কুয়াশাদিনের ভালো মন্দ
আজকের সন্ধ্যেটা আগাগোড়া অন্যরকম- বিকেলের পরে এত কুয়াশা কখনও দেখি নি, সূর্য ডুবতেই পাহাড়ের দিক থেকে কুয়াশা নেমেছে হাতীর পালের মতো, তারপর এই রাস্তাঘাট, দোকান বাজার ঘরদোর ছেয়ে ফেলেছে। বাড়ি থেকে বেরোলেই ঘন কুয়াশা জড়িয়ে যাচ্ছিল শরীরে, গুটিপোকার মত মানুষজন ঘোলাটে পথঘাটে হাঁটছিল, কথা বলছিল ঈষৎ জোরে যেন এই বিকেলে কথাদের হারিয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। জোলো বাতাসে কুয়াশার ঘেরাটোপকে আমার বাপের বাড়ির মশারির মতো লাগছিল, এই পথঘাট ফলত স্বপ্নের এবং অবাস্তব - মানুষজন যেন জোব্বা পরা মরুবাসী অথবা মেরুপ্রদেশের; কুয়াশার সর ক্রমশ এমন ঘন আর রহস্যময় হয়ে উঠছিল যে চেনা পাড়াকে অজানা দ্বীপ বোধ হচ্ছিল - কুয়াশা ফুঁড়ে যে কোনো মুহূর্তেই বেরিয়ে আসতে পারে প্রকাণ্ড কাছিম অথবা ক্ষুদে পেঙ্গুইনের দল, অ্যালবাট্রসের পাখার ঝাপট লাগতে পারে গায়ে।
সুজান আর বিলের বাড়ির অভ্যন্তর পর্দাটানা- কুয়াশার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না তবে জলীয় বাষ্পের আধিক্য বোঝা যাচ্ছিল - গোটা হলঘর, ল্যান্ডিং এ যত কাচের তলে - জানালার , দরজার অথবা শোকেসের পাল্লার উপরিভাগে জলকণা জমছিল । আমার চোখের সামনে বিন্দু বিন্দু জলকণা একে অন্যের শরীরে লেগে যাচ্ছিল, তারপর গড়িয়ে নামছিল। রান্নাঘরের মস্ত ডেকচিতে বগবগ করে সুরুয়া ফুটছে, আভেনে আলু আর কুমড়োর বড় চৌকো টুকরোতে অলিভ অয়েল মাখিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে সুজান আর ঘেরা বারান্দায়, ঘন কুয়াশার ব্যাকড্রপে মশলা মাখানো মুরগীর বুক আর পা ঝলসাচ্ছে বিল, পিটার, গ্রাহাম আর শান্তনু। হাতে হাতে বিয়ারের বোতল। পুরুষ আর মেয়েদের দুটো দল হয়ে গিয়েছিল - ঘর আর বারান্দার তাপমাত্রার তারতম্যের কারণেই এমন ঘটছিল বলে আমার ধারণা। রান্নাঘরের সামনে চেয়ার টেনে আমরা - সুজান, গ্রাহামের মা ক্যাথি, আর মার্থা, এ পাড়ার সব থেকে পুরোনো বাসিন্দা। আগামী সপ্তাহে মার্থা অন্য শহরতলিতে মেয়ের কাছে চলে যাবে- আজকের জমায়েত তারই জন্য; বিল আর সুজান নিজেদের বাড়িতে সব ব্যবস্থা করেছিল। খুব বেশি লোকজনের উপস্থিতি মার্থা চায় নি -হয়তো, নিজের এপাড়ায় ফিরে আসার সম্ভাবনা আর জীবনের বাকি দিনের একটা হিসেব কষা চলছিল তার নিজের মনেই; ফিরে আসার ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা জিতে যাচ্ছিল যখন, খুব সম্ভব তখনই বিল ওর কাছে এই আসরের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল।
বিল-সুজানের বসবার ঘরে মার্থাকে ঘিরে আমরা বসে, সুজান তার চেয়ার ছেড়ে মাঝে মাঝেই রান্নাঘরে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে - এই হয়তো ডেকচিতে দু চামচ মাখন ফেলল, কিম্বা গ্যাসের আঁচ ঢিমে করে দিল অথবা আভেনের দরজা খুলল, বন্ধ করল; যতবার সে চেয়ার ছেড়ে উঠছিল, ততবারই মার্থার পিঠে হাত রেখে আলতো ভর দিচ্ছিল যেন এই শেষবারের মতো মার্থাকে স্পর্শ করছে, যেন সুরুয়ায় নুন গোলমরিচ দিয়ে ফিরে এসে আর মার্থাকে দেখতে পাবে না। ক্যাথি অকারণেই পরলোকগত স্বামীর কথা বলে চলছিল অনর্গল যেন কেউ শুনুক কি নাই শুনুক তার কিচ্ছু এসে যায় না; নিজের হাতে হাত ঘষছিল আর আমার দিকে ফিরে বলছিল- "ভয় পাচ্ছো না তো? তোমার এখনও অনেক দেরি আছে। "
-বাচ্চা মেয়েটাকে এই সব কথা নাই বা শোনালে। বরং তোমার সিয়ান্সের গল্প বলো।
"আমি আসলে গ্রাহামের বাবাকে খুব ভালোবাসতাম, কিছু মনে কোরো না" - রুমালে চোখ মুছে ওয়াইনে চুমুক দিয়েছিল ক্যাথি।
- মনে করার কী আছে। সিয়ান্সের গল্পটা বলুন-
- গল্প নেই। নদী পেরিয়ে প্রথম রাউন্ড অ্যাবাউটে একজিট নিলেই বাগানওলা ছোটো বাড়ি- প্রতি শনিবার ওখানে প্ল্যানচেট হয়। মার্থাকে বলেছিলাম , একসঙ্গে যাই চলো, স্বামীদের খোঁজখবর নিয়ে আসি। মার্থা রাজিই হল না।
-পয়সা খরচ করে মৃত স্বামীদের দেখতে যাওয়ার কী অর্থ আমি তো বুঝি না। অ্যালবাম ওল্টালেই তো দেখা যায়। কিম্বা স্বপ্নে।
ক্যাথি ঠক করে গ্লাস রেখে উঠে দাঁড়ালো- " বাথরুমে যাবো।" মার্থা আমাদের দিকে ফিরে চোখ টিপলো ক্যাথির অলক্ষ্যে। ফিক করে হাসল।
বিলের দুটি কুকুর বারান্দা আর ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ক্লান্ত হলে চক চক করে জল খাচ্ছিল পেল্লায় পাত্র থেকে, তারপর আমাদের হাত চেটে দিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ছিল মেঝেতে। সুজান বলছিল, ওদের চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। মার্থা কথাটা লুফে নিয়ে বলেছিল- বয়স কত হল যেন?
-লিলির এগারো আর এই মার্চে মলির বারো হবে।
-আমার চাইতেও বুড়ো তবে।
পুরুষের দল ঝলসানো মাংসের গন্ধ সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল হই হই করে। বিল চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে দুহাতে মার্থার গলায় বেড় দিয়ে বলল- "ডোন্ট গো।"
-বাচ্চা মেয়েটাকে এই সব কথা নাই বা শোনালে। বরং তোমার সিয়ান্সের গল্প বলো।
"আমি আসলে গ্রাহামের বাবাকে খুব ভালোবাসতাম, কিছু মনে কোরো না" - রুমালে চোখ মুছে ওয়াইনে চুমুক দিয়েছিল ক্যাথি।
- মনে করার কী আছে। সিয়ান্সের গল্পটা বলুন-
- গল্প নেই। নদী পেরিয়ে প্রথম রাউন্ড অ্যাবাউটে একজিট নিলেই বাগানওলা ছোটো বাড়ি- প্রতি শনিবার ওখানে প্ল্যানচেট হয়। মার্থাকে বলেছিলাম , একসঙ্গে যাই চলো, স্বামীদের খোঁজখবর নিয়ে আসি। মার্থা রাজিই হল না।
-পয়সা খরচ করে মৃত স্বামীদের দেখতে যাওয়ার কী অর্থ আমি তো বুঝি না। অ্যালবাম ওল্টালেই তো দেখা যায়। কিম্বা স্বপ্নে।
ক্যাথি ঠক করে গ্লাস রেখে উঠে দাঁড়ালো- " বাথরুমে যাবো।" মার্থা আমাদের দিকে ফিরে চোখ টিপলো ক্যাথির অলক্ষ্যে। ফিক করে হাসল।
বিলের দুটি কুকুর বারান্দা আর ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ক্লান্ত হলে চক চক করে জল খাচ্ছিল পেল্লায় পাত্র থেকে, তারপর আমাদের হাত চেটে দিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ছিল মেঝেতে। সুজান বলছিল, ওদের চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। মার্থা কথাটা লুফে নিয়ে বলেছিল- বয়স কত হল যেন?
-লিলির এগারো আর এই মার্চে মলির বারো হবে।
-আমার চাইতেও বুড়ো তবে।
পুরুষের দল ঝলসানো মাংসের গন্ধ সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল হই হই করে। বিল চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে দুহাতে মার্থার গলায় বেড় দিয়ে বলল- "ডোন্ট গো।"
আজ সন্ধ্যার এই সব দৃশ্য, বাক্য, তাপমাত্রা - সব কিছুতে যেন মৃত্যুর অনুষঙ্গ জড়িয়ে ছিল-অথচ তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছিল না। বস্তুত আজ সময়ের গতিও যেন বড় দ্রুত, এই এলাম বিলের বাড়ি - এই তো একটু আগেই, এর মধ্যেই খাওয়ার সময় হয়ে গেল আর খাওয়া হয়ে গেলেই কফি, ডেজার্ট, তারপরেই বাড়ি ফেরার পালা। দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছিল যেন সেকন্ডে ষাটের বেশি দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে এই ঘরে, যেন এতই দ্রুত সময়ের চলন যে এই সন্ধ্যাটুকু পেরোলেই আমরা সবাই ভয়ঙ্কর বুড়ো হয়ে যাবো। এই সব শব্দ দৃশ্য ধ্বনি, ভালো করে বুঝে নেওয়ার আগেই , সার দেওয়া পিঁপড়ের মতো চোখ বেয়ে বেয়ে মাথার পিছনে চলে যাচ্ছিল, সম্ভবত স্মৃতিতে। টাটকা স্মৃতি ঈষৎ পুরোনোকে ঢেকে দিচ্ছিল। মৃত্যুপরবর্তী অথবা যে কোনো বিদায়ের পরে মানুষ যেহেতু স্মৃতিতে বাঁচে , বিল সবাইকে বলেছিল কিছু বলার জন্য- মার্থাকে এই আমরা কীভাবে মনে রাখব। যদিও এ’পাড়ায় আমাদের বাস এক বছরের, আমারও কিছু বলার ছিল; এই সার দেওয়া পিঁপড়েদের ভয় পেয়ে মাথার ভিতর থেকে মার্থার কথা খুবলে নিয়ে হাতে করে বসলাম। কী বলব , কী বলা উচিৎ- এই নিয়ে সংশয়ে ভুগছিলাম।
