আখ্যানে বারুদ ও অস্থির সময়

 শ্রী তপনকর ভট্টাচার্যের গল্পগুলি পড়ে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের কথা মনে হয়েছিল - বাস্তবের প্রতিলিপির বদলে শিল্পীর নিজস্ব অনুভূতি পরিস্ফুট হত ছবিতে - সরল দেহাবয়ব, রং এবং বিশেষ ব্রাশস্ট্রোকে। মনে হয়েছিল হিন্টারল্যান্ড সিনেমার কথাও যেখানে ছবির স্বাভাবিক মাত্রাকে টেনে প্যানোরামিক ওয়াইড স্ক্রীনের মাপে করে দেওয়ায়, তদুপরি ডাচ টিল্টের ব্যবহারে গোটা পটভূমিই তমসাচ্ছন্ন আর অস্বস্তিকর, রাস্তার বাঁকে বাঁকে উঁকি দিচ্ছিল ভয়ংকর হিংস্রতা ও পাপ। বস্তুত, যাবতীয় সরলরেখা বেঁকে যাচ্ছিল, অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছিল, ফলত অস্থিরতা।


তপনকরের আখ্যানের ব্যাকড্রপে এই রকম অলীক অসামঞ্জস্য;  এক ধরণের অস্থিরতা ধোঁয়ার মত ছড়িয়ে যায় গল্পে - অস্থির সময়ের বারুদ জমা হতে হতে বুলেট ছুটে বেরোয়। দৃষ্টিকোণের তারতম্যে ছিটকে বেরোনো আগুনকে স্বর্ণকমল বোধ হয় কখনও। 

তপনকরের অধিকাংশ গল্পে পিস্তল থাকছে, কিম্বা চাকু, ফলত রক্ত। অবশ্যম্ভাবী। অথবা কখনও গল্পের শুরুতেই মৃতদেহ পড়ে থাকছে, আর গোটা গল্প জুড়ে পিস্তলের খোঁজ চলছে, উঠে আসছে জীবনের চোরাগলি, কানা গলির কথা, গল্পের শেষ অশরীরী নাচে, যেখানে আখ্যানের এযাবৎ স্বাভাবিক মাত্রা প্যানোরামিক ওয়াইড স্ক্রীনে বদলে যাচ্ছে যেন নিয়তি। বারুদ পুড়ে পুড়ে উচ্চ চাপের যে গ্যাস তৈরি হয়, বুলেটকে ছুটে বেরোতেই হয়। তপনকরের গল্পে পিস্তল ছোঁড়ার বিজ্ঞান রূপকের কাজ করে আগাগোড়া। এই কবিতাটি মনে আসে -

 "Bringing a gun into a house
changes it.
You lay it on the kitchen table,
stretched out like something dead
itself: the grainy polished wood stock
jutting over the edge,
the long metal barrel
casting a grey shadow
on the green-checked cloth.
At first it’s just practice:
perforating tins
dangling on orange string
from trees in the garden.
Then a rabbit shot
clean through the head.
Soon the fridge fills with creatures
that have run and flown.
Your hands reek of gun oil
and entrails. You trample
fur and feathers. There’s a spring
in your step; your eyes gleam
like when sex was fresh.
A gun brings a house alive.
I join in the cooking: jointing
and slicing, stirring and tasting –
excited as if the King of Death
had arrived to feast, stalking
out of winter woods,
his black mouth
sprouting golden crocuses."

[The Gun,Vicki Feaver]

তপনকরের গদ্যের ধরণে, আখ্যানের নির্মাণে শ্রী কমল চক্রবর্তী উঁকি দেন কোথাও - অন্তত এই পাঠকের কাছে। ছোটো ভাঙা বাক্য, সংক্ষিপ্ত সময়ের টুকরোকে ঘিরে গল্প ঘুরপাক খায়। ঘটনার বিবরণে তাকে স্বপ্ন মনে হয়, অলীক লাগে। আখ্যানে কখনও শিকার হয়ে যায় আততায়ী, কোথাও রবিবারের দুপুরের খাওয়ার বিবরণে মানুষের গোপন কামনা বাসনার ইঙ্গিত থাকে।
 
আবার পিস্তল নয়, চাকু নয়, কোনো অস্ত্র নয়, স্রেফ লাথি মারা উঠে এসেছে গল্পে বিবিধ ব্যঞ্জনায় -অতীতকে লাথি মেরে গেরস্থালিতে ফেরে মানুষ অথবা লাথি মারা পা ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ মারে আচম্বিতে। যেন কনসারভেশন অফ মোমেন্টামের কিক। পিস্তল ছোঁড়ায় যেমনটি হয়।

তপনকরের গল্পের সমাপ্তি মিস্টিক, বস্তুত গল্পের শেষ কটি লাইনেই গোটা আখ্যানের সৌন্দর্য ও আত্মা- হাতের তেলোয় গল্পের প্রাণভ্রমরটিকে পেতে গোটা গল্পটি আবার ফিরে পড়ে পাঠক। ধরুন "ঝাঁপ" গল্পের শেষটুকুঃ
"বিরাম দেখল তার প্রিয় শহরে একটাও গাছ নেই। অথচ কোকিল ডাকছে। হেড কোয়ার্টারে বোম মারো কমরেড। হাজার হাজার মানুষ। ছুটে আসছে। বিরাম দু'তলার ব্যালকনি থেকে ছোট্ট ঝাঁপ দিয়ে শান বাঁধানো কলতলা পেয়ে গেল।"
এই যে হাজার হাজার মানুষের ছুটে আসার কথা বলে, পরমুহূর্তেই  একটি মানুষের নিঃশব্দে ঝাঁপ দেওয়া - এখানেও সেই শক্তির রূপান্তর -কেমিকাল এনার্জি যেন কাইনেটিক এনার্জি হয়ে গেল নিমেষে। আবার "শুয়োরের বাচ্চা" গল্পের একদম শেষ লাইনে কী মসৃণভাবে ন্যারেটিভ শিফ্ট ঘটে - মুহূর্তে বিষাদের তীক্ষ্ণতা অনুভব করে শিউরে ওঠে পাঠক।  বা ঠাকুর্দাকে ঘিরে লালিত মিথ ভেঙে যাচ্ছে গল্পের শেষ লাইনে - বাঘের থাবার মতই ভারি আর শাণিত লাইন। অথচ এতে চমক দেওয়া নেই - যা আছে তা  অবশ্যম্ভাবী নিয়তি। এ'পথেই গল্পে বিষাদ আসে।

শ্রী তপনকর ভট্টাচার্যের লেখা জনচিত্তজয়ের  মসৃণ সরণিতে নেই, নিজের তৈরি করা পথে একলা হাঁটে সে। পথ বিজন। বন্ধুর।
 
[প্রথম প্রকাশঃ:তপনকর ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা, নান্দীমুখ সংসদ, বইমেলা ২০২৪।]
 
আমার পড়া তপনকর ভট্টাচার্যের বই গুলিঃ
১। বন্দুকের আগে ও পরে; প্রকাশক গ্রাফিত্তি; মূল্য ১০০ টাকা;
২। চিলেকোঠা; প্রকাশক নান্দীমুখ সংসদ; মূল্য  ৮০ টাকা;
৩। হাবা; প্রকাশক নান্দীমুখ সংসদ; মূল্য ১৫০ টাকা;
৪। নাচ ও পিস্তল; প্রকাশক নান্দীমুখ সংসদ; মূল্য ৮০ টাকা।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস