অলীক পয়লা
বড়পিসিমা
আর ভালোজেঠু গল্প করতে করতে হাঁটছিল। মাথায়
রোদটুপি, হাতে লাঠি। মা আর চন্দ্রামাসির কালো রোদচশমা।একটু পিছনে হুইলচেয়ারে দাদাভাই
- সোনামা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। দিদা একা হাঁটছিল।
নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিচ্ছিল ছোটো ডাল, ইউক্যালিপ্টাসের বাকল। কাশফুল ফুটেছিল। সাদা নয়,
ঈষৎ কালচে ছোপের । চন্দ্রমাসি দুটি কাশ তুলে একটি মা র হাতে দিচ্ছিল। বড়পিসিমা ঘাড়
ঘুরিয়ে বলছিল, বাসু আর কমলা আইলে ভালো হইত। ওরা সাতজন এসে পৌঁছেছিল সিডনিতে, গতকাল।
ভরা জ্যোৎস্না ছিল। বাগানের ম্যাগনোলিয়া গ্র্যান্ডিফ্লোরা
গাছে সাদা বড় ফুল। বিকেলের বৃষ্টিতে ঝরে ঘাস জুড়ে ছড়িয়েছিল। দক্ষিণ গোলার্দ্ধে এখন
শরৎ। মা বাগানে পা দিয়েই বলেছিল, সিডনিতে বকুল গাছ নেই?
পয়লা
বৈশাখে ব্লু মাউনটেনে চড়ুইভাতি। খুব ভোর ভোর বেরোতে হবে। রান্না করে ফেলতে হবে রাতেই।
ব্লু মাউন্টেনের পিকনিক স্পটে বার্বি কিউ করা যেত; কিন্তু এতো পয়লা বৈশাখের খাওয়া-
ঘি ভাত, কাঁকরোলভাজা, পটলের দোলমা, দই মাছ, চিংড়িমাছের মালাইকারি, মুরগীর মাংস, পায়েস
..... রাতে তাই রান্না হচ্ছিল। কাঁকরোলভাজা হয়ে গিয়েছিল। দিদা জিগ্যেস করছিল কতটা চাল
নেবে ঘি -ভাতের জন্য। ভালো জেঠু টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছিল-নিউজ দেখে চ্যানেল ৯এ প্রিমিয়র
লীগের খেলা দেখছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল-বেশিই ন্যান। অতটা পথ, ক্ষুধা লাগব। পটলের ভেতর
থেকে চুলের কাঁটা দিয়ে হাল্কা হলদে সবুজ বীচি
বের করে আনছিল মা, চন্দ্রামাসি পাশে বসে কথা বলছিল, পটলের বীচি বের করার পরে পুর ভরছিল
পটলে। আলু আর কিশমিশের নিরামিষ পুর। বড়পিসিমা দই মাছ রান্না করছিল। সোনামা ব্যস্ত ছিল দাদাভাইকে নিয়ে। গলায় ন্যাপকিন
বেঁধে , চামচ করে ছানা খাওয়াচ্ছিল দাদাভাইকে, দুঢোক করে জল। ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে গড়িয়ে
আসা জল মুছে দিচ্ছিল আলতো করে। খুব খুশি দেখাচ্ছিল দাদাভাইকে। বস্তুতঃ সকলকেই। একটা
লেবু রংএর আলো আসছিল কোথা থেকে- মার গালে পড়ছিল, দিদার কপালে, চন্দ্রামাসির ঠোঁটে,
পিসিমার চিবুকে। খুব সুখী দেখাচ্ছিল সবাইকে। সুখী আর আনন্দময়। সমস্ত রান্নাঘর জুড়ে
সুবাস উঠছিল-ঘির, গরম মশলার, ওথলানো দুধের।
ছড়িয়ে যাচ্ছিল বাড়িময়। পাড়ায়। এভাবেই পয়লা বৈশাখ আসছিল সিডনিতে। রান্না হয়ে
গেলে সবাই অল্প করে রাতের খাওয়া খেলো। খই দুধ, দুধ রুটি, ভাত, পাৎলা মাছের ঝোল, গন্ধরাজ
লেবু, কাঁচা লংকা।
কাল
ভোরে ওঠা। অনেকটাই পথ। ভালোজেঠু বলছিল-ব্লু মাউনটেনে বাথরুমের ব্যবস্থা কী রকম ? খাওয়ার
পরে, দিদা আর বড়পিসিমা ঘুরে ঘুরে চুল বাঁধছিল। চুলের ফিতে দিয়ে টাইট করছিল বিনুণী।
তারপর মুখে পন্ডস কোল্ড ক্রীম মাখল। দিদা হাতে তুহিনা মাখছিল, পিসিমা বসন্তমালতী।
বাইরের
আকাশ গাঢ় বেগুণী ছিল। বিকেলে বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ পরিষ্কার এবং তারাময়। ঈষৎ হিমভাব। ঘুমোনোর আগে বারান্দায় বসেছিল ওরা।
বাগানে খুব বেশি ফুল নেই এই সময়। শুধু ম্যাগনোলিয়ার হাল্কা গন্ধ আসছিল। বাগানে ক্রিসমাস
লাইট এই এপ্রিলেও নেভে নি। ছোটো ছোটো ফেয়ারি লাইট ম্যাগনোলিয়ার ডাল ঘিরে জ্বলছিল নিবছিল।
দিদা কোনো কথা না বলে গান শুরু করেছিল আচমকাই-
শেষ লাইন দিয়ে শুরু করে প্রথম লাইনে এসে পড়ছিল -'যা কিছু আমার দিতে পারি সবই
সুখ স্বপনের লাগিয়া, আমি স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি, রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া।' স্বর
সামান্য কাঁপছিল শুরুর তীব্রতায় , তারপরে কোমল হয়ে আসছিল দিদার গলা। ফ্রান্জিপ্যানি গাছের ডালে একটা পোসাম বসে আমাদের
এই আলো জ্বলা বারান্দা, শাড়ি পরা লম্বা চুলের মানুষদের দেখছিল জুলজুল করে। মা বলছিল,
এই গাছটাই তো কাঠগোলাপ, না? বড়পিসিমা বলছিল-সমস্ত রাত্র জাগবি নাকী? শুইতে যা। কাল
ভোরে ওঠন লাগব।
সকালে প্রণাম করছিলাম সবাইকে। বড়পিসিমা খড়ম খুলে খালি
পায়ে দাঁড়ালো। ধান দুব্বো দিল মাথায়। বলল-তগো বাগানে ভালো দুব্বা নাই। চন্দ্রামাসি
চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেলো। বলল-কাল আবৃত্তি করার সময় পেলাম না। আজ কর্ণ কুন্তী সংবাদটা
বলব। সঞ্চয়িতা লাগবে না। সব মনে আছে, দেখবি।মা আর দিদার ফর্সা পায়ের পাতা, নীলচে সবুজ
শিরা। বললাম, নেলপালিশ পরবে? আমার কাছে ন্যাচারাল কালার আছে।আনন্দে কাঁদছিল দাদাভাই।
এরকম অকেসনে কাঁদে। সোনামা মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল।
এম
ফোর দিয়ে গেলে সিডনি থেকে ব্লু মাউনটেন যেতে ঘন্টা দেড়েক। ঘুরপথ নিলাম-উইন্ডসর কুরজঙ
হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। রাস্তাটা সুন্দর। চন্দ্রামাসি আবৃত্তি করছিল, গান গাইছিল মা। কাটুম্বাতে
সামান্য সময় থেমে ছিলাম। ক্যাফেটেরিয়ার বেঞ্চে বসে কফি। বাথরুম ঘুরে এসে জেঠু বলছিল -ব্যবস্থা ভালই। ক্যাফের লাগোয়া
মেমেন্টো শপ থেকে সোনামা পিকচার পোস্টকার্ড কিনে দিচ্ছিল আমাকে। বলছিল, চিঠি লিখিস। মা দিল টি শার্ট, টুপি। তাতে ব্লু মাউনটেন্স লেখা। কাটুম্বা থেকে একো পয়েন্ট। থ্রী সিস্টারস
পাহাড়। তিনবোন পাথর হয়ে গিয়েছিল এখানে-আদিবাসীদের
মধ্যে প্রচলিত এই গল্প শুরু করতেই পিসিমা বলল-কইসিলি তো এই গল্প। এখন শুধু দেখি। এই বলে , একো পয়েন্টের টেলেস্কোপে ডলার ফেলে চোখ
লাগালো।
বাষ্প
উঠছিল পাহাড় বেয়ে। দূরের নীলচে সবুজ পাহাড়ের ওপরে মেঘের নৌকো। ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধে
বাতাস সামান্য ভারি। দুপুরের আলোয় ঝকঝকে সোনালী তিন বোন পাশাপাশি।দিদা আর চন্দ্রামাসি
রেলিংএর পাশে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখছিল। হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে আসছিল সোনামা। মা ছবি তুলছিল
সোনামা আর দাদাভাইএর। জড়িয়ে জড়িয়ে দাদাভাই
বলছিল-'আকাশে উড়িছে বকপাঁতি।' সোনামা মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল রুমাল দিয়ে, বলছিল-খুশি
হলে এইরকম গায় তো। জেঠু বলছিল-সুন্দর, অতি
সুন্দর।
হেরিটেজ
সেন্টার থেকে একটা ছোট্টো বুশওয়াকিংকের ট্রেইল পেরোলেই চড়ুইভাতির জায়গা। এই ট্রেইলে
কিছুটা সমতল,কিছুটা উঁচু নিচু ঘাসজমি, টুকরো টাকরা গাছের ডাল পড়ে আছে। পায়ের পাতা ভেজানো
জলে সবুজ পাথর। সাবধানে পা ফেলে পার হচ্ছে ওরা।
আমার দু হাতে খাবারের টুকরি। দূর থেকে চড়ুইভাতির জায়্গা দেখা যাচ্ছিল। ঘোড়ারা
চরছিল দূরে। দিদা হাঁটতে হাঁটতে গল্প বলছিল-সবাই
ভূত দ্যাখে না, ঘোড়ারা ভূত দ্যাখতে পায়। আমার পিসামশাইএর ঘোড়ায় ভূত দ্যাখতো....'
চড়ুইভাতির
জায়্গায় পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা। সতরঞ্চি বিছিয়ে
খাবার সাজাচ্ছিল চন্দ্রামাসি আর মা। এ জায়্গা সমতল। সবুজ ঘাস। দুদিকে টিলা। পাখি ডাকছিল।
এই সময় , টিলার ওপার থেকে আরও মানুষ আসছে দেখলাম। ছোটো বিন্দুর মত দেখছিলাম প্রথমে
তারপর বড় হয়ে ধুতি পাঞ্জাবি, শাড়ি পরা মানুষ। হাতে খাবারের টুকরি, কাশফুল, ইউক্যালিপ্টাসের
ডাল - পাতা সমেত। আনন্দময়, হাস্যমুখ মানুষজন। আরো কাছে এলে চিনতে পারি বৈশাখীদির মা,
শ্রাবণীর বাবা, শান্তনুর কাকীমা, মিঠাইএর দিদা, দেবাশিসদার বোন.. প্রবাসীদের মা, বাবা, জেঠু, কাকিমা, পিসিমা, আত্মজন। সবাইকে চিনিনা। কয়েক্জনকে দেখেছিলাম ছবিতে
-মালা পরানো ছিল।
তারপর,
হই হই করে চড়ুইভাতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। টিলাগুলির মাঝখানে সমতল জায়গাটুকু। সবুজ ঘাস।
শতরঞ্চি বিছানো। আড্ডা, গান, গল্প, আবৃত্তি..।
ক্রমশঃ বেলা গড়াচ্ছিল বিকেলের দিকে। আমাদের ফিরতে হতই। পরদিন অফিস, স্কুল কলেজ। পিসিমা
বলছিল-যাওন নাই। মঙ্গলমত আইস্যো। সন্ধ্যার মুখে আমরা, প্রবাসীরা নিচে নেমে আসছিলাম।
শহরের দিকে। গানের আওয়াজ আসছিল। টিলার ওপর
থেকে হাত নাড়ছিল সবাই। আনন্দময়, হাস্যমুখ মানুষজন,
আনন্দিত বৃক্ষলতা, পশুপাখি। বলছিল, ভালো থাকো।
darun laglo.. khub sundar. mone hochhe, sydneyr ei rup dekhte pachhi. toamder okhane ekhan kakrol paoya jay khuuuuuuuuub sundor bhabna, lekhao. subho naba barsho
ReplyDelete