মার্থার বাড়ি আমাদের এই নতুন বাড়ির কোণাকুনি। এখানে আসার প্রথমদিন মুভার্স অ্যান্ড প্যাকার্সের লোকজন আসবাব নামাচ্ছিল ভ্যান থেকে, সাবধানে বাড়িতে ঢোকাচ্ছিল টেবিল, চেয়ার, সোফা, রেফ্রিজারেটর, আলমারি আর টিভি, শান্তনু হাতা গুটিয়ে কাজ করছিল সঙ্গে। আমি টুকটাক মালপত্র ঘরে ঢোকালাম, তারপর একটা দুটো বাক্স আনপ্যাক করে মনে হল, আজ যখন রবিবার, আগে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ করে আসি, গোছগাছ পরে হবে না হয়। মার্থার সঙ্গে দেখা হয় নি সেদিন। ঘন্টি বাজিয়ে বাজিয়ে ফিরে এসেছিলাম। ওর ডোরবেল খারাপ হয়ে গিয়েছে বহুদিন- বিল বলেছিল পরে; বলেছিল, বেলের আওয়াজ শুনতে পায় না, তাই খারাপ হওয়ার পরে আর সারায় নি।
- ওর বাড়িতে কেউ আসেন না তার মানে-
-খানিকটা ঠিক, ওর মেয়ে জামাইয়ের কাছে চাবি আছে, ওরা নিজেরাই দরজা খুলে ঢোকে আর এমনিতে মার্থাই সবার বাড়ি যায়, আর ভেবে নেয়, এ পাড়ার সব কলিং বেলই খারাপ হয়ে গেছে- টের পাবে শিগ্গিরি।
টের পেতে সময় লেগেছিল একমাস। এক রবিবার সবে চা খাচ্ছি সকালের- দরজায় দমাদম ধাক্কা। দরজা খুলতেই মার্থা, রুপোলি চুল, নীল সোয়েটারের ওপর একছড়া মুক্তোর মালা, একগাল হাসি, হাতে ছোটো টবে চারাগাছ।
-আরে আসুন আসুন
-এই নাও, তোমার জন্য আনলাম, বড়ো টবে পুঁতে দাও এখনই। কী গাছ বলো তো?
একচিলতে সরু গাছ, লম্বাটে পাতা নুইয়ে আছে- কী গাছ?
- তেজপাতা গো তেজপাতা। রান্নায় ব্যবহার করো তো?
- ওমা এই তেজপাতা! বুঝতেই পারি নি
- চারা দেখেই কী আর বোঝা যায়, অভিজ্ঞতা লাগে। চোখের দৃষ্টি লাগে।
ফুলপ্যান্ট গলিয়ে শান্তনু নেমে আসে এই সময়- "কফি করি?" মার্থা জমিয়ে বসে- " বিলদের সঙ্গে আলাপ হল?"
-হ্যাঁ। খুবই পরোপকারী। আমাদের রান্নাঘরের ট্যাপ লীক করছিল, এদিকে কাউকেই চিনি না। উনি এসে নিজে ঠিক করলেন, প্লাম্বার ডাকতেই দিলেন না। সব রকম কাজ জানেন।
- সব রকম কাজের ট্রেনিং ওদের নিতেই হয়-
-নিতেই হয় মানে?
- মানে ও এম আই ফাইভে আছে। এখানে আন্ডারকাভারে।
-বলেন কি?
মার্থা মিটিমিটি হাসে, মাথা দোলায় –“ গ্রাহামের মা র সঙ্গে আলাপ হয়েছে?”
-উনিও এম আই ফাইভে নাকি?
- না না উল্টোটাই বরং। ওর হাজব্যান্ড পুলিশ এনকাউন্টারে মারা যায় জানো? খুব স্যাড।
-সে কি ! পুলিশ মারল কেন?
" অনেক কথা শোনা যায়। সে সব এখন আর নাই বললাম"- এক চুমুক কফি খেয়ে গলা নামায় মার্থা- "এ পাড়ার অনেক গল্প। সব বলব একে একে। আসলে, পাড়াটাই একটু অন্যরকম। জানো, এ অঞ্চলে অনেক লুকোনো কবর আছে? সব কনভিক্টের কবর।
- কনভিক্টের কবর?
