শঙ্খপুরীর রাজকন্যা এবং অন্যান্য
বিপুল দাস; শঙ্খপুরীর রাজকন্যা (কলকাতা ঃ আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০৫ ); পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩০৮; মূল্য একশ পঞ্চাশ টাকা; আই এস বি এন ৮১-৭৭৫৬-৫১৬-৮
লেখকের অন্যান্য গদ্য - এ' লেখায় আলোচিত ঃ
বুল্টির নীল ফ্রক; দেশ পত্রিকা (২০০৩, ১৭ অগাস্ট), পৃষ্ঠা ৫২ -৫৮
রক্তমাংসের পোকা; দেশ পত্রিকা (২০০৫, ২ মার্চ ), পৃষ্ঠা ৫০ -৫৫
তৃষ্ণা-বলয়; দেশ পত্রিকা (২০০৫, ১৭ নভেম্বর ), পৃষ্ঠা ৭০ -৭৭
যদিও দৈনন্দিন ছিল । যেমন থাকে । উত্থান পতন। সাংসারিক শব্দগুচ্ছ। ফ্লাইওভার, শপিং প্লাজা, সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী থার্ড রেল। স্কাইস্ক্র্যাপারের মাথায় ঘোলাটে চাঁদ -নিয়নসাইনে ম্লান। অথচ, সুষনি শাক ছিল না। শাঁখারি ছিল না। রঙীন ফানুস, রাজকন্যা, ময়ূরপঙ্খি নাও-ছিল না। অসম্ভব ছিল অলৌকিক মিউজিক, সাইকেলের প্যাডেল বেয়ে নামা দাবনার দাপট অথবা কামনা। বেঁচে থাকার সুখ। বীজতলা কিম্বা চাঁদসূর্যের আকাঙ্খা। ছিল না বিষাদজলে জেগে থাকা দোলনচাঁপাটি। অথবা একটি পাঁচকোণা তারা। তার অভ্যন্তরে আকাশপ্রদীপ -গৃহস্থের গোপন বাসনা।
ছিল না। আবার ছিলও তো। আর কোনোখানে। অন্য কোথাও। বিপুল নিয়ে এলেন তাঁর গদ্যে। বিপুল দাস। ১৯৭৪এ 'পাহাড়তলি' পত্রিকায় লিখেছিলেন 'অ্যান্টিবায়োটিক'। দেশ পত্রিকায় ছোটগল্প। অবশেষে ২০০৫এ 'শঙ্খপুরীর রাজকন্যা।' ছোটগল্পের সংকলন। প্রাক - উপনিবেশ পাঁচালি আখ্যানের সহজিয়া শৈলীর উত্তরাধিকার - ব্লার্ব এমত বলে।
বিপুলের গদ্য । বিষাদ জলে ভাসে ময়ূরপঙ্খি নাও-
বিপুলের গদ্যের গভীরে অপার রহস্যময়তা, রসবোধ চুইঁয়ে নামে, হাল্কা শ্লেষের আস্তরের তলায়। এবং হা হা বিষাদ। অণুবাক্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেইলসে কখনও নির্মাণ, কখনও তুমুল স্মার্টনেস। প্রাণ সৃষ্টি, অ্যামাইনো অ্যাসিড, কোষ ও কলা- আঙ্গিক কৌশলে বিজ্ঞানপ্রসঙ্গ। নির্মেদ নির্ভার গদ্য । টানটান ছিলা। সপাং চাবুক।
পটভূমি উত্তরবঙ্গ, মফস্সল-ই মূলতঃ। বিবিধ বৃত্তির চরিত্রসব। কবিরাজ, শাঁখারি, বীমার দালাল, মুদি, কুমোর,লেখক, অধ্যাপক। মূল চরিত্র নারী নয় কখনই। অথচ নারী-ই বিপুলের গদ্যের আধার। সূত্রটি গবেষকের থিসিসের উপাদান হতেই পারে। সত্তরের দশক গড়িয়ে আশি, নব্বই , মিলেনিয়াম পেরিয়ে ২০১০। অনুসন্ধিৎসু জানতে চাইবেন গদ্যের বিবর্তন, বদলে যাওয়া দুনিয়া কতখানি প্রভাবিত করেছে বিপুলের গদ্যের বিষয় ও আঙ্গিককে । গল্পগুলির কালানুক্রমিক সূচী সম্ভবতঃ জরুরী ছিল সংকলনটিতে। সেহেতু।
ফানুস, সাইকেল, আকাশপ্রদীপের পৌনঃপুনিক ব্যবহার কি বিপুলের গদ্যের নিজস্ব জলছাপ? তারাশঙ্করের ছায়া উঁকি দেয় কোথাও? গবেষক প্রশ্ন তুলবেন। উত্তর দেবেন।
বিপুলের গদ্যে মজলে এ আলোচনার বাইরে থাকাই অবশ্যম্ভাবী নিয়তি।
সে গদ্য বাঘের মত ঝাঁপায়। গ্রাস করে নেয়। কখনও ঘূর্ণিবাতাস হয়ে এলোমেলো করে ঘরদোর, রোজকার ছক। হয়তো বা অলৌকিক দুপুরের একলা ঘুঘু পাখি। বুকের ভেতর। নাগরিক ব্যস্ততার মাঝে তীব্র অমোঘ ডাক - যে ডাক একবারই শোনে মানুষ। রক্তমাংসকে অস্বীকার করে অলৌকিক এক স্বর্ণচাঁপার আকাঙ্খায়।
কোন মেস্তরি নাও বানাইল...
কখনও হিরো মহম্মদ, ফুরফুরি, অথবা নয়ন মা , ধীরুকাকা, কিম্বা দীপা, মানস, কমলা হয়তো বা। গোবিন্দ আর তার কালো বৌ। কালো বেঁটে কানু ডাক্তার, কনকচাঁপা রঙ অনিতা। ব্রজবল্লভ, সহদেব আর বীথি। সংসারসীমান্তের মানুষজন ।
'হেমা মালিনীর হিরো'তে খুনিয়াজোতের ফরেস্টে হিরো মহম্মদ শা আবদুল করিমের গান শোনে। পিঞ্জিরা পক্ষী নদী, ডিঙি । জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে আসা বউটি বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়।
' হিরো মহম্মদের সমগ্র চেতনা জুড়ে ব্যপ্ত বাউলা অঙ্গের সারি গানের কথামালায় উন্মুক্ত একটি বাদামি রঙের ঈষৎনত ভারী স্তন অদ্ভূতভাবে ক্রিয়াশীল হয়। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে মগজে একটি সাদা গম্বুজ দেখতে পায়। মিনারসহ।'
আধভাঙা ডাল, হিরোর ভেজা নীল লুঙ্গি,ফুরফুরির টানটান শরীর, হিরোর নতুন সাইকেল, স্পোক, হ্যান্ডেল,থাই গড়িয়ে প্যাডেলের দিকে নামা নিষিদ্ধ সুখ যেন জগৎ জুড়ে রূপকথার মত ছড়িয়ে পড়ে। জলে নামে চিরকালের কাঙাল পুরুষ, পারঘাটায় মেয়েটি যেন সময়, দাঁড়িয়ে থাকে গর্ভবতী হওয়ার প্রতীক্ষায়।
'মদনের গুপ্তকথায়' দাদার অন্নে প্রতিপালিত 'গাড়োল' ধীরেন দাস কামনা করেছিল নয়নকে।...নয়নের বর 'মার্ডার' হ'লে সে নয়ন- মা বনে যায়। সাপে দংশানো মানুষকে বাঁচায়। লোকমুখে মিথ তৈরি হয়। সাপে কাটা ভাইপোকে বাঁচাতে নয়নের কাছে আসে ধীরেন। একটি মৃত্যু - আশংকার ব্যাকড্রপে দুজনের মিলন । মিলনবর্ণনে মিনার কিম্বা গম্বুজের আকার ফিরে ফিরে আসে, বারংবার আসে রংখেলা, কর্দমহোলি।
'দ্বন্দ্বমূলক' এ ধলা রঙের গোবিন্দ। কটা চুল, কপিশ চোখ।
'লোকে বাপের নাম জানতে চায়, চোদ্দোপুরুষের সুলুক খোঁজে ।' ... মালিকের গুরুদেবের কাছে যায় শরীর শুদ্ধ করতে। অপমানিত হয় চরম।
এরপর..' এপারে নিমতিতা ফরেস্টের ভেতর আদিম অন্ধকার। মাঝে আবর্জনা বয়ে নিয়ে যাওয়া খালের ধারে প্রাগৈতিহাসিক শুয়োরের পিঠে বসে গোবিন্দ ঈশ্বরের লীলা দেখে।... মনে হয়, কতজন্ম আগে দেখা এই কানন, এই জল ও এই ধেনুসকল। এই গোষ্ঠ তার ছিল... চাদর সরিয়ে সে তার চামড়ার রং দেখার চেষ্টা করে...একসময় সমস্ত শরীর আবৃত করতে থাকে কালো মাটির আস্তরণে। তার সমস্ত শরীর ঢেকে যায় যমুনাতীরের কর্দমাক্ত পলল মৃত্তিকায়.... তার গালে পঙ্কিল মাটির স্তর জমাট বাঁধতে থাকে।' যখন সে বাড়ি ফেরে, কালো বৌটি তার পাশে এসে দাঁড়ায় লম্ফ হাতে-'পাগল হইছ নি?' বাঘ ডাকে। অঙ্গে জোয়ার। কালো শরীর , সাদা শরীর মিলে মিশে যায়। মুহূর্ত আগের চরম একাকীত্বের শৈত্যকে আলিঙ্গন দেয় জোট বাঁধার উত্তাপ।
'তৃষ্ণা-বলয়' এ মুদি দোকানের ব্রজবল্লভ, হোটেল মালিক সহদেব আর বীথি শর্মা, যে শিলিগুড়ির হোটেলে কাজ করে, হোটেলের কাজে মন্দা থাকলে ফ্লাইং কাস্টমার ধরে। বীথির ঘরে যায় ব্রজ আর সহদেব। পঞ্চাশ পার হওয়া দুজন মানুষ। 'অতৃপ্ত থাই গড়িয়ে বিষাদ চেন হয়ে চাকায় পৌঁছয়। ' পাশাপাশি দুই সাইকেলে। সহদেবের দেওয়া শাড়ি প্রত্যাখান করে বীথি। অথচ 'ব্রজর তুলে ধরা ঠোঁটে উমম করে একটা চুমু' দেয় ।...'অবিকল অনেক রাতে ঘাটের সামনে বড় মাছের ঘাই মারার শব্দ।'
দৈনন্দিনের মধ্যে এভাবেই তৈরি হয়ে যেতে থাকে নতুন কক্ষ পথ অথবা তৃষ্ণাবলয়। রোজকার ডিঙিটি কোন মন্ত্রে ময়ূরপঙ্খি নাও।
বিপুল লেখেন, ' অনন্ত কুয়োর গভীর থেকে অনেক রাতে উঠে আসে প্রাচীন কাতলা। তার নাকে নথ, পিঠে শ্যাওলা। ঘাটের সামনে এসে জলে ঘাই মারে। কার্তিক মাস জুড়ে গৃহস্থের গোপন বাসনা নিয়ে আকাশপ্রদীপ জ্বলে বাঁশের মাথায়। প্রাণের প্রদীপ জ্বলতে থাকে, জ্বলতে থাকে।
আর এই সব টানাপড়েনে মানুষ কেমন পাগল হয়ে যায়।'
রক্ত ও জলের আপেক্ষিক ঘনত্ব
নীপার সঙ্গে ভালবাসার বিয়ে ফিলসফির স্যার অমিতের । সৌম্য, মার্জিত । বিয়ের পরে, 'আস্তে আস্তে আর একজন অমিতকে সে দেখতে পাচ্ছিল।... এমনকী কোন বন্ধু নীপার ফিগার দেখে কী বলেছে-সেসবও সাতকাহন করে বলত আর হাসত...'
একবার সমুদ্রে গেল ওরা। হোটেলে ডাবল বেড রুম চেয়ে প্রত্যাখাত হল অমিত । ... ' দুচোখ ভরে নীপাকে দেখে। হাসতে থাকে। তার সমস্ত দাঁত বেরিয়ে যায়।
ওরা তোমাকে কি ভেবেছে জানো? .. ঘর আছে, দেবে না। আসলে বড় হোটেল তো, এখানে ওসব অ্যালাউ করে না।'
শুভাশুভ বোধ বলা চলে। অথবা রক্তে লালিত সংস্কার। মেলে নি ।
'সুরক্ষাপত্র' গল্পে, কলকাতার দীপা বিয়ে হয়ে চলে আসে গ্রামের দিকে স্বামীর কোয়ার্টারে।
বিপুল লেখেন, ' দীপার জগত থেকে খুব ধীরে ধীরে ট্রাম, মেট্রো, পঁচিশে, বৈশাখে রবীন্দ্রসদন, হাতিবাগানে কেনাকাটা , কলেজ স্ট্রীটের বইয়ের দোকান - সব বিবর্ণ হতে থাকে। শুধু মাঝে মাঝে মা'র কথা মনে পড়ে... ভীষণরকম মাকে মনে পড়ে।'
দীপার এই নতুন জীবনে আসে এক সবজিবিক্রেতা বৃদ্ধা। আসে তার বলিরেখা, ধামা ঝুড়ি নাতি, লাউডগা, ঢেঁকিশাক, কলমি শাক, হেলেঞ্চা সমেত। লাউচারা পোঁতে দীপা রান্নাঘরের পাশে। বিপুলের গদ্যে এরকম, 'রাধানগরে এক শীতের সকালে দীপার মাটির উঠোনে এক বুড়ি যেন তার নিজস্ব ওয়েবসাইট খোলে। দীপা সার্ফিং করতে থাকে। মনে হয় এক দীর্ঘ অদৃশ্য হাত বিডন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে দিগন্তপ্রসারী হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে রাধানগরের উঠোনে এসে দীপার মাথায় বিলি কাটে।'
বিবাহবার্ষিকীতে অধিকরাতে বাড়ি ফেরে তার স্বামী। মাতাল। আবরণ খসে পড়ে। ভেতরের চেহারা উঁকি দেয়। তর্জনী ওঠে দীপার দিকে। অপ্রত্যাশিত।
' ঘর থেকে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসে দীপা। ..... মাটি থেকে যুইঁফুলের তীব্র গন্ধ এবং রাতের আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়া দোক্তাগুন্ডির গন্ধ মিশে গেলে এক অদ্ভূত স্নেহময় বাস বাতাসে ভাসতে থাকে। সংপৃক্ত করে ফাল্গুনের রাত্রিকে।'
দীপা উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের পাশের লাউচারার কাছে বসে। আশ্রয় খোঁজে, পায়।
তোমার তুলনা তুমি, প্রাণ
লাউএর চারার মত প্রাণের এই ওমটি বাহিত বিপুলের সামগ্রিক গদ্যেই। সমস্ত লেখায়। বারংবার এসেছে প্রাণ। জীবকোষ, জল, ক্লোরোফিল, শেকড়বাকড়, শ্বাসবায়ু, লাবডুব।
কোথাও পরিত্যক্ত অবৈধ প্রাণটিকে রাষ্ট্রের যান্ত্রিক হাত থেকে আগলে রেখেছে পুলিশের গুলিতে অকালমৃত নক্শালের 'মেন্টাল কেস' ছেলে।
আবার 'নকুলদানা ও গোকুলদানা'য় জীবন বীমার এজেন্ট সুধীর কাঞ্জিলাল প্রাচীন চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভেবেছে,'উপযুক্ত প্রিমিয়াম কেউ দিলে ঐ প্রাচীন চাঁদের কেন বীমা হবে না।... কোনদিন যদি খসে পড়ে। যদি অমোঘ জাঁতায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে মিহি জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশে। যদি গলে যায় সংসারের তাপে । ' আর দিগেনের বৌ প্রভাতী তার মৃত শিশুটির জন্য অবিরত ক্রন্দন একপাশে সরিয়ে রেখে কোলে বিছিয়ে নিয়েছে রাজহাঁসের নকশাতোলা কাঁথা, ঝাঁপি খুলে সুঁচে লাছিসুতো পরিয়েছে। রাজহাঁসের সাঁতারের জন্য জলের নকশা তুলবে। জলের রং নীল কিম্বা সবুজ। জল। প্রাণ। ওতপ্রোত ।
