আওয়াজ পেলাম। টুসি দরজায় খিল তুলছে, তালা দিচ্ছে- শুয়ে পড়বে এবার। কাল আবার সকাল হবে। অন্য একটা দিন। আবার যদি আতঙ্ক ফেরৎ আসে? আবার সব ঘোলাটে হয়ে যায়?  বরং, ঠিক এইখানে, এই মুহূর্তেই থেমে থাকি না হয় । কিছু তো চাইবার নেই আর । কোনো লোভ নেই। আকাঙ্খা নেই কোনো । সুন্দরে সুন্দরে ভরে গিয়েছি। 
ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপ আছে। যথেষ্ট। চুল আঁচড়ে শুয়ে পড়ব তারপর।
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
 
[ প্রথম প্রকাশ ঃ কৃত্তিবাস, প্রতিভাস , ২০২৩] 

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস