পাড়াতুতো চাঁদ
এখন যে পাড়ায় অশোকের ডেন্টাল প্র্যাকটিস, পঞ্চাশ বছর আগে এখানে সে প্রথম এসেছিল-লতিকাকে দেখতে। বড়দি ছিল, আর বোধ হয় দাদা বৌদি ছিল সঙ্গে। পাড়াটা একটু অন্যরকম। বড় রাস্তা থেকে মেয়েদের স্কুলের উল্টোদিকের গলি দিয়ে ঢুকতে হ'ত। ঢোকার মুখে একটা দোকান ছিল সে সময়- এমনিই টুকিটাকির দোকান অথচ আইসক্রীম পাওয়া যায় ঐ দোকানে- ফ্রীজারের এক ঝলক দেখে সে খুব আশ্চর্য হয় সেদিন-এখনও মনে আছে অশোকের। দোকানের পাশ দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতে একটা ল্যাম্প পোস্ট-গাড়ি নিয়ে এলে, ওখানে গাড়ি রেখে হেঁটে যেতে হয়। সরু কানা গলি। গলির শেষ বাড়িটা লতিকাদের। গাড়ি থেকে নেমে গলিতে ঢুকতেই যেন ওদের পিছনে অদৃশ্য একটা ভারি দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল -বাইরের বড় রাস্তার আওয়াজ, ফেরিওলার হাঁক, রিকশর টুংটাং, ট্রামের ঘন্টি কিচ্ছু ছিল না এই গলিতে, বৈশাখের গরম হল্কা, পিচগলা রাস্তাও যেন দরজার বাইরে রেখে এসেছিল ওরা। খুব ছোটবেলায় জাদুঘরে ঢুকে ঠিক এইরকম মনে হয়েছিল অশোকের। গলির দুপাশে দু তলা তিনতলা বাড়ি-সব বাড়ি লাল রংএর, সব বাড়িতেই ঝুলবারান্দা। ভালো লাগছিল অশোকের। জাদুঘরে প্রথম ঢোকার আরাম আর রোমাঞ্চ ওকে পেয়ে বসেছিল একসঙ্গে।
লতিকাদের বাড়িটা বেশ পুরোনো। উঁচু ছাদ, কড়ি বর্গা, দরজা খুললে বাঁধানো উঠোন, উঠোন থেকে অনেকটা উঁচু বারান্দা-অশোক আগে এরকম দেখে নি। তারপর লতিকার মা, মামাবাবু, লতিকার চোখ, লতিকার বিনুনী, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো- ফেরার পথে বৌদিকে মৃদুস্বরে বলেছিল- 'ইয়ে তার মানে বিয়ের দিন এখানেই গাড়ি রাখতে হবে?' সেই শ্রাবণেই বৃষ্টির পূর্বাভাষ মাথায় নিয়ে আইসক্রীমের দোকান পেরিয়ে ফুল সাজানো গাড়ি রাখা, তারপর টোপর পরে কোঁচা হাতে বাকি পথটুকু হেঁটে যাওয়া- সেদিন গলিটা অন্যরকম ছিল-লুচির গন্ধ, পেঁয়াজ রসুন গরম মশলা, রজনীগন্ধার গন্ধ মিশছিল একসঙ্গে, বাঁশের ম্যারাপ, রঙীন কাপড়, সানাই।
পরদিন লতিকাকে নিয়ে ফেরার সময় , লাইটপোস্টের সামনে গাড়িতে উঠতে গিয়ে চাঁদ দেখছিল অশোক। আর ওর কোমরে খোঁচা দিয়ে লতিকা বলেছিল- 'দ্যাখো -পাহাড়ী সান্যাল।'
অশোক গাড়িতে ঢুকছিল-'কই, কোথায়, সে কি করে হয় ' বলে মাথা বের করে এনে ঘাড় ঘুরোয়।এই সময় লতিকার মামা -' আরে ওঠো তো হে গাড়িতে -উপোস টুপোস করে সারাদিন...মাথা টাথা ঘুরছে না কি?' বলে ওদের রওনা করান। গাড়ি ছেড়ে দিলে, অশোক আবার ঘাড় ঘোরালে লতিকা বলেছিল, 'পাড়া থেকে বেরিয়ে এলাম তো, আর দেখা যাবে না।' সেদিন গাড়িতে ড্রাইভার, দাদা, বৌদি আর ওরা। লতিকা একদম কাঁদে নি, খুব মন দিয়ে পথঘাট দেখছিল। অশোকের দাদা, বৌদি - ভ্যাপসা গরম, বৌভাতের মেনু , বাড়ি গিয়ে বলা হয় নি তাই ছোটনকাকা, লোটনকাকারা আসবে না-এই সব বলছিল। অশোকের ঘোর লাগছিল-রজনীগন্ধার ঘোর,সানাইয়ের ঘোর, লতিকার ঘোর। বৌ আর চাঁদ দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়ে আর বাড়ি পৌঁছে ভীড়ে , উত্তেজনায় পাহাড়ী সান্যাল বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়।
ফুলশয্যায় লতিকাকে টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো বারান্দা মনে হয়েছিল অশোকের, মনে হয়েছিল যেন তিনতলার বারান্দা, বারান্দার রেলিংএ অজস্র টুনি বাল্ব ,আর কেউ যেন সুইচ অফ করতে ভুলে গেছে-টুনি জ্বলছে নিভছে সর্বক্ষণ, দিনের আলোয় বোঝা যায় না কিছু, চারপাশ অন্ধকার হতে শুরু করলেই নীল লাল সাদা সবুজ আলোর কুচিতে বারান্দার কী মহিমা। অশোকের মহিমান্বিত লাগছিল নিজেকে, বুকের মধ্যে সানাই বাজছিল, ওর মনে হচ্ছিল, খুব সুখী হবে ওরা - ও আর লতিকা। লতিকাও অশোককে দেখছিল।
-'কী দেখছ?'
-' তোমার নাম শুনে ভেবেছিলাম, এ বাবা, যদি তুমি অশোক কুমারের মত হও! কেমন বুড়ো বুড়ো না?'
-'তো, দেখলে কেমন? বুড়ো বুড়ো?'
-তোমাকে না শুভেন্দুর মত লাগে-'
-'শুভেন্দু?'
-'আকাশ কুসুম দেখো নি? এ বাবা। হংস-মিথুন? চৌরঙ্গী তো দেখেছ, না?'
-'তুমি বুঝি খুব সিনেমা দেখ?'
-'খুব। ভীষণ। তোমাকেও নিয়ে যাব এবার থেকে। আচ্ছা তোমরা উল্টোরথ রাখো?'
অশোক লতিকাকে দেখছিল-লতিকার কপালে চন্দন, হাল্কা ঘাম, সিঁদুরের গুঁড়ো, চোখের কাজল, হাসি-ওর গজদাঁত দেখা যাচ্ছিল-দাঁতের পাটি সামান্য এবড়োখেবড়ো, অসমান। ফুল সাজানো খাটের সামনে দাঁড়িয়ে লতিকার জন্য অপরিসীম মায়ায় ওর বুক ভরে যাচ্ছিল। বলেছিল, 'রাখব এবার থেকে।'
লতিকা বলছিল-' অমনি করে আবার দেখে না কি? ফুলশয্যায় কেমন করে নতুন বৌ এর ঘোমটা তুলে দেখতে হয়, জানো না? সিনেমায় দেখো নি?'
২
অষ্টমঙ্গলায় লতিকা অশোককে দেখাল রাজেশ খান্না-গলিতে স্কুটার থামিয়ে হেঁটে আসছিল- বাঁদিকের লালবাড়িতে যাবে সম্ভবতঃ। লতিকা বলল, 'রোজ আসে জানো? একদম রাজেশ খান্না, না?'
সে সব খুনসুটি আর অজস্র অর্থহীন কথার আদানপ্রদানের সময়। তাই হয়েছিল। অশোকও বলল, আর পাঁচটা নতুন বর এই ক্ষেত্রে যা বলবে-' রাজেশ খান্নাকে খুব পছন্দ ? তাহলে আর শুভেন্দুকে মনে ধরবে কি করে?'
লতিকা খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল, 'আচ্ছা, তোমার কাকে ভালো লাগে বলো না? কাবেরী বসু? ওয়াহিদা? না না আমি বলি-শর্মিলা ঠাকুর অথবা সুচিত্রা সেন।'।
অশোক বলল-' না তো। কাকে ভালো লাগে শুনবে? তোমার পছন্দ হবে না। সুপ্রিয়া। কী সুন্দর দাঁত , কী ফিগার।'
-'তাই তো, দাঁতের ডাক্তার হ'লে সুপ্রিয়াকে ভালো লাগতেই হবে।'
-'বাপ রে কী জ্ঞান-'
-'এই, 'মন নিয়ে' দেখতে যাবে ? খুব নাকি ভালো হয়েছে।'
-'সুপ্রিয়ার ডাবল রোল। যেতে তো হবেই।'
-' ও বাবা, সুপ্রিয়ার সব খবরই রাখা হয় দেখছি-'
-'দাঁতের ডাক্তার তো, রাখতে হয়। পাহাড়ী সান্যালের কথা কী বলছিলে সেদিন?'
-'পাহাড়ী সান্যাল থাকেন সামনের তিনতলায়। আমরা যখন গাড়িতে উঠছিলাম-হাত নাড়ছিলেন। কাল ভোরে দেখো। সত্যি গো, একদম পাহাড়ী সান্যাল-সেই রকম হাসি, সেই রকম করে বলেন, মাই সান...'
-'তোমাদের পাড়া ভরা সব ফিল্মস্টার তো... কী হবে খুকী? কী করে থাকবে ম্যাটিনি আইডলদের ছেড়ে? আমাদের পাড়ায় গিয়ে মন বসবে?'
-'কেন তুমি আছ। চোখের সামনে সব সময়। শুভেন্দু। তবে তোমাদের পাড়াটা এরকম না। '
-'এবার হয়ে যাবে। দুদিন ছাদে দাঁড়ালেই দিলীপকুমার, সায়রাবানু সব্বাইকে খুঁজে পাবে।'
-'না গো। আমাদের পাড়ায় ঢুকলে কেমন মনে হয়-সিনেমা দেখতে ঢুকছি। ঠান্ডা ঠান্ডা, খুব আরাম তারপর কিছু একটা হবে সেই আনন্দ-'
লতিকার উচ্ছ্বাসে সামান্যতম বাধা পড়ুক, অশোক চাইছিল না-মিউজিয়ামে ঢোকার উপমাটা সে চেপে গেল , বলল-'কিছু একটা হবে মানে কী খুকী? কী হবে? শুভেন্দুর চুমু হবে একটা? সিনেমার মতো? একটা? দুটো? চার, পাঁচ, ছয়?'
অষ্টমঙ্গলার দুদিনে অশোকের দেখা হয়ে গেল অভি ভট্টাচার্য, সায়গল আর প্রমথেশ বড়ুয়াকে। বড়ুয়াসাহেব বাজার করে ফিরছিলেন, সায়গল দাঁত মাজছেন বারান্দায়-লতিকা দেখিয়েছিল-'দ্যাখো, দ্যাখো, একদম সায়গল না? আরে দ্যাখো দ্যাখো, কি হল দেখবে তো-পুরো প্রমথেশ বড়ুয়া। একদম। তোমার মনে হচ্ছে না? আমি তো প্রথমদিন দেখেই...সত্যি, তুমি বুঝতে পারছ না? '
অশোক বুঝল বৌটা একটা পাগলি। বলল, 'পারব, আস্তে আস্তে পারব।'
লতিকার জন্য ও সব করতে পারে-এরকম ভাবছিল অশোক। একবার ভাবছিল প্রতি সপ্তাহে লতিকাকে নিয়ে সিনেমা দেখবে, একবার ভাবছিল টালিগঞ্জের স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে শুটিং দেখাবে, আবার ভাবছিল উত্তমকুমারকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেবে নাকি-কী করলে লতিকা ভীষণ খুশি হবে-তাই ভাবছিল অশোক। লতিকাও আনন্দে ভরে ছিল। ব্যালকনির সমস্ত টুনিবাল্ব যেন একসঙ্গে জ্বলে উঠেছিল-দিন হোক রাত হোক, তারা জ্বলেই রইল বারান্দায়, সুইচ অফ করতে যেন সবাই ভুলে গিয়েছে।
অশোকরা ফিরে গেল শুক্রবার-লতিকার কাননদেবী পার্কের দিকটায় থাকেন, এ গলিতে অসুস্থ মা কে দেখতে আসেন প্রতি শনিবারে- পরেরবার এলে কাননদেবীর সঙ্গে দেখা হবে। এযাত্রায় অশোকের কাননদেবী দর্শন হল না-লতিকা সামান্য আক্ষেপ করছিল।
৩
অষ্টমঙ্গলার ঠিক কুড়ি বছরের মাথায় ক্যান্সার ধরা পড়েছিল লতিকার। বহুদিনই একটা লাম্প পুষেছিল বুকে। যখন বোঝা গেল, অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে রোগ। ডাক্তার খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন লতিকাকে, অশোককে। বলেছিলেন, ভ্গবানকে ডাকুন। মির্যাকল তো হয়ও।
বাড়ি ফিরে খিলখিল করে হেসেছিল লতিকা- 'একদম মিলি । পুরো মিলি। জয়া ভাদুড়ির সেই সীনটা মনে আছে?'
অশোক পাগল হয়ে গিয়েছিল যেন- লতিকার ওপর রাগ করেছিল, খ্যাপার মত বলেছিল, 'শুধু সিনেমা , না? শুধু সিনেমা? তুমি মিলি হতে চেয়েছিলে, তাই বলো নি। আমি জানি। সিনেমাই সব তোমার। আমি, বাবলু -কেউ না?'
লতিকা শান্ত চোখে তাকিয়েছিল। বলেছিল-'কেঁদো না।' ওকে নন্দিনী মালিয়ার মত লাগছিল অশোকের । যেন ওরা দুজনে ভ্রমর আর অমল। যেন ওদের জোর করে কেউ সিনেমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে-অভেদ্য এক পর্দায় আটকে গিয়েছে লতিকা আর ও- দম আটকে যাচ্ছে, কিছুতেই বেরোনো যাচ্ছে না - 'ছুটি'র লাস্ট সীন চলছে। সিনেমার থেকে বেরোতে না পেরে অশোক ভাবল, তবে সিনেমাই দেখা যাক।
অশোকদের পাড়ায় ততদিনে সিনেমার ক্যাসেট ভাড়া দেওয়ার দোকান চালু হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন একটা করে সিনেমা আনতে শুরু করল অশোক-লতিকার জন্য। যত্ন করে বেছে বেছে সিনেমা আনত - হাসি মজা নাচ গানের সিনেমা সব-ইংরিজি হিন্দি বাংলা। লতিকা এই ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল, বলেছিল,' কি ভেবেছ , সিনেমায় মরে যাওয়ার সীন থাকলে আমার কষ্ট হবে? এত নাচ গানের সিনেমা দেখলে মাথা ঝিমঝিম করে না?' তারপর একটু থেমে বলেছিল, ' জানো, ছোটোবেলায় আমিও এরকম করতাম।'
-'কী রকম ?'