'জন্ম' গল্পের শ্রীপদ বিশ্বাস কাকার বাড়ি বেগার খাটে বটে কিন্তু তার ঘরদোর যেন অন্য পৃথিবীতে। যেন সে অন্য পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে। বিপুল লিখছেন,' শুধু যখন শ্রীপদ একা হয়ে যায়, জামাকাপড় ছেড়ে জলের গভীরে ডুব দেয়, ...যখন দম ফুরিয়ে আসে, একফোঁটা বাতাসের জন্য বুকটা ফেটে পড়তে চায়, ... তখন তার সমস্ত চৈতন্য জুড়ে দশাসই একটা খোল বাজতে থাকে - চল শ্রীপদ চল শ্রীপদ। ঝমঝম ঝমরঝম।' দোলপূর্ণিমার রাতে কাকার বাড়ি থেকে বিতাড়িত অপমানিত শ্রীপদ পাথরের কাছে আসে। রহস্যময় ঝুলে থাকা পাথর। শ্রীপদ আহত জন্তুর মত উপুড় হয়ে জল খায়।অমোঘ সে ডাক শুনতে পায় - বাজাও হে, বাজাও। তার জল খেয়ে ফুলে ওঠা পেটে সে টোকা দেয়। বিপুল লেখেন, ' মনে হয় এর ফলে প্রসবকালীন জল ভেঙে যায়... প্রবল জ্যোৎস্নায় , একা, অন্ধকারে শ্রীপদ মা হয়..এক একটা আবর্তন শেষে নাড়ি ছেঁড়া ধনের মতো এক একটা ফুল ফোটে।'
দোলপূর্ণিমার রাতে অলৌকিক ছন্দের জন্ম দেখে দ্যাবাপৃথিবী। পাহাড় কেঁপে ওঠে। পাথর গড়িয়ে যায় রক্তহীন শ্রীপদর ওপর দিয়ে। এরপরে উপত্যকায় কোনো পাথর থাকে না আর । দোলনচাঁপাটি ফুটে থাকে।
দোলনচাঁপা ফোটে নি বাইশ বছরের ছেলে অর্ক যখন স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়। কারণ অজানা ছিল। ঘোলাটে। যেমনটি ছিল তার জন্মবৃত্তান্ত। তার মায়ের ঠোঁটের তিলটি একদা কামনা করেছিল বিবাহিত স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষ। শ্মশানে অর্কর চিতার সামনে সে পুরুষ ভাবে, 'বাইশ বছর ধরে আমি, উমা আর তারাপদ কি কোনও লুকোচুরি খেলেছি? ....কোথায় থাকে স্নেহ মমতা ভালবাসা ঘৃণা আনন্দ ভয়? আর সত্য? ... সে কি আবহমান কালের সংস্কারজাত, নাকি ব্যক্তিমানুষের চাওয়া - পাওয়ার সঙ্গে সংসারের প্রচলিত নীতির দ্বন্দ্বে সংশয়ের আড়ালে থাকে? '
'রক্ত মাংসের পোকা'য় পানুপিসির অস্পষ্ট অতীত। অস্পষ্ট শিবনাথের সঙ্গে তার সম্পর্ক। গল্পের শেষে রক্তমাংসকে অস্বীকার করে অলৌকিককে আবাহন করে কিশোর। আর ঠিক এই জায়গায় বিপুলের অন্য সব লেখা থেকে একদম আলাদা হয়ে যায় এ লেখা । ' পশ্চিমের জানালা দিয়ে বিকেলবেলার হলুদ আলো.. এসে পড়েছে ঐ পায়ের ওপর।... যদি 'আয়রে আমার শিবনাথ' বলে বুকে জড়িয়ে নেয়, যদি এক রকমের মা হয়ে যায়, যদি আমার না দেখা দিদি হয়ে যায় - তবে ঐ পা দুটো রক্তমাংসের হয়ে যাবে। রক্তমাংসে পোকা ধরে... সূর্য, আরও একটু দাঁড়াও ।'
হা রে কার্বন, হা রে কালনাগিনী
মরণ এসেছে অন্যভাবে , বিপুলের লেখায়। নগরসভ্যতার সঙ্গে সংঘাতে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মৃত্যু।
'রক্তচন্দন ও কালোমহিষ'এ তারাকান্ত কবিরাজ লতাগুল্ম, ভেষজে জীয়নকাঠি খুঁজে বেরিয়েছেন সমস্তজীবন। শেষপ্রান্তে এসে উপলব্ধি করেন... 'কোন ভেষজে ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগে আমি জানি না। সব গাছের শিকড়ে কীট বাসা বেঁধেছে। সমস্ত কলমিশাকের ঘন সবুজে বিবর্ণ খয়েরি ছোপ। রক্তচন্দন মাটির বাঁধন ছিঁড়ে মাটিতে লুটিয়ে আছে।'
জগবন্ধু শাঁখারি কিম্বা মাইকেল সোরেন। শাঁখা পরার হাত খুঁজে পায় না জগবন্ধু। ফুলেশ্বরীর জলে প্ল্যাস্টিক, কারখানার বর্জ্য। জগবন্ধ ¤ শ্বাস নিতে পারে না। চা বাগান বন্ধ হওয়ার সংকট উঠে আসে। চা গাছের গুঁড়ি ড্রয়িং রুমের টেবিল হয়ে যায়। উত্তরবঙ্গের এক গঞ্জের কিশোরী বুল্টি। কলকাতায় চলে গেল বৃন্দাবতী সরকার হয়ে। এক রাতে সে গণ ধর্ষিত হয়। বিপুল লেখেন,'রাতের আঁধারে নগর কলকাতার ঘাতকবাহিনী লুঠ করে আমাদের ভালোবাসার প্রত্নসামগ্রী... মফস্বলের কাচের বয়াম ঠুকরে ভাঙে কলকাতার দাঁড়কাক।'
ধর্ষিত হয় সোমারুর বউ লীলাও। ডুয়ার্সের জঙ্গলে।আদিম অরণ্যের ঘাসে রক্তের আলপনা। আলপনা ছড়িয়ে পড়ে তামাম ভারতবর্ষে। 'হিমঘরে' পারুল দাশও পড়ে থাকে প্রায়-উলঙ্গ নিÖপ্রাণ হয়ে কনকনে ঠান্ডায়। কোল্ড স্টোরেজ ভুবনায়িত হয়। হয়ত বা হিম যুগ - ভুবনময়। 'মিউচুয়াল হয় না' য় শিল্প ধর্ষিত হয় সম্মিলিত পলিটিকসের কাছে। আপাত আপোষের পরে শিল্পীর শরীর ঝুলতে থাকে আমগাছে। জিভ বেরিয়ে থাকে।
নিরন্তর প্রবহমান প্রাণ। এই অস্থি, মজ্জা, বর্জ্য, শ্বাসবায়ু-
বিপুলের গদ্য রোজকার জীবন বদলে দেয়। যতটুকু সম্ভব।
লেখকের অন্যান্য গদ্য - এ' লেখায় আলোচিত ঃ
বুল্টির নীল ফ্রক; দেশ পত্রিকা (২০০৩, ১৭ অগাস্ট), পৃষ্ঠা ৫২ -৫৮
রক্তমাংসের পোকা; দেশ পত্রিকা (২০০৫, ২ মার্চ ), পৃষ্ঠা ৫০ -৫৫
তৃষ্ণা-বলয়; দেশ পত্রিকা (২০০৫, ১৭ নভেম্বর ), পৃষ্ঠা ৭০ -৭৭
যদিও দৈনন্দিন ছিল । যেমন থাকে । উত্থান পতন। সাংসারিক শব্দগুচ্ছ। ফ্লাইওভার, শপিং প্লাজা, সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী থার্ড রেল। স্কাইস্ক্র্যাপারের মাথায় ঘোলাটে চাঁদ -নিয়নসাইনে ম্লান। অথচ, সুষনি শাক ছিল না। শাঁখারি ছিল না। রঙীন ফানুস, রাজকন্যা, ময়ূরপঙ্খি নাও-ছিল না। অসম্ভব ছিল অলৌকিক মিউজিক, সাইকেলের প্যাডেল বেয়ে নামা দাবনার দাপট অথবা কামনা। বেঁচে থাকার সুখ। বীজতলা কিম্বা চাঁদসূর্যের আকাঙ্খা। ছিল না বিষাদজলে জেগে থাকা দোলনচাঁপাটি। অথবা একটি পাঁচকোণা তারা। তার অভ্যন্তরে আকাশপ্রদীপ -গৃহস্থের গোপন বাসনা।
ছিল না। আবার ছিলও তো। আর কোনোখানে। অন্য কোথাও। বিপুল নিয়ে এলেন তাঁর গদ্যে। বিপুল দাস। ১৯৭৪এ 'পাহাড়তলি' পত্রিকায় লিখেছিলেন 'অ্যান্টিবায়োটিক'। দেশ পত্রিকায় ছোটগল্প। অবশেষে ২০০৫এ 'শঙ্খপুরীর রাজকন্যা।' ছোটগল্পের সংকলন। প্রাক - উপনিবেশ পাঁচালি আখ্যানের সহজিয়া শৈলীর উত্তরাধিকার - ব্লার্ব এমত বলে।
বিপুলের গদ্য । বিষাদ জলে ভাসে ময়ূরপঙ্খি নাও-
বিপুলের গদ্যের গভীরে অপার রহস্যময়তা, রসবোধ চুইঁয়ে নামে, হাল্কা শ্লেষের আস্তরের তলায়। এবং হা হা বিষাদ। অণুবাক্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেইলসে কখনও নির্মাণ, কখনও তুমুল স্মার্টনেস। প্রাণ সৃষ্টি, অ্যামাইনো অ্যাসিড, কোষ ও কলা- আঙ্গিক কৌশলে বিজ্ঞানপ্রসঙ্গ। নির্মেদ নির্ভার গদ্য । টানটান ছিলা। সপাং চাবুক।
পটভূমি উত্তরবঙ্গ, মফস্সল-ই মূলতঃ। বিবিধ বৃত্তির চরিত্রসব। কবিরাজ, শাঁখারি, বীমার দালাল, মুদি, কুমোর,লেখক, অধ্যাপক। মূল চরিত্র নারী নয় কখনই। অথচ নারী-ই বিপুলের গদ্যের আধার। সূত্রটি গবেষকের থিসিসের উপাদান হতেই পারে। সত্তরের দশক গড়িয়ে আশি, নব্বই , মিলেনিয়াম পেরিয়ে ২০১০। অনুসন্ধিৎসু জানতে চাইবেন গদ্যের বিবর্তন, বদলে যাওয়া দুনিয়া কতখানি প্রভাবিত করেছে বিপুলের গদ্যের বিষয় ও আঙ্গিককে । গল্পগুলির কালানুক্রমিক সূচী সম্ভবতঃ জরুরী ছিল সংকলনটিতে। সেহেতু।
ফানুস, সাইকেল, আকাশপ্রদীপের পৌনঃপুনিক ব্যবহার কি বিপুলের গদ্যের নিজস্ব জলছাপ? তারাশঙ্করের ছায়া উঁকি দেয় কোথাও? গবেষক প্রশ্ন তুলবেন। উত্তর দেবেন।
বিপুলের গদ্যে মজলে এ আলোচনার বাইরে থাকাই অবশ্যম্ভাবী নিয়তি।
সে গদ্য বাঘের মত ঝাঁপায়। গ্রাস করে নেয়। কখনও ঘূর্ণিবাতাস হয়ে এলোমেলো করে ঘরদোর, রোজকার ছক। হয়তো বা অলৌকিক দুপুরের একলা ঘুঘু পাখি। বুকের ভেতর। নাগরিক ব্যস্ততার মাঝে তীব্র অমোঘ ডাক - যে ডাক একবারই শোনে মানুষ। রক্তমাংসকে অস্বীকার করে অলৌকিক এক স্বর্ণচাঁপার আকাঙ্খায়।
কোন মেস্তরি নাও বানাইল...
কখনও হিরো মহম্মদ, ফুরফুরি, অথবা নয়ন মা , ধীরুকাকা, কিম্বা দীপা, মানস, কমলা হয়তো বা। গোবিন্দ আর তার কালো বৌ। কালো বেঁটে কানু ডাক্তার, কনকচাঁপা রঙ অনিতা। ব্রজবল্লভ, সহদেব আর বীথি। সংসারসীমান্তের মানুষজন ।
'হেমা মালিনীর হিরো'তে খুনিয়াজোতের ফরেস্টে হিরো মহম্মদ শা আবদুল করিমের গান শোনে। পিঞ্জিরা পক্ষী নদী, ডিঙি । জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে আসা বউটি বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়।
' হিরো মহম্মদের সমগ্র চেতনা জুড়ে ব্যপ্ত বাউলা অঙ্গের সারি গানের কথামালায় উন্মুক্ত একটি বাদামি রঙের ঈষৎনত ভারী স্তন অদ্ভূতভাবে ক্রিয়াশীল হয়। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে মগজে একটি সাদা গম্বুজ দেখতে পায়। মিনারসহ।'
আধভাঙা ডাল, হিরোর ভেজা নীল লুঙ্গি,ফুরফুরির টানটান শরীর, হিরোর নতুন সাইকেল, স্পোক, হ্যান্ডেল,থাই গড়িয়ে প্যাডেলের দিকে নামা নিষিদ্ধ সুখ যেন জগৎ জুড়ে রূপকথার মত ছড়িয়ে পড়ে। জলে নামে চিরকালের কাঙাল পুরুষ, পারঘাটায় মেয়েটি যেন সময়, দাঁড়িয়ে থাকে গর্ভবতী হওয়ার প্রতীক্ষায়।
'মদনের গুপ্তকথায়' দাদার অন্নে প্রতিপালিত 'গাড়োল' ধীরেন দাস কামনা করেছিল নয়নকে।...নয়নের বর 'মার্ডার' হ'লে সে নয়ন- মা বনে যায়। সাপে দংশানো মানুষকে বাঁচায়। লোকমুখে মিথ তৈরি হয়। সাপে কাটা ভাইপোকে বাঁচাতে নয়নের কাছে আসে ধীরেন। একটি মৃত্যু - আশংকার ব্যাকড্রপে দুজনের মিলন । মিলনবর্ণনে মিনার কিম্বা গম্বুজের আকার ফিরে ফিরে আসে, বারংবার আসে রংখেলা, কর্দমহোলি।
'দ্বন্দ্বমূলক' এ ধলা রঙের গোবিন্দ। কটা চুল, কপিশ চোখ।
'লোকে বাপের নাম জানতে চায়, চোদ্দোপুরুষের সুলুক খোঁজে ।' ... মালিকের গুরুদেবের কাছে যায় শরীর শুদ্ধ করতে। অপমানিত হয় চরম।
এরপর..' এপারে নিমতিতা ফরেস্টের ভেতর আদিম অন্ধকার। মাঝে আবর্জনা বয়ে নিয়ে যাওয়া খালের ধারে প্রাগৈতিহাসিক শুয়োরের পিঠে বসে গোবিন্দ ঈশ্বরের লীলা দেখে।... মনে হয়, কতজন্ম আগে দেখা এই কানন, এই জল ও এই ধেনুসকল। এই গোষ্ঠ তার ছিল... চাদর সরিয়ে সে তার চামড়ার রং দেখার চেষ্টা করে...একসময় সমস্ত শরীর আবৃত করতে থাকে কালো মাটির আস্তরণে। তার সমস্ত শরীর ঢেকে যায় যমুনাতীরের কর্দমাক্ত পলল মৃত্তিকায়.... তার গালে পঙ্কিল মাটির স্তর জমাট বাঁধতে থাকে।' যখন সে বাড়ি ফেরে, কালো বৌটি তার পাশে এসে দাঁড়ায় লম্ফ হাতে-'পাগল হইছ নি?' বাঘ ডাকে। অঙ্গে জোয়ার। কালো শরীর , সাদা শরীর মিলে মিশে যায়। মুহূর্ত আগের চরম একাকীত্বের শৈত্যকে আলিঙ্গন দেয় জোট বাঁধার উত্তাপ।
'তৃষ্ণা-বলয়' এ মুদি দোকানের ব্রজবল্লভ, হোটেল মালিক সহদেব আর বীথি শর্মা, যে শিলিগুড়ির হোটেলে কাজ করে, হোটেলের কাজে মন্দা থাকলে ফ্লাইং কাস্টমার ধরে। বীথির ঘরে যায় ব্রজ আর সহদেব। পঞ্চাশ পার হওয়া দুজন মানুষ। 'অতৃপ্ত থাই গড়িয়ে বিষাদ চেন হয়ে চাকায় পৌঁছয়। ' পাশাপাশি দুই সাইকেলে। সহদেবের দেওয়া শাড়ি প্রত্যাখান করে বীথি। অথচ 'ব্রজর তুলে ধরা ঠোঁটে উমম করে একটা চুমু' দেয় ।...'অবিকল অনেক রাতে ঘাটের সামনে বড় মাছের ঘাই মারার শব্দ।'
দৈনন্দিনের মধ্যে এভাবেই তৈরি হয়ে যেতে থাকে নতুন কক্ষ পথ অথবা তৃষ্ণাবলয়। রোজকার ডিঙিটি কোন মন্ত্রে ময়ূরপঙ্খি নাও।
বিপুল লেখেন, ' অনন্ত কুয়োর গভীর থেকে অনেক রাতে উঠে আসে প্রাচীন কাতলা। তার নাকে নথ, পিঠে শ্যাওলা। ঘাটের সামনে এসে জলে ঘাই মারে। কার্তিক মাস জুড়ে গৃহস্থের গোপন বাসনা নিয়ে আকাশপ্রদীপ জ্বলে বাঁশের মাথায়। প্রাণের প্রদীপ জ্বলতে থাকে, জ্বলতে থাকে।
আর এই সব টানাপড়েনে মানুষ কেমন পাগল হয়ে যায়।'
রক্ত ও জলের আপেক্ষিক ঘনত্ব
নীপার সঙ্গে ভালবাসার বিয়ে ফিলসফির স্যার অমিতের । সৌম্য, মার্জিত । বিয়ের পরে, 'আস্তে আস্তে আর একজন অমিতকে সে দেখতে পাচ্ছিল।... এমনকী কোন বন্ধু নীপার ফিগার দেখে কী বলেছে-সেসবও সাতকাহন করে বলত আর হাসত...'
একবার সমুদ্রে গেল ওরা। হোটেলে ডাবল বেড রুম চেয়ে প্রত্যাখাত হল অমিত । ... ' দুচোখ ভরে নীপাকে দেখে। হাসতে থাকে। তার সমস্ত দাঁত বেরিয়ে যায়।
ওরা তোমাকে কি ভেবেছে জানো? .. ঘর আছে, দেবে না। আসলে বড় হোটেল তো, এখানে ওসব অ্যালাউ করে না।'
শুভাশুভ বোধ বলা চলে। অথবা রক্তে লালিত সংস্কার। মেলে নি ।
'সুরক্ষাপত্র' গল্পে, কলকাতার দীপা বিয়ে হয়ে চলে আসে গ্রামের দিকে স্বামীর কোয়ার্টারে।
বিপুল লেখেন, ' দীপার জগত থেকে খুব ধীরে ধীরে ট্রাম, মেট্রো, পঁচিশে, বৈশাখে রবীন্দ্রসদন, হাতিবাগানে কেনাকাটা , কলেজ স্ট্রীটের বইয়ের দোকান - সব বিবর্ণ হতে থাকে। শুধু মাঝে মাঝে মা'র কথা মনে পড়ে... ভীষণরকম মাকে মনে পড়ে।'
দীপার এই নতুন জীবনে আসে এক সবজিবিক্রেতা বৃদ্ধা। আসে তার বলিরেখা, ধামা ঝুড়ি নাতি, লাউডগা, ঢেঁকিশাক, কলমি শাক, হেলেঞ্চা সমেত। লাউচারা পোঁতে দীপা রান্নাঘরের পাশে। বিপুলের গদ্যে এরকম, 'রাধানগরে এক শীতের সকালে দীপার মাটির উঠোনে এক বুড়ি যেন তার নিজস্ব ওয়েবসাইট খোলে। দীপা সার্ফিং করতে থাকে। মনে হয় এক দীর্ঘ অদৃশ্য হাত বিডন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে দিগন্তপ্রসারী হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে রাধানগরের উঠোনে এসে দীপার মাথায় বিলি কাটে।'
বিবাহবার্ষিকীতে অধিকরাতে বাড়ি ফেরে তার স্বামী। মাতাল। আবরণ খসে পড়ে। ভেতরের চেহারা উঁকি দেয়। তর্জনী ওঠে দীপার দিকে। অপ্রত্যাশিত।
' ঘর থেকে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসে দীপা। ..... মাটি থেকে যুইঁফুলের তীব্র গন্ধ এবং রাতের আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়া দোক্তাগুন্ডির গন্ধ মিশে গেলে এক অদ্ভূত স্নেহময় বাস বাতাসে ভাসতে থাকে। সংপৃক্ত করে ফাল্গুনের রাত্রিকে।'
দীপা উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের পাশের লাউচারার কাছে বসে। আশ্রয় খোঁজে, পায়।
তোমার তুলনা তুমি, প্রাণ
লাউএর চারার মত প্রাণের এই ওমটি বাহিত বিপুলের সামগ্রিক গদ্যেই। সমস্ত লেখায়। বারংবার এসেছে প্রাণ। জীবকোষ, জল, ক্লোরোফিল, শেকড়বাকড়, শ্বাসবায়ু, লাবডুব।
কোথাও পরিত্যক্ত অবৈধ প্রাণটিকে রাষ্ট্রের যান্ত্রিক হাত থেকে আগলে রেখেছে পুলিশের গুলিতে অকালমৃত নক্শালের 'মেন্টাল কেস' ছেলে।
আবার 'নকুলদানা ও গোকুলদানা'য় জীবন বীমার এজেন্ট সুধীর কাঞ্জিলাল প্রাচীন চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভেবেছে,'উপযুক্ত প্রিমিয়াম কেউ দিলে ঐ প্রাচীন চাঁদের কেন বীমা হবে না।... কোনদিন যদি খসে পড়ে। যদি অমোঘ জাঁতায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে মিহি জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশে। যদি গলে যায় সংসারের তাপে । ' আর দিগেনের বৌ প্রভাতী তার মৃত শিশুটির জন্য অবিরত ক্রন্দন একপাশে সরিয়ে রেখে কোলে বিছিয়ে নিয়েছে রাজহাঁসের নকশাতোলা কাঁথা, ঝাঁপি খুলে সুঁচে লাছিসুতো পরিয়েছে। রাজহাঁসের সাঁতারের জন্য জলের নকশা তুলবে। জলের রং নীল কিম্বা সবুজ। জল। প্রাণ। ওতপ্রোত ।
'জন্ম' গল্পের শ্রীপদ বিশ্বাস কাকার বাড়ি বেগার খাটে বটে কিন্তু তার ঘরদোর যেন অন্য পৃথিবীতে। যেন সে অন্য পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে। বিপুল লিখছেন,' শুধু যখন শ্রীপদ একা হয়ে যায়, জামাকাপড় ছেড়ে জলের গভীরে ডুব দেয়, ...যখন দম ফুরিয়ে আসে, একফোঁটা বাতাসের জন্য বুকটা ফেটে পড়তে চায়, ... তখন তার সমস্ত চৈতন্য জুড়ে দশাসই একটা খোল বাজতে থাকে - চল শ্রীপদ চল শ্রীপদ। ঝমঝম ঝমরঝম।' দোলপূর্ণিমার রাতে কাকার বাড়ি থেকে বিতাড়িত অপমানিত শ্রীপদ পাথরের কাছে আসে। রহস্যময় ঝুলে থাকা পাথর। শ্রীপদ আহত জন্তুর মত উপুড় হয়ে জল খায়।অমোঘ সে ডাক শুনতে পায় - বাজাও হে, বাজাও। তার জল খেয়ে ফুলে ওঠা পেটে সে টোকা দেয়। বিপুল লেখেন, ' মনে হয় এর ফলে প্রসবকালীন জল ভেঙে যায়... প্রবল জ্যোৎস্নায় , একা, অন্ধকারে শ্রীপদ মা হয়..এক একটা আবর্তন শেষে নাড়ি ছেঁড়া ধনের মতো এক একটা ফুল ফোটে।'
দোলপূর্ণিমার রাতে অলৌকিক ছন্দের জন্ম দেখে দ্যাবাপৃথিবী। পাহাড় কেঁপে ওঠে। পাথর গড়িয়ে যায় রক্তহীন শ্রীপদর ওপর দিয়ে। এরপরে উপত্যকায় কোনো পাথর থাকে না আর । দোলনচাঁপাটি ফুটে থাকে।
দোলনচাঁপা ফোটে নি বাইশ বছরের ছেলে অর্ক যখন স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়। কারণ অজানা ছিল। ঘোলাটে। যেমনটি ছিল তার জন্মবৃত্তান্ত। তার মায়ের ঠোঁটের তিলটি একদা কামনা করেছিল বিবাহিত স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষ। শ্মশানে অর্কর চিতার সামনে সে পুরুষ ভাবে, 'বাইশ বছর ধরে আমি, উমা আর তারাপদ কি কোনও লুকোচুরি খেলেছি? ....কোথায় থাকে স্নেহ মমতা ভালবাসা ঘৃণা আনন্দ ভয়? আর সত্য? ... সে কি আবহমান কালের সংস্কারজাত, নাকি ব্যক্তিমানুষের চাওয়া - পাওয়ার সঙ্গে সংসারের প্রচলিত নীতির দ্বন্দ্বে সংশয়ের আড়ালে থাকে? '
'রক্ত মাংসের পোকা'য় পানুপিসির অস্পষ্ট অতীত। অস্পষ্ট শিবনাথের সঙ্গে তার সম্পর্ক। গল্পের শেষে রক্তমাংসকে অস্বীকার করে অলৌকিককে আবাহন করে কিশোর। আর ঠিক এই জায়গায় বিপুলের অন্য সব লেখা থেকে একদম আলাদা হয়ে যায় এ লেখা । ' পশ্চিমের জানালা দিয়ে বিকেলবেলার হলুদ আলো.. এসে পড়েছে ঐ পায়ের ওপর।... যদি 'আয়রে আমার শিবনাথ' বলে বুকে জড়িয়ে নেয়, যদি এক রকমের মা হয়ে যায়, যদি আমার না দেখা দিদি হয়ে যায় - তবে ঐ পা দুটো রক্তমাংসের হয়ে যাবে। রক্তমাংসে পোকা ধরে... সূর্য, আরও একটু দাঁড়াও ।'
হা রে কার্বন, হা রে কালনাগিনী
মরণ এসেছে অন্যভাবে , বিপুলের লেখায়। নগরসভ্যতার সঙ্গে সংঘাতে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মৃত্যু।
'রক্তচন্দন ও কালোমহিষ'এ তারাকান্ত কবিরাজ লতাগুল্ম, ভেষজে জীয়নকাঠি খুঁজে বেরিয়েছেন সমস্তজীবন। শেষপ্রান্তে এসে উপলব্ধি করেন... 'কোন ভেষজে ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগে আমি জানি না। সব গাছের শিকড়ে কীট বাসা বেঁধেছে। সমস্ত কলমিশাকের ঘন সবুজে বিবর্ণ খয়েরি ছোপ। রক্তচন্দন মাটির বাঁধন ছিঁড়ে মাটিতে লুটিয়ে আছে।'
জগবন্ধু শাঁখারি কিম্বা মাইকেল সোরেন। শাঁখা পরার হাত খুঁজে পায় না জগবন্ধু। ফুলেশ্বরীর জলে প্ল্যাস্টিক, কারখানার বর্জ্য। জগবন্ধ ¤ শ্বাস নিতে পারে না। চা বাগান বন্ধ হওয়ার সংকট উঠে আসে। চা গাছের গুঁড়ি ড্রয়িং রুমের টেবিল হয়ে যায়। উত্তরবঙ্গের এক গঞ্জের কিশোরী বুল্টি। কলকাতায় চলে গেল বৃন্দাবতী সরকার হয়ে। এক রাতে সে গণ ধর্ষিত হয়। বিপুল লেখেন,'রাতের আঁধারে নগর কলকাতার ঘাতকবাহিনী লুঠ করে আমাদের ভালোবাসার প্রত্নসামগ্রী... মফস্বলের কাচের বয়াম ঠুকরে ভাঙে কলকাতার দাঁড়কাক।'
ধর্ষিত হয় সোমারুর বউ লীলাও। ডুয়ার্সের জঙ্গলে।আদিম অরণ্যের ঘাসে রক্তের আলপনা। আলপনা ছড়িয়ে পড়ে তামাম ভারতবর্ষে। 'হিমঘরে' পারুল দাশও পড়ে থাকে প্রায়-উলঙ্গ নিÖপ্রাণ হয়ে কনকনে ঠান্ডায়। কোল্ড স্টোরেজ ভুবনায়িত হয়। হয়ত বা হিম যুগ - ভুবনময়। 'মিউচুয়াল হয় না' য় শিল্প ধর্ষিত হয় সম্মিলিত পলিটিকসের কাছে। আপাত আপোষের পরে শিল্পীর শরীর ঝুলতে থাকে আমগাছে। জিভ বেরিয়ে থাকে।
নিরন্তর প্রবহমান প্রাণ। এই অস্থি, মজ্জা, বর্জ্য, শ্বাসবায়ু-
বিপুলের গদ্য রোজকার জীবন বদলে দেয়। যতটুকু সম্ভব।
Comments
Post a Comment