" লুকোনো আছে সব। অনেকের বাড়ির নিচেই রয়েছে। তারা জানেই না। বোকাসোকা লোকজন খোঁজখবর না নিয়েই বাড়ি কেনে। আসলে আমার ঠাকুদার ছিল নার্সারির ব্যবসা। আমি আর ক্লিফ বিয়েতে যৌতুক পাই ঐ নার্সারি। এই এখানেই ছিল, তোমাদের আমাজন টামাজন এসে সব উঠে গেল। যা বলছিলাম, ঐ নার্সারির কাজে অনেক ঘুরে বেড়াতাম- তখনই লুকোনো সমাধির হদিশ পেতে থাকি। একদিন না হয় তোমাদের নিয়ে বেরোবো। কবর দেখাবো। অবশ্যই তোমাদের উৎসাহ থাকলে।"
আমি শান্তনুর দিকে তাকাই। মার্থা চলে যেতেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি- "এই যে বললে খোঁজ খবর নিয়েছ? ভালো নেবারহুড না কি। এই তার নমুনা!"
-মার্থা বলে গেল বলেই খারাপ হয়ে গেল সব? তুমি নিজে খারাপটা কী দেখলে এই ক’দিনে?
- দেখি নি। কিন্তু দেখতে কতক্ষণ!
-যত্ত! আমি বিলের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলব।
-কী কথা বলবে? বলবে, আপনি সিক্রেট সার্ভিসে আছেন দাদা? একদম ওসব করতে যেও না। বরং অন্য পাড়ায় বাড়ি খুঁজি-
" এই এলাম, এর মধ্যেই আবার বাড়ি খুঁজব! তুমি খোঁজো," দমাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো শান্তনু।
গা সওয়া হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। আসলে, ব্যস্ততা -পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময়ের অভাব। বুঝতে পারছিলাম, মার্থার কথাগুলো সম্ভবত ঠিক নয়। যত অদ্ভুত পেশার লোক জড়ো হয়েছে এই জনপদে - এ কখনও হয়! নেট সার্চ করেও কনভিক্টের কবর বাবদ কোনো তথ্যই পেলাম না। তবু, রবিবার হলেই অস্বস্তি শুরু হত। ছুটির দিনে খুব যে কিছু করার থাকে তাও নয়। দুজনেই অসম্ভব ঘরকুনে, ঘরের কাজ সেরে সোফায় বসে সিনেমা , ন্যাট জিও কিম্বা পেপারব্যাক, প্রেম আর ঘুম। লেখার টেবিলে বসে খুচখাচ লেখা কদাচিৎ - এসবের জন্য মানসিক স্বস্তির প্রয়োজন থাকে। অ্যাভয়েড করতে শুরু করলাম মার্থাকে।" লাঞ্চের নিমন্ত্রণ আছে কিম্বা শপিংয়ে যাবো- এক্ষুণি বেরিয়ে যাবো'' বলে দরজা থেকেই বিদায় করতাম বুড়িকে।
মার্থা দাঁড়িয়ে থাকত কিছুক্ষণ তারপর বলত- " খুব পপুলার তোমরা, কতলোক ডেকে ডেকে লাঞ্চ খাওয়ায়-"
আমি ঘাবড়ে যেতাম- তবে কি আমার গুলতাপ্পি ধরে ফেলল?
- ডেকে ডেকে খাওয়ায় তা নয়, এই ধরো পিসতুতো ভাই এসেছে, এখানে সেটল করবে, ওর বাড়িঘর গুছিয়ে দেবো, মানে হেল্প করব আর কি, তারপর একসঙ্গে খাবো দুপুরে। আর গত সপ্তাহে তো শান্তনুর কোলীগের জন্মদিন ছিল..
