হরেকরকমবা জিবারুদে...

পুনর্মিলন। রিউনিয়ন। বাঁ হাতে রি ইউনিয়ন, ডান হাতে পুনর্মিলন। হাত বদলে বাঁয়ে পুনর্মিলন, ডাইনে রি ইউনিয়ন।  দুই শব্দ নিয়ে লোফালুফি খেললাম খানিক। 'পুনর্মিলন'এ একটি মুহূর্ত মনে এল -সিনেমার মুহূর্ত- কালো সাদা পুরোনো বাংলা সিনেমা-উত্তমকুমার আর মঞ্জু  দে-র  ঘরে এক বিশাল আলমারি ঢোকাতে গিয়ে এক হুলুস্থূল কান্ড আর সে গল্প অনিল চট্টোপাধ্যায়কে বলতে বলতে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় হেসে লুটোপুটি-'পুনর্মিলন' হাতে নিলে ঐ হাসিটা। শুদ্ধু ঐ হাসিটা। সাদায় আর কালোয়।  
রি ইউনিয়ন নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে একটা শব্দ দুটো হয়ে গেল; রি ইউনিয়নের পিঠোপিঠি এসে গেল নস্ট্যালজিয়া।  টুপটুপটুপ করে মুহূর্তগুলি ঝরে গেছে ক'বে-মন তার মালা গেঁথে রেখেছিল- কে জানে  কখন-এক সময়  সুতো ছিঁড়ে  ঝরঝর মুক্তোর দানাগুলি সারা ঘর জুড়ে;  
মুহূর্তই তো-স্রেফ একটা পলক-একটা আগুনের ফুলকি অথবা একটা বুদ্বুদ-আছে অথচ নেই-

ফুলকি
ছোটোবেলায় আমরা বলতাম হরেকরকমবা জিবারুদে রকা রখানা।বঙ্গলিপিতে গোটা গোটা ক'রে  লিখে বলতাম-বলত কি? তারপর কালিপুজোর দুপুরে আমরা বাজিগুলি রোদে দিতাম; ঠাকুমার ঘরে দুইখানি খুব ভারি আয়তক্ষেত্রাকার পিঁড়ি ছিল-আমাদের বাড়ির সব বিয়ে ঐ পিঁড়িতে; ফলতঃ সেই সব পিঁড়িতে অতীতের বিয়ের কিছু স্মৃতি লেগে আছে অবশ্যম্ভাবী - সে হয়ত গঁদের আঠায় সেঁটে থাকা রঙীন কাগজ কিম্বা প্রায় মুছে যাওয়া আলপনা-সেই পিঁড়ি রোদে এনে তার ওপর বাজি সাজাতাম-রং মশাল, ফুলঝুড়ি তুবড়ি চরকি ইলেক্ট্রিক তার সাপবাজি রকেট-একবার দুটি নধরকান্তি বাচ্চার ছবিওলা কালিপটকার প্যাকেট এনেছিলাম মনে পড়ে-ঐ একবারই। দুপুরের রোদ সরে সরে যেত, আমরাও সেইমত পিঁড়ি সরাতাম-রোদ যেন লেগে থাকে বাজিতে। সেই সব হেমন্তের বিকেলে কালি পুজোর প্যান্ডেলে সন্ন্যাসী রাজার গান আর ডায়ালগ শুনতে পাচ্ছি-'যে বাড়িতেই যাওনা সখি'... পরক্ষণেই সুপ্রিয়া দেবীর  ভারি গলা; এদিকে রোদ পড়ে আসছে, হাওয়ায় হিম টের পাওয়া যায়, বাজিতে তখনও রোদের গন্ধ। অন্ধকার হ'লেই বাজি পোড়ানো আর একবার শুরু হলেই মুহূর্তে শেষ তারপর আর কিছু নেই, স্রেফ আর কিছু নেই-শুধু পড়া আর পড়া-দুদিন পরে স্কুল খুলবে-অ্যানুয়াল পরীক্ষা -সব মিলিয়ে সেই সময়্টায় ভারি একটা বিষাদ জন্ম নিত।
স্কুলের শেষের দিকে ঐ বিষাদ একটা আলোর ময়ূরে বদলে গিয়েছিল-'অন্ধকার আকাশের তলায় দেখতে দেখতে একটি আলোর ময়ূর ফুটে উঠল। আলোর ফুলকিগুলো যেন ভাসছিল... ময়ূরটির আকার যতই বাড়ছিল তার প্রত্যঙ্গগুলি ততই গলে যাচ্ছিল-' অথবা জোনাকি-'চোখের পলকে, মাটির অন্ধকার এ একটি আলো দপ করে জ্বলে উঠল.. উঠল তো উঠলই, গাছের মাথা সমান উঁচু হয়ে রংমশালের তারার মতন তুবড়ির ফুলের মতন ফরফর করে পুড়তে লাগল।।দেখতে দেখতে চারপাশে যেন জোনাকির মেলা বসে গেল... মনে হচ্ছিল একদল লোক যেন অন্ধকারে জোনাকির পিচকিরি ছুঁড়ে মারছে আর পলকে অন্ধকারের বসনে জোনাকি ধরে যাচ্ছে।'[বিমল কর, খড়কুটো]
এই আলোর ময়ূর, জোনাকির দল আমি দেখি নি-দিদা বলত, চল্লিশের দশকে স্বদেশি বাজির আলো আকাশে গিয়ে নেতাজী, গান্ধীজী কিম্বা জওহরলালের মুখ হয়ে যেত -সে সব আমার শোনা কথা ছিল।  তবে পরবাসে,  ফোর্থ জুলাই য়ের আকাশে একখানি আলোকবিন্দু উঠতে দেখেছিলাম, সেই একখানি বিন্দু থেকে সহস্র বিন্দু আলো; তারপরে অন্য এক গোলার্দ্ধে, বর্ষবরণের রাতে , দেখলাম আলোকবিন্দু থেকে শতবিন্দু, তারপর সহস্রবিন্দু আলো-আকাশ ছেয়ে  গেল মহাসিংহের জ্বলন্ত কেশরে , কখনও বিরাট অগ্নিপুষ্প ফুটে উঠল রাতের আকাশে। তারপর সোনার পরাগরেণু যেই ছাই হয়ে ঝরে পড়ছিল-আকাশ অন্ধকার- বাজি দেখে লোকজন বাড়ির পথ ধরেছে, হারবারের দিক থেকে জোলো হাওয়া, হিম, বারুদের গন্ধ- হুবহু ছোটোবেলার মত-সেম টু সেম। চোখ তুলে দেখলাম মাথার ওপরে কালপুরুষ আর দমদমের বাড়ির উঠোনে মা কোমরে আঁচল জড়িয়ে তুবড়িতে আলো দিচ্ছে, আমরা ফুলঝুরি রং মশাল জ্বালাচ্ছি-মোমবাতির সামনে ফুলঝুরি ধরতে প্রথম স্ফুলিঙ্গে সরিয়ে নিচ্ছি মুখ, অন্য হাতে রং মশাল জ্বালাচ্ছি-লাল বেগুনী ধোঁয়া তারপর ঝুপ করে অন্ধকার-অথচ সোনালী রাংতায় ঢাকা আরো কতখানি জ্বলা বাকি- উল্টো করে ধরলাম নেভা মশাল- ঝুরঝুর করে বালি-শুধু বালি-জেঠু বলছে, ভ্যাজাল ভ্যাজাল সব কিছুতে ভ্যাজাল।