-' ভীষণ ভয় পেতাম ছোটোবেলায়-'হরি বোল শুনলেই বুক কাঁপত, রাতে ঘুম আসত না, মনে হ'ত কী হবে? জানো, মা কে কী বলতাম? বলতাম, আমি খুব ভালো মেয়ে হ'ব এবার থেকে। তুমি আর বাবা তাহলে আমাকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দেবে? হি হি।' অশোক কথা ঘোরাতে চাইছিল। জোর করে ঠাট্টার চেষ্টা করল, 'আজ তবে ভক্ত ধ্রুব ট্রুব আনি?'
-' শোনো না, নিজে নিজে চেষ্টা করতাম খুব। এই যে, তুমি যেমন করছ এখন। একটা হাঁদারামের মত। বেছে বেছে বই পড়তাম, পাতা উল্টে উল্টে পথের পাঁচালি পড়েছি, জানো?'
-'তারপরে?'
-'তখন রবীন্দ্রনাথকে পুজো করতাম প্রায়। ঠাকুরের মতো। একদিন ভাবলাম উনিও যেখানে গেছেন, সেখানেই যাবো, ভয় কি? কী বোকা ছিলাম, না'
-'বোকাটা খুকীটা, পাগলীটা...'
-'এই, একদম কাঁদবে না'
ডাক্তারের নিদান ছিল-বড়জোর ছমাস। তার আগেই চলে গিয়েছিল লতিকা।
একবার অশোককে বলেছিল, 'ঠিক কি ভাবে মরে যায় গো? সিনেমা হলে ঢোকার মত? অন্ধকার অন্ধকার, ঠান্ডা, সিনেমাটা কেমন হবে জানা নেই- তাহলে তো ভয় নেই, না?'
৪
ডেন্টাল হসপিটাল থেকে রিটায়ার করে অশোক ওর শ্বশুরবাড়ির একতলায় প্র্যাকটিস শুরু করল। দোতলায় ভাড়াটে, নিচটা বহুদিন খালি। একটা ঘর গলির ওপরেই, যেন গলিটা থেকেই আচমকা ঘর গজিয়েছে- বিয়ের দিন ঐ ঘরেই বসেছিল অশোক- সে ঘরেই তার যন্ত্রপাতি বসালো। নিয়ম করে বসত চেম্বারে, সঙ্গে রতন থাকত, অ্যাসিস্ট্যান্ট। খুব বেশি রোগী হ'ত না। অশোকের কাঁপা হাত, কড়ি বরগা নোনা ওলা পুরোনো ঘরদোর, ধুতি পরা রতন-আতান্তরে না পড়লে কে আর আসবে? অশোক বই টই কাগজ পড়ত। সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছিল । একদম।
বৈশাখের দুপুর। ভোর থেকে যেন আগুনের হল্কা বইছে। অশোকের চেম্বার ফাঁকা। অশোক বসে বসে রাস্তা দেখছিল-রাস্তা মানে গলি-লাইটপোস্টের তলা থেকে ওর চেম্বার অবধি-দুদিকে এখনও সেই সব পুরোনো লাল বাড়ি, ঝুল বারান্দা। পাহাড়ী সান্যাল, কমল মিত্ররা আর কেউ নেই এপাড়ায়। কে জানে হয়ত দেব আছে, হয়ত অঙ্কুশ,আবীর কিম্বা প্রসেনজিত ঋতুপর্ণা। লতিকা থাকলে ঠিক চিনে নিত।
দুপুর দেড়টা নাগাদ একটা গাড়ি এলো। কালো অ্যাম্বাসাডর। লাইটপোস্টের পাশে গাড়ি থেকে একজনকে নামতে দেখল অশোক। এক মহিলা, বেশ লম্বা - হাঁটায় খুব চেনা একটা দুলুনি-কোথায় দেখেছে অশোক মনে করতে পারছিল না- কেমন সিনেমার মত লাগছিল - যেন অনেকদিন পরে অশোক আজ একটা খুব ঠান্ডা সিনেমাহলে ঢুকেছে- সিটে বসে সিনেমা দেখছে, প্রজেকটার চলছে কির কির করে আর পর্দায় কেউ হেঁটে আসছে; ঐ আশ্চর্য হাঁটাকে যেন স্লো মোশনে ধরেছে ক্যামেরা। মন্থর গমনে সে আসছে আর আসছে-ক্রমশঃ লালবাড়ির রং বদলে যাচ্ছিল, রোদের প্রখর তেজ কমে কমে মেদুর আর কিছুটা অপার্থিব - একটা সাদা কালো ছবির লংশট যেমন হয়। অশোক সিনেমার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে না কি সিনেমাই পর্দা থেকে বেরিয়ে এসেছে গলিতে-এই সব ভাবতে চাইছিল অশোক। ক্যামেরা যেন জুম করল তখনই , সব রং ফিরে এল চরাচরে আর অশোক অবাক হয়ে দেখল, বৈশাখের দুপুরে সুপ্রিয়া দেবী হেঁটে আসছেন তাঁর চেম্বারে- নীল শাড়ি সহস্রবুটি, বড় খোঁপা, গোল গোল রোদ্চশমা- অশোকের সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। রতনকে জল দিয়ে যেতে ডাকছিল অশোক।
সুপ্রিয়া দেবী এখন অশোকের একেবারে সামনে- রোদ চশমা খুলে হাসছেন- 'একটু দেখবেন , আমার দাঁত?'
অশোক দেখল তার একদম সামনে সুপ্রিয়া- দেখল সুপ্রিয়ার কপালে চন্দন, হাল্কা ঘাম, সিঁদুরের গুঁড়ো, দেখল চোখের কাজল, আর হাসি-গজদাঁত দেখা যাচ্ছে-দাঁতের পাটি এবড়োখেবড়ো, অসমান।
অশোক হাত বাড়িয়ে দিল; বড় শান্তভাবে বলল-'এসো।'
লতিকাদের বাড়িটা বেশ পুরোনো। উঁচু ছাদ, কড়ি বর্গা, দরজা খুললে বাঁধানো উঠোন, উঠোন থেকে অনেকটা উঁচু বারান্দা-অশোক আগে এরকম দেখে নি। তারপর লতিকার মা, মামাবাবু, লতিকার চোখ, লতিকার বিনুনী, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো- ফেরার পথে বৌদিকে মৃদুস্বরে বলেছিল- 'ইয়ে তার মানে বিয়ের দিন এখানেই গাড়ি রাখতে হবে?' সেই শ্রাবণেই বৃষ্টির পূর্বাভাষ মাথায় নিয়ে আইসক্রীমের দোকান পেরিয়ে ফুল সাজানো গাড়ি রাখা, তারপর টোপর পরে কোঁচা হাতে বাকি পথটুকু হেঁটে যাওয়া- সেদিন গলিটা অন্যরকম ছিল-লুচির গন্ধ, পেঁয়াজ রসুন গরম মশলা, রজনীগন্ধার গন্ধ মিশছিল একসঙ্গে, বাঁশের ম্যারাপ, রঙীন কাপড়, সানাই।
পরদিন লতিকাকে নিয়ে ফেরার সময় , লাইটপোস্টের সামনে গাড়িতে উঠতে গিয়ে চাঁদ দেখছিল অশোক। আর ওর কোমরে খোঁচা দিয়ে লতিকা বলেছিল- 'দ্যাখো -পাহাড়ী সান্যাল।'
অশোক গাড়িতে ঢুকছিল-'কই, কোথায়, সে কি করে হয় ' বলে মাথা বের করে এনে ঘাড় ঘুরোয়।এই সময় লতিকার মামা -' আরে ওঠো তো হে গাড়িতে -উপোস টুপোস করে সারাদিন...মাথা টাথা ঘুরছে না কি?' বলে ওদের রওনা করান। গাড়ি ছেড়ে দিলে, অশোক আবার ঘাড় ঘোরালে লতিকা বলেছিল, 'পাড়া থেকে বেরিয়ে এলাম তো, আর দেখা যাবে না।' সেদিন গাড়িতে ড্রাইভার, দাদা, বৌদি আর ওরা। লতিকা একদম কাঁদে নি, খুব মন দিয়ে পথঘাট দেখছিল। অশোকের দাদা, বৌদি - ভ্যাপসা গরম, বৌভাতের মেনু , বাড়ি গিয়ে বলা হয় নি তাই ছোটনকাকা, লোটনকাকারা আসবে না-এই সব বলছিল। অশোকের ঘোর লাগছিল-রজনীগন্ধার ঘোর,সানাইয়ের ঘোর, লতিকার ঘোর। বৌ আর চাঁদ দেখতে দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়ে আর বাড়ি পৌঁছে ভীড়ে , উত্তেজনায় পাহাড়ী সান্যাল বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়।
ফুলশয্যায় লতিকাকে টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো বারান্দা মনে হয়েছিল অশোকের, মনে হয়েছিল যেন তিনতলার বারান্দা, বারান্দার রেলিংএ অজস্র টুনি বাল্ব ,আর কেউ যেন সুইচ অফ করতে ভুলে গেছে-টুনি জ্বলছে নিভছে সর্বক্ষণ, দিনের আলোয় বোঝা যায় না কিছু, চারপাশ অন্ধকার হতে শুরু করলেই নীল লাল সাদা সবুজ আলোর কুচিতে বারান্দার কী মহিমা। অশোকের মহিমান্বিত লাগছিল নিজেকে, বুকের মধ্যে সানাই বাজছিল, ওর মনে হচ্ছিল, খুব সুখী হবে ওরা - ও আর লতিকা। লতিকাও অশোককে দেখছিল।
-'কী দেখছ?'
-' তোমার নাম শুনে ভেবেছিলাম, এ বাবা, যদি তুমি অশোক কুমারের মত হও! কেমন বুড়ো বুড়ো না?'
-'তো, দেখলে কেমন? বুড়ো বুড়ো?'
-তোমাকে না শুভেন্দুর মত লাগে-'
-'শুভেন্দু?'
-'আকাশ কুসুম দেখো নি? এ বাবা। হংস-মিথুন? চৌরঙ্গী তো দেখেছ, না?'
-'তুমি বুঝি খুব সিনেমা দেখ?'
-'খুব। ভীষণ। তোমাকেও নিয়ে যাব এবার থেকে। আচ্ছা তোমরা উল্টোরথ রাখো?'
অশোক লতিকাকে দেখছিল-লতিকার কপালে চন্দন, হাল্কা ঘাম, সিঁদুরের গুঁড়ো, চোখের কাজল, হাসি-ওর গজদাঁত দেখা যাচ্ছিল-দাঁতের পাটি সামান্য এবড়োখেবড়ো, অসমান। ফুল সাজানো খাটের সামনে দাঁড়িয়ে লতিকার জন্য অপরিসীম মায়ায় ওর বুক ভরে যাচ্ছিল। বলেছিল, 'রাখব এবার থেকে।'
লতিকা বলছিল-' অমনি করে আবার দেখে না কি? ফুলশয্যায় কেমন করে নতুন বৌ এর ঘোমটা তুলে দেখতে হয়, জানো না? সিনেমায় দেখো নি?'
২
অষ্টমঙ্গলায় লতিকা অশোককে দেখাল রাজেশ খান্না-গলিতে স্কুটার থামিয়ে হেঁটে আসছিল- বাঁদিকের লালবাড়িতে যাবে সম্ভবতঃ। লতিকা বলল, 'রোজ আসে জানো? একদম রাজেশ খান্না, না?'
সে সব খুনসুটি আর অজস্র অর্থহীন কথার আদানপ্রদানের সময়। তাই হয়েছিল। অশোকও বলল, আর পাঁচটা নতুন বর এই ক্ষেত্রে যা বলবে-' রাজেশ খান্নাকে খুব পছন্দ ? তাহলে আর শুভেন্দুকে মনে ধরবে কি করে?'
লতিকা খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল, 'আচ্ছা, তোমার কাকে ভালো লাগে বলো না? কাবেরী বসু? ওয়াহিদা? না না আমি বলি-শর্মিলা ঠাকুর অথবা সুচিত্রা সেন।'।
অশোক বলল-' না তো। কাকে ভালো লাগে শুনবে? তোমার পছন্দ হবে না। সুপ্রিয়া। কী সুন্দর দাঁত , কী ফিগার।'
-'তাই তো, দাঁতের ডাক্তার হ'লে সুপ্রিয়াকে ভালো লাগতেই হবে।'
-'বাপ রে কী জ্ঞান-'
-'এই, 'মন নিয়ে' দেখতে যাবে ? খুব নাকি ভালো হয়েছে।'
-'সুপ্রিয়ার ডাবল রোল। যেতে তো হবেই।'
-' ও বাবা, সুপ্রিয়ার সব খবরই রাখা হয় দেখছি-'
-'দাঁতের ডাক্তার তো, রাখতে হয়। পাহাড়ী সান্যালের কথা কী বলছিলে সেদিন?'
-'পাহাড়ী সান্যাল থাকেন সামনের তিনতলায়। আমরা যখন গাড়িতে উঠছিলাম-হাত নাড়ছিলেন। কাল ভোরে দেখো। সত্যি গো, একদম পাহাড়ী সান্যাল-সেই রকম হাসি, সেই রকম করে বলেন, মাই সান...'
-'তোমাদের পাড়া ভরা সব ফিল্মস্টার তো... কী হবে খুকী? কী করে থাকবে ম্যাটিনি আইডলদের ছেড়ে? আমাদের পাড়ায় গিয়ে মন বসবে?'
-'কেন তুমি আছ। চোখের সামনে সব সময়। শুভেন্দু। তবে তোমাদের পাড়াটা এরকম না। '
-'এবার হয়ে যাবে। দুদিন ছাদে দাঁড়ালেই দিলীপকুমার, সায়রাবানু সব্বাইকে খুঁজে পাবে।'
-'না গো। আমাদের পাড়ায় ঢুকলে কেমন মনে হয়-সিনেমা দেখতে ঢুকছি। ঠান্ডা ঠান্ডা, খুব আরাম তারপর কিছু একটা হবে সেই আনন্দ-'
লতিকার উচ্ছ্বাসে সামান্যতম বাধা পড়ুক, অশোক চাইছিল না-মিউজিয়ামে ঢোকার উপমাটা সে চেপে গেল , বলল-'কিছু একটা হবে মানে কী খুকী? কী হবে? শুভেন্দুর চুমু হবে একটা? সিনেমার মতো? একটা? দুটো? চার, পাঁচ, ছয়?'
অষ্টমঙ্গলার দুদিনে অশোকের দেখা হয়ে গেল অভি ভট্টাচার্য, সায়গল আর প্রমথেশ বড়ুয়াকে। বড়ুয়াসাহেব বাজার করে ফিরছিলেন, সায়গল দাঁত মাজছেন বারান্দায়-লতিকা দেখিয়েছিল-'দ্যাখো, দ্যাখো, একদম সায়গল না? আরে দ্যাখো দ্যাখো, কি হল দেখবে তো-পুরো প্রমথেশ বড়ুয়া। একদম। তোমার মনে হচ্ছে না? আমি তো প্রথমদিন দেখেই...সত্যি, তুমি বুঝতে পারছ না? '
অশোক বুঝল বৌটা একটা পাগলি। বলল, 'পারব, আস্তে আস্তে পারব।'
লতিকার জন্য ও সব করতে পারে-এরকম ভাবছিল অশোক। একবার ভাবছিল প্রতি সপ্তাহে লতিকাকে নিয়ে সিনেমা দেখবে, একবার ভাবছিল টালিগঞ্জের স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে শুটিং দেখাবে, আবার ভাবছিল উত্তমকুমারকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেবে নাকি-কী করলে লতিকা ভীষণ খুশি হবে-তাই ভাবছিল অশোক। লতিকাও আনন্দে ভরে ছিল। ব্যালকনির সমস্ত টুনিবাল্ব যেন একসঙ্গে জ্বলে উঠেছিল-দিন হোক রাত হোক, তারা জ্বলেই রইল বারান্দায়, সুইচ অফ করতে যেন সবাই ভুলে গিয়েছে।
অশোকরা ফিরে গেল শুক্রবার-লতিকার কাননদেবী পার্কের দিকটায় থাকেন, এ গলিতে অসুস্থ মা কে দেখতে আসেন প্রতি শনিবারে- পরেরবার এলে কাননদেবীর সঙ্গে দেখা হবে। এযাত্রায় অশোকের কাননদেবী দর্শন হল না-লতিকা সামান্য আক্ষেপ করছিল।
৩
অষ্টমঙ্গলার ঠিক কুড়ি বছরের মাথায় ক্যান্সার ধরা পড়েছিল লতিকার। বহুদিনই একটা লাম্প পুষেছিল বুকে। যখন বোঝা গেল, অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে রোগ। ডাক্তার খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন লতিকাকে, অশোককে। বলেছিলেন, ভ্গবানকে ডাকুন। মির্যাকল তো হয়ও।
বাড়ি ফিরে খিলখিল করে হেসেছিল লতিকা- 'একদম মিলি । পুরো মিলি। জয়া ভাদুড়ির সেই সীনটা মনে আছে?'
অশোক পাগল হয়ে গিয়েছিল যেন- লতিকার ওপর রাগ করেছিল, খ্যাপার মত বলেছিল, 'শুধু সিনেমা , না? শুধু সিনেমা? তুমি মিলি হতে চেয়েছিলে, তাই বলো নি। আমি জানি। সিনেমাই সব তোমার। আমি, বাবলু -কেউ না?'
লতিকা শান্ত চোখে তাকিয়েছিল। বলেছিল-'কেঁদো না।' ওকে নন্দিনী মালিয়ার মত লাগছিল অশোকের । যেন ওরা দুজনে ভ্রমর আর অমল। যেন ওদের জোর করে কেউ সিনেমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে-অভেদ্য এক পর্দায় আটকে গিয়েছে লতিকা আর ও- দম আটকে যাচ্ছে, কিছুতেই বেরোনো যাচ্ছে না - 'ছুটি'র লাস্ট সীন চলছে। সিনেমার থেকে বেরোতে না পেরে অশোক ভাবল, তবে সিনেমাই দেখা যাক।
অশোকদের পাড়ায় ততদিনে সিনেমার ক্যাসেট ভাড়া দেওয়ার দোকান চালু হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন একটা করে সিনেমা আনতে শুরু করল অশোক-লতিকার জন্য। যত্ন করে বেছে বেছে সিনেমা আনত - হাসি মজা নাচ গানের সিনেমা সব-ইংরিজি হিন্দি বাংলা। লতিকা এই ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল, বলেছিল,' কি ভেবেছ , সিনেমায় মরে যাওয়ার সীন থাকলে আমার কষ্ট হবে? এত নাচ গানের সিনেমা দেখলে মাথা ঝিমঝিম করে না?' তারপর একটু থেমে বলেছিল, ' জানো, ছোটোবেলায় আমিও এরকম করতাম।'
-'কী রকম ?'
-' ভীষণ ভয় পেতাম ছোটোবেলায়-'হরি বোল শুনলেই বুক কাঁপত, রাতে ঘুম আসত না, মনে হ'ত কী হবে? জানো, মা কে কী বলতাম? বলতাম, আমি খুব ভালো মেয়ে হ'ব এবার থেকে। তুমি আর বাবা তাহলে আমাকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দেবে? হি হি।' অশোক কথা ঘোরাতে চাইছিল। জোর করে ঠাট্টার চেষ্টা করল, 'আজ তবে ভক্ত ধ্রুব ট্রুব আনি?'
-' শোনো না, নিজে নিজে চেষ্টা করতাম খুব। এই যে, তুমি যেমন করছ এখন। একটা হাঁদারামের মত। বেছে বেছে বই পড়তাম, পাতা উল্টে উল্টে পথের পাঁচালি পড়েছি, জানো?'
-'তারপরে?'
-'তখন রবীন্দ্রনাথকে পুজো করতাম প্রায়। ঠাকুরের মতো। একদিন ভাবলাম উনিও যেখানে গেছেন, সেখানেই যাবো, ভয় কি? কী বোকা ছিলাম, না'
-'বোকাটা খুকীটা, পাগলীটা...'
-'এই, একদম কাঁদবে না'
ডাক্তারের নিদান ছিল-বড়জোর ছমাস। তার আগেই চলে গিয়েছিল লতিকা।
একবার অশোককে বলেছিল, 'ঠিক কি ভাবে মরে যায় গো? সিনেমা হলে ঢোকার মত? অন্ধকার অন্ধকার, ঠান্ডা, সিনেমাটা কেমন হবে জানা নেই- তাহলে তো ভয় নেই, না?'
৪
ডেন্টাল হসপিটাল থেকে রিটায়ার করে অশোক ওর শ্বশুরবাড়ির একতলায় প্র্যাকটিস শুরু করল। দোতলায় ভাড়াটে, নিচটা বহুদিন খালি। একটা ঘর গলির ওপরেই, যেন গলিটা থেকেই আচমকা ঘর গজিয়েছে- বিয়ের দিন ঐ ঘরেই বসেছিল অশোক- সে ঘরেই তার যন্ত্রপাতি বসালো। নিয়ম করে বসত চেম্বারে, সঙ্গে রতন থাকত, অ্যাসিস্ট্যান্ট। খুব বেশি রোগী হ'ত না। অশোকের কাঁপা হাত, কড়ি বরগা নোনা ওলা পুরোনো ঘরদোর, ধুতি পরা রতন-আতান্তরে না পড়লে কে আর আসবে? অশোক বই টই কাগজ পড়ত। সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছিল । একদম।
বৈশাখের দুপুর। ভোর থেকে যেন আগুনের হল্কা বইছে। অশোকের চেম্বার ফাঁকা। অশোক বসে বসে রাস্তা দেখছিল-রাস্তা মানে গলি-লাইটপোস্টের তলা থেকে ওর চেম্বার অবধি-দুদিকে এখনও সেই সব পুরোনো লাল বাড়ি, ঝুল বারান্দা। পাহাড়ী সান্যাল, কমল মিত্ররা আর কেউ নেই এপাড়ায়। কে জানে হয়ত দেব আছে, হয়ত অঙ্কুশ,আবীর কিম্বা প্রসেনজিত ঋতুপর্ণা। লতিকা থাকলে ঠিক চিনে নিত।
দুপুর দেড়টা নাগাদ একটা গাড়ি এলো। কালো অ্যাম্বাসাডর। লাইটপোস্টের পাশে গাড়ি থেকে একজনকে নামতে দেখল অশোক। এক মহিলা, বেশ লম্বা - হাঁটায় খুব চেনা একটা দুলুনি-কোথায় দেখেছে অশোক মনে করতে পারছিল না- কেমন সিনেমার মত লাগছিল - যেন অনেকদিন পরে অশোক আজ একটা খুব ঠান্ডা সিনেমাহলে ঢুকেছে- সিটে বসে সিনেমা দেখছে, প্রজেকটার চলছে কির কির করে আর পর্দায় কেউ হেঁটে আসছে; ঐ আশ্চর্য হাঁটাকে যেন স্লো মোশনে ধরেছে ক্যামেরা। মন্থর গমনে সে আসছে আর আসছে-ক্রমশঃ লালবাড়ির রং বদলে যাচ্ছিল, রোদের প্রখর তেজ কমে কমে মেদুর আর কিছুটা অপার্থিব - একটা সাদা কালো ছবির লংশট যেমন হয়। অশোক সিনেমার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে না কি সিনেমাই পর্দা থেকে বেরিয়ে এসেছে গলিতে-এই সব ভাবতে চাইছিল অশোক। ক্যামেরা যেন জুম করল তখনই , সব রং ফিরে এল চরাচরে আর অশোক অবাক হয়ে দেখল, বৈশাখের দুপুরে সুপ্রিয়া দেবী হেঁটে আসছেন তাঁর চেম্বারে- নীল শাড়ি সহস্রবুটি, বড় খোঁপা, গোল গোল রোদ্চশমা- অশোকের সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। রতনকে জল দিয়ে যেতে ডাকছিল অশোক।
সুপ্রিয়া দেবী এখন অশোকের একেবারে সামনে- রোদ চশমা খুলে হাসছেন- 'একটু দেখবেন , আমার দাঁত?'
অশোক দেখল তার একদম সামনে সুপ্রিয়া- দেখল সুপ্রিয়ার কপালে চন্দন, হাল্কা ঘাম, সিঁদুরের গুঁড়ো, দেখল চোখের কাজল, আর হাসি-গজদাঁত দেখা যাচ্ছে-দাঁতের পাটি এবড়োখেবড়ো, অসমান।
অশোক হাত বাড়িয়ে দিল; বড় শান্তভাবে বলল-'এসো।'
Comments
Post a Comment