"এনজয়, এই তো বয়স" - মার্থা খুরখুরিয়ে ফিরে যেত।
শান্তনু বলত, "একলা মানুষ, দুটো কথা বলার জন্য ছটফট করে, চল্লিশ বছর পরে তুমি, আমিও তাই করব। আসুন না, আধ ঘন্টা, এক ঘন্টার তো মামলা।" চল্লিশ বছর পরের জীবন আমার কাছে ধরা দেয় না- আমি শুধুই রবিবারের সকালের নষ্ট হয়ে যাওয়া দেখি, বিরক্ত হই, শান্তনুর ওপর রাগ করি।
মাস দেড়েক আগে, রাতে খুব হইচই- মার্থার বাড়ির দিক থেকে চেঁচামেঁচি, অ্যাম্বুলেন্সের হুটার- রাস্তায় বেরিয়ে দেখি ওর বাড়ির সামনে ছোটো জটলা, বিল, গ্রাহাম, পিটার, মার্থার মেয়ে জামাই, বড় নাতি আর বাড়ির বারান্দায় একটা চেয়ারে হাসিহাসি মুখে মার্থা বসে- প্যারামেডিক মেয়েটি প্রেশার মাপছে।
" সপ্তাহের বাজার দিতে এসেছিলাম, দরজা খুলে দেখি মা বাথরুমের সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান এলো অবশ্য। প্যারামেডিকও খুব তাড়াতাড়ি এসেছে।"
" আরে কিছুই হয় নি আমার- ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তোর বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম , জানিস?"
" হুঁ! যত্তসব" মেয়ে বিড়বিড় করে-
যদিও সে রাতে প্যারামেডিক সব প্যারামিটার নরমাল পায়, দু সপ্তাহের মাথায় একই ঘটনা। এ ক্ষেত্রে মার্থা জ্ঞান ফিরে নিজেই এমার্জেন্সিতে ফোন করে- কপালে স্টিচ পড়ে এবার, প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করছে দেখা যায়। মার্থার মেয়ে মা কে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এরপর-
আমার হাতের খোবলানো স্মৃতিতে এটুকুই ধরা -আজকের সন্ধ্যায় এই - ই বলব?
ডাইনিং টেবিল ঘিরে গল্পগুজব খাওয়াদাওয়া জমে উঠেছিল। সুজান রান্নাঘর থেকে সুরুয়া, সব্জি সেদ্ধ, ল্যাম্ব রোস্ট এনে টেবিলে রাখছিল, ঢাকনা খুলে দিচ্ছিল একের পর এক- প্রতিটি পদে ব্যবহৃত মশলাপাতি অনুযায়ী ঘরের মধ্যে গন্ধের পরিবর্তন ঘটছিল দ্রুত। কুকুরদুটি তন্দ্রা ভেঙে টেবিলের তলায় গুঁতিয়ে ঢুকছিল, বেরোচ্ছিল, গন্ধের তারতম্য একটা স্থিতাবস্থায় এলে, তারা জিভ বের করে আমাদের চেয়ারের পাশে বসে ল্যাজ নাড়তে লাগল। মার্থা একটুকরো ঝলসানো মুরগী কাঁটায় গেঁথে পুরোদিনের গল্প শুরু করে দিল- সেই ঠাকুরদার নার্সারি, ফুল, চারাগাছের ব্যবসা, এই অঞ্চলের ফুল, লতা পাতা কীটপতঙ্গের কথা। পিটার আর গ্রাহামকে হাই তুলতে দেখছিলাম। শান্তনু সামান্য উশখুশ করছিল- রাতের দিকে একটা কল নিতে হবে- ঘড়ি দেখল দুবার। বিল ওয়াইনের গ্লাসে টুংটুং শব্দ করল- "রাত হয়ে যাচ্ছে, এবারে যে উদ্দেশ্যে আজকের জমায়েত, তাই নিয়ে কথা হোক- মার্থা সম্পর্কে এক এক করে বলি সবাই। আমিই শুরু করি। বলাই বাহুল্য, মার্থাকে খুব মিস করব আমরা। কত পুরোনো বাসিন্দাই তো চলে যায়, নতুন প্রতিবেশী আসে, কিন্তু এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম। আসলে , মার্থা আমাদের সবাইকে একটা অন্য আইডেন্টিটি দিয়েছিল, আমার এম আই ফাইভ কানেকশনের কথা তো সবাই জেনেই গেছ"। সবাই হেসে উঠতে বিল বলল," এই তো বোরিং জীবন, অফিস আর বাড়ি, মাঝে মাঝে ভাবি- জেমস বন্ডের মতো জীবন হলে মন্দ হত না"।