বুদ্বুদ
সে ধরুন প্রাক মোবাইল কাল। সেইদিনই পুজোর ছুটি পড়েছে। স্কুল কলেজ পাশ করে আপনি  যাদবপুরে। ইউনিভার্সিটি ফেরত ছাতা বাগিয়ে হাঁটছেন শিয়ালদা সাউথ থেকে নর্থ সেকশনে। কাঁধের ঝোলায় হাত দিয়ে রেখেছেন;  গত তিনমাসে তিনদিন আপনার পার্স মান্থলি খোয়া গেছে ঐ কাঁধের ঝোলা থেকেই। মাথায় মাথায় ঝুড়ি ভর্তি সব্জি সাউথের থেকে নর্থের দিকে যাচ্ছে। কাঁধে কাঁধে মাছের চারা, ছানা ( দুগ্ধজাত)। পা পিছলোচ্ছে আপনার মাঝে মাঝে কফে, জলে, কাদায়, পচা পাতায় বা কলার খোসায়। হিসির গন্ধ চত্বর জুড়ে। প্রচুর রুমাল বিক্রি হচ্ছে। অ্যানাউন্সমেন্ট, হকার, ভিক্ষুক, ক্যাসেট সব জড়িয়ে জট পাকিয়ে। প্রচুর লোক হুড়হুড়িয়ে বেরিয়ে এল নর্থ সেকশনের ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিক থেকে। আর আপনার চটিটাও পটাং করে ছিঁড়ে গেল। ঠিক এই সময় হঠাৎ একরাশ বুদবুদ আপনার মাথায় মুখে এসে পড়তে লাগল। আপনি মুখ তুলে তাকাতেই ফ্লাইওভারের ব্যাকড্রপে ঢাকের ঝালর দেখতে পেলেন - ঢাকীরা ঘুরে ঘুরে ঢাক বাজাচ্ছে। সব আওয়াজ ছাপিয়ে শুধুই ঢাকের বোল। আর আপনার দুপাশ থেকে রাশি রাশি সাবান বুদ্বুদ উড়ে আসছে। 
সবই অবশ্য ফেটে যেতে লাগল এদিক ওদিক। একটাই শুধু বাউন্স খেয়ে এদিকে এল তারপর গুঁড়ি মেরে আপনার পায়ের কাছে পোষাটার মত দাঁড়াল। আপনি খপ করে তুলে ঝোলায় পুরলেন। ছেঁড়া চটি পায়ে, ছাতা হাতে  দাঁড়িয়ে 'অমল মহিমা' শব্দটা আপনার মনে পড়ল। এই 'অমল' হসন্ত দিয়ে বলতে নেই। 

এই এতদিন পরে, রি ইউনিয়ন শব্দটা দেখে,  সেই বুদ্বুদ টা ঝোলা থেকে বের করে আনলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপই বলুন কি স্প্রেডশীট কিম্বা ল্যাব বা কাচের জানলার ওপারে ইউক্যালিপটাসের ডালে বসা ইয়াব্বড়া দুটো কাকাতুয়া বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে এখন শুধু শিয়ালদা ফ্লাই ওভারের ব্যাকড্রপে ঢাকের বোল । 

আপনারা বলেন জিয়া নস্ট্যাল । আমি বলি ম্যাজিক। অথবা রি -ইউনিয়ন।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস