সন তেরোশো ছেষট্টির কবিপক্ষে লীলাময়ী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বিয়ে করতে চেয়েছিল। হয় সৌমিত্র, নয়ত কাউকেই নয়- বসুশ্রীতে ম্যাটিনি শোয়ে অপুর সংসার দেখার পর লীলাময়ী তার এই ডিসিশন বাড়িতে জানায় । বন্ধুদের সঙ্গে স্টুডিওপাড়ায় যাওয়া, ঠিকানা যোগাড় করে সৌমিত্রকে চিঠি দেওয়া - এইসবই সে করেছিল তার যৌবনে; লীলাময়ীর আত্মীয়স্বজন সব জেনে রুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হলেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে- এ'কথা লীলাময়ীও মেনে নিয়েছিল আলটিমেটলি। তারপর ভুলতে শুরু করেছিল। গত কয়েকবছর ধরে সৌমিত্রকে তার মনেপড়ে নি; বস্তুত, পুরোনো কথা ভাবতে গেলে এখন সব গুলিয়ে যায়; এক এক সময় মনে হয়- সে বরফের দেশের মেয়ে, দার্জিলিংএ জন্ম , একটা ঝর্ণার পাশে যেন তার স্কুল ছিল; এরপর সে জলের আওয়াজ পেতে থাকে- অনেক উঁচু থেকে জল পড়ছে যেন- তার একটি শব্দ মনে পড়ে- পাগলাঝোরা; সে তখন তা' ঝর্ণার নাম বলে মনে করে, তারপর জল দেখতে পায়; জল ছিটকোচ্ছে, ছিটকোচ্ছে, জলের ফেনা ঘুরে ঘুরে কোথায় চলেছে; পরক্ষণেই মনে হয়, যেন তার একটা সাদা কুকুরছানা ছিল ; লীলাময়ীকে দুধ খেতে দেখে সে হাঁ করত আর লীলাময়ী হাত ঢুকিয়ে দিত কুকুরছানার মুখে- লালেঝোলে মাখামাখি হয়ে যেত হাতের পাতা। কুকুরের নাম লীলাময়ী ভেবে পায় নি, পরে, গ্লসি, এবং ফ্লসি এই দুটি শব্দ মনে এলে সে কুকুরছানার নাম হিসেবে গ্লসি কে বেছে নেয়। পাগলাঝোরার কিম্বা গ্লসির গল্প করলে, তার বাড়ির লোকজন গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে, "হতেই পারে না" বলেছিল। বলেছিল, "যত্ত ফালতু কল্পনা, সামনের মাসেই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব"।
এই সব ক্ষেত্রে ডাক্তার দেখাতে দেরি হয়েই যায় - সবাই জানে। এই করে করে কখন অতিমারী এসে গেল- আর লীলাময়ীর বাড়িও বদলে গেল -
ইদানিং যে ঘরে লীলাময়ী রয়েছে সেখানে টেলিভিশন চলতে থাকে সারাক্ষণ আর টিভি দেখতে দেখতেই লীলাময়ী ঝিমোয়। দুপুরের ঢুলুনি আর পাড়ার গলিতে বাচ্চাদের "হাউজ্যাট" চিৎকারের কম্বিনেশন বরাবর মারাত্মক - লীলাময়ী জানত। আসলে, তখন কী হয়- আধোঘুমে বয়স আচমকা পিছনে হাঁটতে শুরু করে; মন আগে দৌড়োয়, পিছন পিছন শরীর - আগে গেলে বাঘে খায়, পরে গেলে সোনা পায় একশবার, হাজারবার আওড়ালেও মন কর্ণপাত করে না। শরীর পিছিয়ে পড়তে থাকে ক্রমশঃ। ঝিমুনি ভেঙে মনকে ফিরিয়ে আনতে সময় লাগে অনেক, আর ঐ সময়টুকুর মধ্যে অনেক কিছু ঢুকে পড়তে থাকে - চাঁদের আলো ঢুকবে বলে জানলার পাল্লা খোলা রয়েছে, আর মশা ঢুকে পড়ছে- ব্যাপারটা ঐ রকম।
যদিও লীলাময়ী শেষ দৌড়েছিল পঞ্চাশ বছর আগে, ট্রেন ধরতে - কলেজের ফার্স্ট পিরিয়ড মিস হয়ে যেত নইলে- আজকাল তন্দ্রার মধ্যে লীলাময়ী খুব দৌড়োয়। অতিমারীর সময় লীলাময়ীর এই ঘরে বাচ্চাদের হইচই চিৎকার আসা সম্ভবই নয় এখন, তবু কম্বিনেশনটা বারবার ঘটছিল ইদানিং। হয়ত টিভির কোনো প্রোগ্রাম থেকে বাচ্চাদের হুল্লোড় লীলাময়ীর কানে ঢুকত তারপর লীলাময়ী দৌড়তে দেখত নিজেকে - কোথায় যাবে জানা থাকত না; সে এক অন্ধকার টানেল ধরে দৌড়োতো আর দৌড়োতো- তারপর পিছন থেকে ট্রেনের হুইশল শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসত। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে যেত তখন ।
লীলাময়ী তার ঝিমুনি ভেঙে উঠে বসতেই মন আর শরীরের রেসে পিছিয়ে পড়া শরীর সহজেই ফিরে আসত ;তার ঘাম, তার হাঁফ ধরা শরীরকে ফিরিয়ে দিত লীলাময়ীর কাছে। মন ফিরতে দেরি করত অনেক। তখন লীলাময়ী ভাবতে চাইত নিজের বয়স কত- সাতষট্টি না কি সাতাত্তর অথবা সাতাশি এবং কত বছর বয়স অবধি মানুষ বাঁচতে পারে; ভাবতে গিয়ে সে অবাক হয়ে দেখত ঐ তিনটে সংখ্যা ছাড়া আর কোনো সংখ্যাই তার মনে পড়ছে না। শরীর আর মনকে আবার একবিন্দুতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করত তখন। চশমা পরে নিয়ে চারপাশে তাকাত - দেখত, যে স্বচ্ছ গোলকের মধ্যে রয়েছে সে, তার বাইরে সবুজ মাঠ, রোদ, গাছগাছালি - পাখি উড়ছে আর ভিতরে , তার সেন্ট্রালী এয়ারকন্ডিশনড গোলাকৃতি ঘরে সরু খাট, দেওয়ালে টিভি, লাগোয়া বাথরুম, একপাশে ট্র্যাপ ডোর- কনভেয়ার বেল্টের সঙ্গে কানেক্টেড -খাবার আসে, ওষুধ বিষুধ, সাবান, পেস্ট ব্রাশ এই সব টুকিটাকি; গোলকের ভেতরের সুইচ টিপে বেল্টকে উল্টোবাগে চালানো যায়- তখন এঁটো থালা তুলে দিতে হয় বেল্টে, কিম্বা ট্র্যাশ ব্যাগ। বাইরে থেকে এই ঘরের অভ্যন্তর দেখা যায় না - এইরকম জানত লীলাময়ী; আর দেখেছিল, এ' গোলকে দ্বিতীয় কোনো মানুষ ঢোকে না; মাসে একবার নিয়মমতো হাত প্রসারিত করতে হয় ট্র্যাপ ডোর দিয়ে- গোলকের বাইরে থেকে সিরিঞ্জ ফুটিয়ে রক্ত নেয় , প্রেশার মাপে কেউ। লীলাময়ী এই সময়গুলোতে গোলকের বাইরে মানুষের নিঃশ্বাস শোনার চেষ্টা করে বিফল হয়েছিল।
তন্দ্রা ভেঙে প্রতিবার গোলকের এইসব উপকরণে লীলাময়ী চোখ সইয়ে নিত আর ক্রমশ তার মন ফিরে আসতে থাকত শরীরের কাছে- বেঁচে থাকার বিবিধ টেকনিকের মধ্যে এইটি মুখ্য- তার মনে হয়েছিল।
অতিমারীর দুনিয়ায় প্রবীণদের বাসস্থান এই গোলকগুলি - ভৌগোলিক অবস্থান বাসিন্দাদের অজানা। মানুষের মুখ দেখার জন্য এ' ঘরে টিভি রয়েছে আর সেলফোন- ভিডিও কল করা যায়; নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রবীণ যোগাযোগ রাখতে পারে শুধু পাঁচজনের সঙ্গে। গোলকে আসার আগে এই পাঁচটি নাম জানিয়ে দিতে হয়।
লীলাময়ী তার রিটায়ারমেন্টের পরে যাদের সঙ্গে ছিল, তাদের চিনতে পারত না সঠিক; যদিও সে কথা গোপন রেখেছিল লীলাময়ী কারণ মানুষের সঙ্গ দরকার হয়ে ছিল তার। কখনও মনে হত তারা ভাইপো ভাইঝি, কখনও নিজের সন্তান ভেবে সংশয় হত আবার অধিকাংশ সময়ই তাদের পুরোনো ছাত্র ছাত্রী মনে হয়েছে লীলাময়ীর ; সে তাই রেজিস্ট্রেশন ফর্মে শুধুই অলীক আর সমাপ্তির নাম লিখেছিল- লীলাময়ীর সহকর্মী দম্পতি। অন্তত লীলাময়ীর সেইরকমই ধারণা ছিল। লীলাময়ীর সঙ্গে তাদের টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল আগাগোড়া। লীলাময়ী জানত, এই মুহূর্তে, সমাপ্তি আর অলীকও এইরকম এক স্বচ্ছ গোলকের বাসিন্দা- তাদের ঘরের বাইরেও এই মুহূর্তে সবুজ মাঠ, রোদ, গাছগাছালি- পাখি উড়ছে। লীলাময়ী তার গোলক থেকে যা যা দেখতে পায়, সেই মুহূর্তে অলীক আর সমাপ্তিও যে হুবহু তাই দেখছিল- লীলাময়ী তা জানে। লীলাময়ী ফোন করে ওদের গোলকের বাইরেটা দেখতে চেয়েছে- তারপর মিলিয়ে দেখেছে; হুবহু এক, প্রতিবার।
অলীক বলেছিল, " হয়ত এটা একটা ব্যারাকের মত- কে জানে ,হয়ত পাশাপাশিই আছি আমরা - ". সমাপ্তি অলীকের কথায় সায় দিলেও, লীলাময়ী চুপ করেছিল। আচমকাই এই পথ যদি না শেষ হয় গানটার কথা মনে পড়েছিল তার; সেদিনই টিভিতে দেখছিল লীলাময়ী- দেখেছিল, হাসিমুখ উত্তম সুচিত্রা গান গেয়ে চলেছে- পিছনে সেই এক তালগাছ, আকাশ আর পুকুরের সীন, বদলাচ্ছে না। লীলাময়ীর মনে হয়েছিল, এমনও হতে পারে- ওরা বাইরে যা দেখছে তা আসলে এই রকম প্রোজেকশন- সত্যিকারের দৃশ্য নয়। এই ভাবনাগুলো বস্তুত ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরোর মত লীলাময়ীর কাছে এসেছিল- যেন খাটের তলা পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা একটা করে পুঁতি বেরোচ্ছে- সমস্ত পুঁতির দানা টুকিয়ে তুলে, মালা গেঁথে ফেলা সম্ভব হয় নি লীলাময়ীর। অলীকের কথায় চুপ করে গিয়েছিল-বাধ্যের মত মাথা নেড়েছিল ফলত।
টিভিতে হাজার হাজার চ্যানেলে গান , নাচ, সিনেমা, খেলা, খবর চলত অষ্টপ্রহর, গোলকের ভিতরের তাপমাত্রা যেমন বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হত, টিভিও তাই- চাইলে মিউট করা যেত কিন্তু অফ করা যেত না। অলীক, সমাপ্তি নানা কথা বলত। একদিন বলত, হয়ত বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে সব প্রবীণদের মেরে ফেলা হবে, আবার পরদিন বলত, ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেই ওদের গোলক থেকে মুক্তি হবে। বলত, ওদের যোগাযোগ যে পাঁচজনের সঙ্গে, তার মধ্যে একজনের আবার যে পাঁচজনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে, তার মধ্যে একজন গোলক থেকে পালাতে গিয়েছিল কনভেয়র বেল্টে চড়ে, তারপর পাগল হয়ে গেছে। অলীক আর সমাপ্তি এরপর আরো বলেছিল, ওরা গোলকেই ভালো আছে, মরতে কে চায়? এই সব কথোপকথনে লীলাময়ীর মাথা গুলিয়ে যেত - গোলকে অবস্থান তার অস্তিত্বের অঙ্গাঙ্গী -এইটুকুই মনে হত; ইনারশিয়া শব্দটা মনে পড়ছিল অবশ্য, ইদানিং-
আজ সকালে উঠেই টিভিতে সে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে পায়। প্রথমে দেখল এক যুবক- হাল্কা দাড়ি, গায়ে আলোয়ান- কপালের দিকটা চেনা মনে হ'ল, তারপর হাসি, চোখ; একবার কেমন মনে হল, চিরুনী চালিয়ে , মুখে সামান্য পাউডার দিয়ে টিভির সামনে বসবে কী না- তারপরেই দেখল, রবীন্দ্রসদনে সৌমিত্র শুয়ে - চোখে চশমা, মাথায় সাদা চুল; অনেক ফুল, মালা, লোকজন- লীলাময়ী তখন আকুল হয়ে ভাবতে থাকে , সৌমিত্রর এত বয়স হয়ে গেল কবে? সে কেন খবর রাখে নি এতদিন ? তারপর ভেবেছিল, সৌমিত্র কি লীলাময়ীদের মত গোলকে ছিল না ?
টিভিতে তখন সৌমিত্রর শেষযাত্রা দেখানো হচ্ছিল, সেই সঙ্গে সিনেমার ক্লিপিং- কোথাও সৌমিত্র বাঁশি হাতে ছাদে দাঁড়িয়েছিল, কোথাও রাস্তায় কোমর দুলিয়ে নাচছিল, পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইছিল আবার-
সিনেমা হলের আলো যেমন এক এক করে নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়, তারপর বিজ্ঞাপন, ফিল্ম ডিভিসনের তথ্যচিত্র শেষ করে সিনেমা, লীলাময়ীর চোখের সামনে তেমনি অল্প অল্প করে বসুশ্রীর স্ক্রীন ফিরে আসছিল - বাড়িওলা ঘর থেকে বেরোতেই সৌমিত্র দিনের বেলা আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে বারান্দায় - মাথার কাছের জানলার পর্দায় মস্ত ফুটো - বর্ষার জল ঢুকছে, সৌমিত্রর কাটা কাটা নাক মুখ, ট্রামে বসে আছে- জানলার বাইরে কলকাতা, কপালে একগুছি চুল, তারপর জানলার ওপারে ডুম জ্বলা ঘরে একটি মেয়েকে দেখে বাঁশি দিয়ে জানলার পাল্লা বন্ধ করে দিচ্ছে সৌমিত্র, আধশোয়া হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে, হা হা করে অকারণ হাসছে - ঢেউ খেলানো চুল সৌমিত্রর, মোহন অঙ্গুলি, টিকোলো নাক, চিবুকের ভাঁজ, ডান গালের নিচের দিকে একটা তিল- পটে আঁকা ঠাকুর দেবতার মত মুখ- "দীর্ঘজীবী হও বাবা, দীর্ঘজীবী হও " কে যেন বলছিল। টিভির সামনে বসে মায়ায় মায়ায় ভরে যাচ্ছে লীলাময়ী, কতদিন পরে চোখ উপচে জল আসছে তার।
কনভেয়র বেল্ট ঘুরতে শুরু করেছিল ইতিমধ্যে , ব্রেকফাস্ট এলো, তারপর লাঞ্চ - আজ লীলাময়ী ছুঁয়ে দেখল না কিছু, ঠায় বসে রইল টিভির সামনে; সৌমিত্রর সঙ্গে সংসার পাততে ইচ্ছে করছিল আবার এবং এই প্রথম তার গোলক থেকে বেরিয়ে পড়ার প্রবল বাসনা জাগছিল।
দুপুরের দিকে একের পর এক সিনেমা দেখাচ্ছিল টিভিতে- যখন উদয়ন পন্ডিতের সঙ্গে পাঠশালার ছেলেরা মূর্তির মাঠের দিকে যাচ্ছিল, লীলাময়ী তন্দ্রার মধ্যে দৌড় শুরু করেছিল গ্লসিকে নিয়ে- দৌড়োতে দৌড়োতে ক্রমশ ছোটো হয়ে যাচ্ছিল গ্লসি, ওর সাদা ল্যাজ, ঝোলা কান, বেবাক মিলেমিশে সাদা বল হয়ে যাচ্ছিল লীলাময়ীর চোখের সামনে। লীলাময়ী চারপাশ অবাক হয়ে দেখছিল- তার বাপের বাড়ির পাড়া। দেখছিল, বরফ পড়ছে, কাঠের ছোটো বাড়ির সামনে গোলাপের ঝোপ, লেটার বক্স সাদা হয়ে যাচ্ছে; কাঠের গেটের ওপারে মা- হাতে কমলালেবু; গেটের ওপার থেকে বলছে, "আর কত দেরি করবি? এবারে স্নান করে খেয়ে নে। বিকেলে সৌমিত্র আসবে, মনে নেই?"
- কে, কে আসবে মা?
লীলাময়ী জেগে গেল এইখানে কিন্তু আজ সে শরীর আর মন কে এক বিন্দুতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল না। এর ফলে তার কষ্ট হচ্ছিল, সমস্ত শরীর জুড়ে ব্যথা আর ঘাম- নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল প্রবল-
সে আজ আর উঠে বসে চশমা পরল না। বিপদঘন্টায় চাপ দিল না হাত বাড়িয়ে। বরং মনের সঙ্গে আজ সে শরীরকে জুতে দিল। তারপর দ্রুত ও সর্বত্রগামী মনের সঙ্গে লীলাময়ী হুশ করে বেরিয়ে গেল গোলকের বাইরে।
পরদিন স্পেসসুট পরা দুটি মানুষ ২১জে ১৭৬৮ নম্বর গোলকের স্যানিটাইজেশনের তদারক করছিল। এখানে এতদিন লীলাময়ী থাকত - এবারে নতুন কেউ আসবে, ওয়েটিং লিস্ট অনুযায়ী। সার্কাসের গ্লোব অফ ডেথে মোটর সাইকেল যেমন পাক খায় , রোবোটিক ক্লীনার গোলকের অবতল মেঝে ,ছাদ ঘুরে ঘুরে পরিস্কার করছিল, স্যানিটাইজার স্প্রে করছিল। মানুষ দুজন গ্লাভস পরা হাতে লীলাময়ীর টুকিটাকি সত্ত্বগুলি চ্যাপ্টা ব্যাগে ভরছিল- তোয়ালে, পাউডারের কৌটো, চটি - চিরুণীতে লম্বা রূপালী চুল লেগেছিল - এই সবই অটোক্লেভে যাবে। খাটের তলায় কার্ডবোর্ডের বাক্সে তারা ঘন সবুজ মলাটের প্রাচীন অ্যালবাম পেয়েছিল, তার তিন নম্বর পাতায় পাহাড়ী ঝর্ণার সামনে সাদা কুকুরছানা কোলে ফ্রক পরা এক বালিকার ছবি ছিল।
লীলাময়ী ততক্ষণে ঐ ঝর্ণারই আশেপাশে সৌমিত্রর সঙ্গে 'এই শহর থেকে আরো অনেক দূরে চল কোথাও চলে যাই' গাইছিল। আরো নিচে পাহাড়ের তলায় সরণির গৃহকোণে সন্ধ্যার আলোগুলি জ্বলে উঠছিল ক্রমশ।
[প্রথম প্রকাশঃ চৌকাঠ ওয়েবজিন, জানুয়ারি, ২০২১]
Comments
Post a Comment