- আর সুজান যে আমার মতো অকালে স্বামীহারা হত, সেই বেলা? সরি, মাই অ্যাপোলোজিস , আসলে আমি গ্রাহামের বাবাকে বড্ড ভালোবাসতাম। আর মার্থার কথা কী আর বলব! আমার সঙ্গে সিয়ান্সে যায় নি বটে কিন্তু ঐ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড- গ্রাহামের বাবা চলে যাওয়ার পরে আমার জন্য এত করেছিল- নিজের ছেলে মেয়েও এমন করে নি।
এরপর গ্রাহাম, তারপর পিটার। মামুলি কথা- উই অল লাভ মার্থা, উইল মিস হার - এই সব। সুজান বলছিল, " শুধু আমাদের নয়, আমাদের পাড়াকেও মার্থা অন্য আইডেন্টিটি দিয়েছিল। কবরের গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ায় , এক সময়ে ছুটির দিনে, হুজুগে লোকজন ভিড় করত; কাছের জঙ্গলে , নদীর পাড়ে কনভিক্টের কবর খুঁজত, আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করত হরেকরকম"। হেসে উঠে জল খেলো সুজান।
বিল এবারে শান্তনুর দিকে ঘুরতেই, ও আমার দিকে ইশারা করল- " ও ই বলবে, আমাদের দুজনের তরফে।" আমি গলা খাঁকরে উঠে দাঁড়ালাম, " মার্থার সঙ্গে আমার পরিচয় অল্পদিনের। নিজের কথা খুব কম বলে মার্থা- এই যে ওর পারিবারিক নার্সারির ব্যবসার কথা বলল, সেই ব্যবসার সূত্রে মার্থা আর ক্লিফ দেশে বিদেশে ঘুরে বেরিয়েছে- সে কথা বলি আজ। রাত হয়েছে, সব বলা যাবে না, আমি জানিও না সব। বরং উটের পিঠে করে মার্থার গোবি মরুভূমি পার হওয়ার কথা বলি?"
দেখলাম, বিলের চোখ বিস্ফারিত, শান্তনু হাঁ হয়ে গিয়েছে, মার্থার হাত থেকে টুং করে চামচ পড়ল প্লেটে।
- মার্থা আর ক্লিফ উটের পিঠে গোবি মরুভূমির প্রায় অর্ধেক চষে ফেলেছিল- কু শেন, টান্না আর হেয়ার উইডের খোঁজে।
- নামই শুনি নি।
-আমিও না, মার্থার থেকে জেনেছি। হেয়ার উইড মরুঝড়ের সময় বালির উড়ে যাওয়া আটকায়, টান্না আসলে এক রকম বুনো পেঁয়াজ- অথচ তাতে হ্যাজেলনাটের গন্ধ। তবে সব থেকে ইন্টারেস্টিং কু শেন- সকল রোগের মহৌষধ। প্যানাসিয়া। ক্যানসারও সারে।
" এক ফোঁটা পেলে গ্রাহামের বাবা বেঁচে যেত! ও মাই গড" ক্যাথি হাঁউমাউ করে উঠল।
-পাবেন কী করে? মার্থারা তো আনতে পারে নি।
- খুঁজে পায় নি?
আমি মার্থার দিকে তাকালাম- তার নীল চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল টলটল করছে-
- পেয়েছিল। উটের পিঠে ফিরতি পথ ধরে মরুভূমি পার হচ্ছিল ওরা - মার্থা, ক্লিফ আর গাইড। সাঙ্ঘাতিক মরুঝড় ওঠে। ওরা উট থামিয়ে উটের আড়ালে বসে। ঝড় উত্তরোত্তর বাড়ছিল। বালিতে বালিতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল, ওরা, উটসমেত। গাইড চেঁচিয়ে বলে ঐ হেয়ার উইড বালিতে ছুঁড়ে দিতে। মার্থা চায় নি। কত কষ্টে যোগাড় করেছে। গাইড কাকুতি মিনতি করায় ছুঁড়ে দেয়- অমনি...
-কী?
- মুহূর্তে বালি জুড়ে হেয়ারউইড গজিয়ে যায় , বিরাট জালের মতো আটকে দেয় বালি।
-তারপর?
-পরের রাতে একটা বুনো কুকুরের দল ওদের তাড়া করে, তাই না মার্থা?
মার্থা মৃদু হাসে। ওর চোখ উজ্জ্বল দেখায়। মাথা নাড়ে সম্মতিতে।
-গাইড বলে, দাঁতে কেটে সব কটা টান্না ছুঁড়ে দিতে। তাই করতে হয়, উপায় ছিল না। এক আশ্চর্য গন্ধে ভরে যায় মরুভূমি- মাটি মেশানো চকলেটের গন্ধ যেন- খুব তীব্র আর আকর্ষক। কুকুররা থমকে যায়।
-আর প্যানাসিয়া? মানে ঐ কু শেন
এবার মার্থা কথা বলে - "হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল ক্লিফের- ঐ কুকুরের ঘটনার ঠিক পরেই। কু শেন কাজে লেগে যায়।"
সবাই খুব চুপচাপ হয়ে যায় এরপর- কাহিনীর সত্যাসত্য বিচারে অথবা ভেলভেট কেকে মনোনিবেশ হেতু। কুকুরদুটি ঘুমিয়ে পড়ে, ক্যাথি মৃত স্বামীর ক্রীম চীজ প্রীতির কথা বলে বার দুয়েক নাক টানে। আমরা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াই- গুড নাইট বলি।
স্ট্রীটলাইটের মাথায় ফেয়ারি ফ্লসের মতো ঘন নীল কুয়াশা গোল গোল পাক খাচ্ছিল। আমরা বিলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিলাম এক এক করে। মার্থা বাথরুমে গিয়েছে , বেরোতে দেরি হচ্ছিল-
বিল একটা সিগারেট ধরায়, ধোঁয়া ছাড়ে-" তোমার সম্বন্ধে কী বলেছে মার্থা, জানতে চাও না?"
- আমার সম্বন্ধে?
- অবভিয়াসলি। আমি যেমন সিক্রেট এজেন্ট, গ্রাহামের বাবা যেমন গ্যাংস্টার-
-কী বলেছে?
-অফিসে কেরানিগিরি করো বটে, আদতে তুমি একজন লেখক। বিরাট কিছু লিখছ। ম্যাগনাম ওপাস। নিরিবিলির জন্য আমাদের এই পাড়ায় বাড়ি নিয়েছ-
শান্তনু আমার দিকে তাকায় আর চশমা খুলে মুছতে থাকে- পরকলায় ঘনীভবন খুব সম্ভব। মার্থা সুজানের সঙ্গে বেরিয়ে এলে বিল ওর হাত ধরে - " তোমার মেয়েকে বড্ড হিংসে হচ্ছে, এবার ওদের পাড়া বদলে দেবে পুরো। কিন্তু আমাদের কী হবে?" মার্থা হাসে, বিলের হাতে মৃদু চাপড় দেয়। তারপর এই আশ্চর্য কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলে, "হোয়েন মেমরি ইজ ইরেজড, হোয়েন দেয়ার ইজ নাথিং টু রিমেমবার একসেপ্ট দ্য স্টোরিজ; স্টোরিজ আর ফর ইটারনিটি। এ'পাড়ায় গল্পের অভাব হবে না।" আমার দু গালে চুমু দেয় মার্থা।
ফগলাইট জ্বালিয়ে গাড়িগুলি যায় আসে , সেই সব নীলচে আলোয় আমরা রাস্তা পার হতে থাকি।
[প্রথম প্রকাশ ঃ কৃত্তিবাস, ২০২৩]
Comments
Post a Comment