মজলিশ ২০১০

প্রিয় মজলিশি,

প্রাত্যহিকতায় বসত করে যে অ-প্রাত্যহিকতা, তুমি তাকে চিনে নাও? কখন্‌ দৈনন্দিন গ্রাস করে নেয় তোমার অলীকমুহূর্তসকল? আবার খুঁজে পাও। পাও তো? দৈনন্দিনেই। কিম্বা অপ্রাত্যহিকতায়। তুমি জানো।

হাইওয়ে থেকে বাঁহাতি একজিট্‌। সামান্য এগোলে রাউন্ড অ্যাবাউট। গতানুগতিক। যেমনটা দেখা যায়। ডানদিকে টার্ন নিলে স্লোপ। রাস্তা খাড়াই । রাউন্ড অ্যাবাউট থেকে যখন পা রাখছ এ রাস্তায় অথবা গাড়ির চাকা, সেই মুহূর্তে জানছই না কোথায় যাচ্ছ। উঁচু রাস্তা। ব্যাস-এটুকুই দেখছ শুধু। হাল্কা দম নিয়ে পা রাখছ খাড়াই পথে অথবা অ্যাক্সিলেটরে পায়ের চাপ বাড়াচ্ছ খাড়াই পার হতে। হঠাৎই ভেসে আসছে সমুদ্রগন্ধ।শুনতে পাচ্ছ সমুদ্রগর্জন। তোমার মনে হচ্ছে-কি জানি কেন মনে হচ্ছে-তুমি নিজেই জানো না কেন ভাবছ এই খাড়াই পেরোলেই সামনে সমুদ্দুর। এই পথ তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তোমার চেনা কোনো সমুদ্রপথের কথা। হয়তো।আবার হয়তো তুমি ছুটি চাইছ মনে মনে । তাই মনে আসছে সমুদ্র। যেখানে ছুটি কাটাতে চাও তুমি। আবার প্রতিদিন দু বেলা এ পথ যদি পার হতে হয়, তোমার মনে আসবেই না সামনে সমুদ্দুর। স্পীড লিমিট নিয়ে সচেতন হবে ঢালুতে নামতে আর তিন কিলোমিটার গিয়ে লেফট লেন নেওয়াটা মাথায় থাকবে শুধু। প্রাত্যহিকতা গ্রাস করে নেবে তোমার পথ পেরোলেই সমুদ্দুরকে। কিন্তু, ধরো আবার যদি বেশ খানিকটা সময়ের ব্যবধানে এ পথে আসো, হঠাৎ-ই, ধরো ছ মাস... এক বছর.. এই চমকটা ফিরে আসবে। টার্ণ নেবে খাড়াই রাস্তায়। সমুদ্রের গন্ধ পাবে। আবারও।

অনেকটা -কোন্‌ পুরাতন প্রাণের টানে গানটা দীর্ঘদিনের ব্যবধানে শোনো যদি... প্রকৃতি পর্যায়। বর্ষার গান। তুমি শুনছ ।' কোন্‌ পুরাতন প্রাণের টানে/ ছুটেছে মন মাটির পানে।' চেনা শব্দ, চেনা সুর তোমার কানে। তুমি শুনছ- 'চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে, ভাবনা ভাসে পুব-বাতাসে'-তুমি শুনবে এরপর, 'মল্লারগান প্লাবন জাগায় মনের মধ্যে শ্রাবণ-গানে।' এই অবধি একদম চেনা তোমার। মাটি, পুব বাতাস, মল্লার গান। গতানুগতিক। তুমি শুনছ। আঙুলের টোকা দিচ্ছ আলতো। তাল রাখছ। তারপরেই সেই অলীক চমক। তুমি ভুলেই গেছিলে যেন এরপর সাংঘাতিক একটা বদল আছে গোটা গানে। বর্ষা সংশ্লিষ্ট শব্দরাজির বদলে তোমার কানে আসবে 'লাগল যে দোল/ বনের মাঝে লাগল যে দোল।'চমক লাগবে তোমার। রোজ শুনলে প্রাত্যহিকতার ধারাপাতে এ দোলা মিলিয়ে যেত কবে!

তারপর , ধরো, এ বছর পুরী গেছ তুমি। অনেক অনেকদিন পরে। প্রথম দর্শনে যে রোমাঞ্চ ছিল-পুরী স্টেশন থেকে রিক্‌শা নিয়ে যাচ্ছিলে তুমি-ধরো পুরী হোটেলে -বাঁক ঘুরতে কোথা থেকে সমুদ্র এসে তোমার সামনে দাঁড়িয়েছিল। তুমি চিনতে পার নি -ভেবেছিলে আকাশ-তারপর চিনেছিলে-এক পল, দু পল পরে চিনেছিলে-তারপর ভেসে গিয়েছিলে। এই মুহূর্তটা -তোমার এই ভেসে যাওয়া টা-এতবার ফিরিয়ে এনেছ মনে মনে -এতবার, যে সেই শিউরে উঠে ভেসে যাওয়ার অনুভূতি জীর্ণ হয়ে হারিয়ে গেছে। এবারে বুঝলে সেটা। তুমি শিউরে উঠলে না । বুকে চমক লাগছে না তোমার। চোখে দেখ নি এতদিন। তবু হারিয়ে ফেলেছ।মনে মনেই হারিয়ে ফেলেছ। অ্যালবাম উল্টোতে উল্টোতে চেনা হয়ে যায় যেমন ছবির ফ্রেম, ছবির ডেপ্‌থ, শেড। চমক লাগলনা এতদিনের অদর্শনেও। তখন কি করলে তুমি? তিনদিন খুব ঘুরলে -পায়ে হেঁটে, রিক্‌শায়-চক্রতীর্থ, বেড়ীওলা হনুমান, সোনার গৌরাঙ্গ, স্বর্গদ্বার, গুন্ডিচা, গম্ভীরা, জগন্নাথের মন্দির, সিদ্ধ বকুল-গলি-গরু- গজা-পদ্মের মালা-নৌকার চোখদুটি -বালিতে দুটো কুকুরছানা। জগন্নাথের মন্দিরে তোমার মাথায় পড়লো ছড়িদারের লাঠি... শনিমন্দিরে তোমাহেন নাস্তিক স্রেফ জেনেশুনে প্রতারিত হ'ল-তুমি পান্ডার গল্প শুনলে - যা তুমি অসত্য জানো-শুনলে তবু-তোমার কানে কেমন একটা সুর বাজতে লাগলো- ঘুরে ঘুরে বাজতেই লাগল- 'এইখানে, একদিন নদী ছিলেন , মা, এখন সমুদ্র।' তুমি তাকে টাকা দিলে। পান্ডা তোমাকে স্তম্ভগাত্রে গৌরাঙ্গের আঙুলের ছাপ দেখালো। তুমি দেখলে। নিজের অজান্তেই হাত বোলালে স্তম্ভে -নিজের আঙুল আর গৌরাঙ্গের আঙুল মেলাতে চাইলে যেন- তুমি দেখছ দশ আঙুলে দশটি সোনার আঙটি সাষ্টাঙ্গ, ছিন্নবস্ত্রের পাশে, জগন্নাথের সামনে বুক চাপড়াচ্ছে শোকার্ত-দুহাত উঁচু করে আশীর্বাদ চাইছে শয়ে শয়ে ভক্তজন-তোমার মাথার ওপরে দ্বাদশ শতকের খিলান,প্রাচীন ছাদ, তোমার পাশে স্তম্ভগাত্রে গৌরাঙ্গের অঙ্গুলিচিহ্ন আর তোমার চতুর্দিকে থই থই তোমার ভারতবর্ষ, আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষ তোমার।তুমি তো এসব ভুলেই গেছিলে একদম-তোমার খালি পায়ের পাতার তলায় মন্দিরের পাথর-বালি-যেমন তুমি ভুলেই গিয়েছিলে সাদা শাড়ি , নরুণ পাড় সেই পাঁচজনকে-চরাচর ভেসে যাওয়া জ্যোৎস্নায় যারা একদিন গেয়ে উঠেছিল, সে মরণ স্বরগসমান... হঠাৎ পেয়ে গেলে সমুদ্রের সামনে-যখন সে বলল তোমার পাশে বসে-'ঐ যে সমুদ্রর আওয়াজ , আমার বুকে আজ পাঁচ বচ্ছর সে আওয়াজ... '
তুমি সব ভুলে গেছিলে। সব ভুলেছিলে তোমার গুগল ম্যাপে, তোমার জিপিএস-এ, বীচ টাওয়েলে, ফিশ চিপস, আর সী গালে। তুমি ফিরে পেলে। এতদিনের অদর্শনে তাকে তুমি ফিরে পেলে। তোমার সমুদ্র। তোমার ভারতবর্ষ।

তোমার প্রবাসে যখন ভীষণ মনে পড়ছে প্রিয়জন, প্রিয় মুখ- মনে পড়েছে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে বারান্দায় আলো জ্বালিয়ে জেঠিমা, পিসিমণি, রাস্তায় পদচারণা ভালোজেঠুর ..তোমার সেই বারান্দা-মাধবীলতায় ঘেরা বারান্দা মনে পড়ছে- প্রাত্যহিকতায় যাকে তুমি হারিয়েছিলে -আজ এত বছর পরে, তুমি সেই বারান্দা আকাঙ্খা করেছ তোমার প্রবাসে, তুষারপাতে, বিষণ্ন সন্ধ্যায়। একদিন হঠাৎ পেয়ে গেছ। প্রথমে বোঝো নি। একদিন নিতান্ত আড়ষ্ট ভঙ্গিতে শুরু করেছ আলাপচারিতা, তীক্ষ্ণ শব্দের তরবারি শানাচ্ছ বারবার-একদিন শিরস্ত্রাণ খুললে, কোষবদ্ধ অসি- অবাক হয়ে দেখলে তোমার মাধবীলতার বারান্দা- তোমার সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত-তোমার পরশপাথর।

প্রাত্যহিকতার বাইরে দাঁড়ালে এসে। দূর থেকে দেখলে তোমার মাধবীলতার বারান্দাকে। তুমি যাকে ছেড়ে যাচ্ছ। ছেড়ে যাচ্ছ তাকে ফিরে পাবে বলে। আবার হঠাৎই এসে দাঁড়াবে একদিন। নতুন মানুষ, নতুন মজলিশি, নতুন তর্ক, নতুন আলাপচারিতা। নতুন, আবার ঠিক নতুন নয়। কখনও খুব চেনা লাগবে তোমার। কখনও অচেনা। আবার ফিরে যাবে। আবার ফিরে আসবে। ফিরে ফিরে আসবে। তোমার সেই বারান্দা -তাকে তো তুমি খুঁজছ না আর-তুমি তো পেয়েই গেছ তাকে-মাধবীলতার পাশে তোমার পরশপাথরকে। সেই পাওয়াকে প্রাত্যহিকতায় হারাতে চাইছ না আর। তাই সরে দাঁড়াচ্ছ।যেদিন আসছ ফিরে, হয়তো খুঁজছ অন্য কিছু । অনাবিষ্কৃত। অথবা পাবে না। আবার আসবে।আসবেই আবার।
ইয়ারো ভিসিটেড আর রিভিসিটেডের মধ্যে সময়ের ব্যবধান খুব সম্ভব সতেরো বছর। অতদিন নয় অবশ্যই। প্রতিবছর আসবে তুমি। এই দিনে। তোমার হাতে দুটাকার সন্দেশ। অচিন ময়রার। আজকের মত।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস