সার্কাসের আলো


বেগুণী আকাশের তলায় সার্কাসের তাঁবু আলোর মালায় সেজে আছে। শহর থেকে অনেকখানি দূরে। বৌভাতের সন্ধ্যায় ঈষ জবুথবু কনে বৌ ঘোমটা টেনে বসে। তাঁবুর ছাদের পরিধি বরাবর গোল গোল  নীলচে হলদেটে আলোর বল এক টানা সাজানো।  মস্ত বড় মেরি গো রাউন্ড - মাঝখানে লম্বা সামোভারে  সাদা গোল আলো- লাল, নীল, কমলা চায়ের কাপ ঘুরে চলেছে। বাচ্চারা হুটোপাটি করে খেলছে;  মা,বাবা, ঠাকুমা, দাদু আইসক্রীম , পপকর্ন কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে।  কর্নকবের চাহিদাও খুব। আর গরম কফির। বাতাসে সামান্য হিম রয়েছে। 

খুব দূরের লাগছে সব কিছু। এবং অবাস্তব। একটু আগে মুখ থেকে  হঠা পড়ে যাওয়া লেবু লজেন্সের মত চাঁদ উঠেছে টুপ করে।  ভেজা আর সামান্য ক্ষয়ে যাওয়া। ঘাসজমি থেকে বড় রাস্তায় উঠলে  সিডনির স্কাইলাইন দেখা যাচ্ছে। চাঁদের নিচে মরা ঘাস, নুড়ি বিছানো জমিতে গাড়ি পার্ক করে তাঁবুর দিকে হাঁটছে সবাই।  হাল্কা হলুদ মাঠে  দুটি তিনটি ছায়া পড়ছে এক এক জনের সবাইকে খুব অন্যরকম লাগছে ফলতঃ।  মনে হচ্ছে,  সবাই সার্কাসের লোক।  আসলে এই সব আলোয় এক ধরণের বিভ্রান্তি জন্মায়। বিভ্রান্তি কিম্বা মায়া।

এই আলোয় গ্রাহামকে আবার দেখলাম। আরও বুড়ো হয়েছে গ্রাহাম, আরও একটু ভারি যেন আর সামান্য কুঁজো।  ফোলা ফোলা গাল, কাঁচা পাকা চুল হাল্কা হয়ে এসেছে, গোল ফ্রেমের চশমা, ছাঁটা গোঁফ। ঝুঁকে হাঁটছিল। সঙ্গে তিনটি বাচ্চা -পপকর্ন কিনে দিচ্ছিল গ্রাহাম।  ছোটো ছেলেটা গ্রাহামের শার্টের কনুই ধরে টান দিয়ে আঙুল তুলে মেরি গো রাউন্ডের দিকে দেখালো। গ্রাহাম মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মনে হল। বাচ্চাটা ছুটে গেল গ্রাহাম অন্য বাচ্চাদুটির সঙ্গে  তাঁবুর দিকে এগোচ্ছে দেখলাম হাতে ধরা পপকর্ন।  কফি স্টলের সামনে দাঁড়ালো। দুটো তিনটে ছায়া পড়ছে ওর।

গ্রাহামের গল্পরা এই রকম ছিল। সার্কাসের তাঁবুর সামনের ছায়াদের মত। প্যাট্রিক যেমন  বাকিংহাম প্যালেসের গল্পটা জানত, আবার গানের গল্প টা আমাকে বলেছিল গ্রাহাম।  যে গ্রাহাম, যে  একজন ডি জে -এসবই গ্রাহাম বলেছিল আমাকে। ট্র্যাশ নিতে এসে।  প্রতিদিন  অফিসের কিউবিকল থেকে ট্র্যাশ নিয়ে  যেত -ফোলা গাল, গোল চশমা, ছাঁটা গোঁফ। একদিন আমার কিউবিকলেই গানের গল্পটা শুরু হয়ে যায়। যেমন আজ, এই তাঁবুতে সার্কাস শুরু হবেই অথচ এই পপকর্ন, এই কফি আর বাতাসের হিম যেন শুরুটা তৈরি করে দিচ্ছে,  সেদিনও একটা আই পড ছিল ঠিক তেমনই - গ্রাহামের গল্প শুরু করার জন্য।   আই পডে চার্জ দিতে দেখে জিগ্যেস করেছিল কি গান শুনি। তারপর , আচমকা শুরু করেছিল বিস্কুটের টিনের মধ্যে  ট্র্যান্সমিটার বানানোর কথা। আসলে  সবই ছিল  ষাটের দশকে ব্রিটেনের গান শোনার গল্প।  সেদিন গল্পে পেয়েছিল গ্রাহামকে। কালো বড় ট্র্যাশব্যাগ হাতে গ্রাহাম অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। বলছিল পাইরেট রেডিওর কথা।  বলছিল, সেই সময়  ব্রিটেনে একমাত্র স্বীকৃত রেডিও সার্ভিস  বি বি সি রক বা  পপ  ব্রডকাস্ট করত  না;  গ্রাহামরা তখন অনেকে সমুদ্রের ওপরে জাহাজ থেকে রক, পপ বাজাত। ব্রডকাস্ট করত ব্রিটেনে। রেডিওয়। গ্রাহাম বলেছিল সেসব অবৈধ ব্রডকাস্ট ছিল। ইল্লীগাল। লীর ওপর খুব জোর দিয়েছিল, হেসেছিল।  আমার কিউবিকলে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গল্প বলছিল গ্রাহাম। সমুদ্র আর গান। আসলে,  গ্রাহাম সমুদ্র বলে নি, বলেছিল ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার, বলেছিল সে সব রেডিও স্টেশনকে পাইরেট স্টেশন বলত সবাই। চশমা ঠিক করেছিল গ্রাহাম। চুলে আর গোঁফে হাত বুলিয়েছিল। তারপর জিগ্যেস করেছিল, দ্য বোট দ্যাট রকড দেখেছি কি না। না বলতে কোকের ক্যান তুলে ওর ব্যাগে ফেলেছিল, মৃদুগলায় বলেছিল সিনেমায় ওকে এন্সেমবল করা হয়েছে। এনসেম্বলই বলেছিল গ্রাহাম।

তারপর হঠা একদিন প্যাট্রিক এলো ট্র্যাশ নিতে। বলল,  গ্রাহাম এখন সি ওর অফিস পরিষ্কার করে। তারপর মুখ বেঁকিয়ে বলল - তো  আগে বাকিংহাম প্যালেসে ক্লীনার ছিল। সি ওর অফিসের কাজ তো ওকেই দেবে। আমি বললাম -তুমি জানলে কি করে?   বলল কেন গ্রাহাম বলেছে। তোমাকে বলে নি?

আসলে,পাইরেট স্টেশনের গল্পটা আরও অনেকে জানত, বাকিংহাম প্যালেসেরটাও। প্যাট্রিক ছাড়াও স্টীভ, ক্রিস আরও কেউ কেউ। স্প্রুইকিংএর গল্পটা শুধু আমার একলার ছিল। গরমের দুপুর ছিল। স্টেশনের পাশে সস্তা জিনিষের দোকান - বার্গেন ওয়ার্ল্ড। দোকানের ভেতর প্লাস্টিকের ফুল, নাইলনের দড়ি, চটি,পাপোষ,  হ্যালৌইনের ছদ্মবেশ , ঘর সাজানোর পুতুল, আয়্না, টেবিল ক্লথ, বেলুন, কাগজের গ্লাস, থালা, বাটি, প্লাস্টিকের কাটলারি। সেদিন দেখলাম অজস্র বেলুন, রঙীন শিকলি, লোকের ভীড় আর ভীড়ের মধ্যে গ্রাহাম। চমৎকার সুট, বো, চকচকে জুতো। মাথায় টুপি। হাতে মাইক্রোফোন। স্প্রুইকিং করছে গ্রাহাম। অনর্গল বলে যাচ্ছে শস্তার চটি পাপোষ ফুলদানির কথা- লোক ডাকছে, গান গাইছে, রসিকতা করছে চোখ মটকে-আমাকে ঠিক দেখতে পেলো গ্রাহাম। টুপি খুলল, হাত নাড়ল তারপর আবার শুরু করেছিল। এই সব চটি, এই পাপোষ, ফুলদানি যে ভারি আশ্চর্য রকম - এসব বলছিল। বলছিল ম্যাজিকাল, বলছিল বাড়ি বদলে যাবে।   গমগম করছিল ওর গলা।  একটা সুর ছিল , যা লোক টানে। ওকে ঘিরে ভীড় জমছিল। সরু সাইডওয়াক। তবুও। রাজার মত লাগছিল ওকে। কিম্বা খুব শক্তিশালী কেউ একজন। কবি বা বিপ্লবী।

 

তাঁবুর নিচে সার্কাস শুরু হয়ে গেছিল বহুক্ষণ।  গ্রাহাম বসেছিল  চার নম্বর রো তে।   সঙ্গে  বাচ্চা  তিনটে  - পপকর্ন খাচ্ছে ,  চোখ সরছে না অ্যারেনা থেকে।  দেখলাম,  এক হাত দিয়ে সব থেকে ছোটো ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরল গ্রাহাম। কানে কানে কিছু বলল। গল্প বলছে মনে হচ্ছিল।

সার্কাসের লোকেদের লাল, নীল, সবুজ, ঝলমলে জামা, বুকে তারা আঁকা। টকটকে লাল জামা ,বুকে সোনালী তারা নিয়ে সিংহকে  উঁচু টুলে বসাচ্ছিল একজন।  কথা শুনলে মাংসের টুকরো দিচ্ছিল। তারপর সওয়ারহীন, লাগাম ছাড়া ছটা ঘোড়া নিয়ে অ্যারেনা  তোলপাড় করছিল লোকটা। এরপরে  তাঁবু অন্ধকার হয়ে নীল আলো জ্বলে উঠছিল। ট্র্যাপিজের খেলা শুরু হবে।  বাজনা বাজছিল ঝমঝম করে -  অ্যারেনায় ঢুকছিল খেলোয়াড়রা হঠা  মনে ', ট্র্যাপিজ বারে দেখব গ্রাহামকে। রুপোলী সবুজ জামা, আর বুকে একটা তারা। কোমরে হাত রেখে আলতো দোল খেয়ে নেবে প্রথমে , তারপরে দোলা বাড়িয়ে অন্য দোলনায় ঝাঁপ দেবে। ফোলা গাল, গোল চশমা, ছাঁটা গোঁফ-বুড়ো গ্রাহাম
টকটকে লাল জামা, বুকে সোনালী তারার মুখটাও দেখা হয় নি।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস