গেনজি-দ্য ওয়র্ল্ড অফ দ্য শাইনিং প্রিন্স



এক হাজার আট সালে মুরাসাকি শিকিবু লিখেছিলেন রাজকুমার গেনজির কাহিনী। সহস্র বত্সর পূর্ণ হ'ল। গেনজি-দ্য ওয়র্ল্ড অফ দ্য শাইনিং প্রিন্স নামাঙ্কিত প্রদর্শনীটি এই উপলক্ষ্যেই। শুরু হ'ল বারই ডিসেম্বর, চলবে পনেরই ফেব্রুয়ারি অবধি। আর্ট গ্যালারি অফ নিউ সাউথ ওয়েলসের এশিয়ান গ্যালারিতে। প্রবেশ অবাধ।

পন্ডিতরা তর্ক করুন,গেনজির উপাখ্যানই প্রাচীনতম উপন্যাস কি না, তুলনায় আসুক প্রথম শতকের ল্যাটিন স্যাটায়ারিকা, তৃতীয় শতকের গ্রীক এথিওপিকা অথবা সপ্তম শতকের সংস্কৃত কাদম্বরী। চুলচেরা বিশ্লেষণ চলুক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি নিয়ে, সাড়ে চারশো চরিত্র সম্বলিত আখ্যানের গঠনগত ও মনস্তাত্বিক জটিলতা নিয়ে। ইয়াশুনারি কাওয়াবাতা নোবেল প্রাইজ অ্যাকসেপ্টেন্স স্পীচে বলুন, "দ্য টেল অফ গেনজি ইজ দ্য হায়েস্ট পিন্যকল অফ জাপানীজ লিটারেচার।" বলুন,আজ অবধি কিচ্ছু লিখতে পারি নি আমরা যা গেনজিকে অতিক্রম করে যায়।

আমাদের শ্রবণ দ্বার উন্মুক্ত পন্ডিতের তরে; দর্শনে থাকুন প্রিয়দর্শন রাজকুমারটি-হাজার বছর পার হয়েও এখনও কি অনায়াস প্রভাব ফেলছেন জাপানের শিল্পমাধ্যমে। আমরা অবাক হয়ে দেখি। দেখি আর দেখি। দেখব,সময়ের সঙ্গে কিভাবে বদলে যাচ্ছে মাধ্যম, রাজকুমার হয়ে উঠছেন আরো রূপবান। দেখব, প্রথমদিককার সম্পূর্ণ কাহিনীনির্ভর চিত্রপট বদলে ভাবনির্ভর হয়ে উঠছে ক্রমশ:।

প্রদর্শনী শুরু সপ্তদশ শতকের জাপানি কানো ঘরানার সিক্স ফোল্ড স্ক্রীন আর হ্যাঙ্গিং স্ক্রোলে। সিল্ক বা কাগজে মূল রং সোনালী আর কালো। চুয়ান্ন অধ্যায়ের আখ্যানটির এক একটি ঘটনা এঁকেছেন শিল্পী। কোথাও গেনজির অভিসার, কোথাও প্রেমপর্ব, কোথাও যুদ্ধ, তরণীবিহার কোথাও, হেমন্তের ঝরা পাতা, পূর্ণ চন্দ্র বারে বারে উঁকি দিয়ে গেছে।

একটি হ্যাঙ্গিং স্ক্রোলে রাজকুমারের প্রেম এক রাজকন্যের সঙ্গে। আখ্যানের বিশতম অধ্যায় কেন্দ্রিক। রাজকন্যের সখিসকল উদ্যানক্রীড়ায় ব্যস্ত। বিশাল এক তুষারগোলক তৈরী করছেন তাঁরা। রাজকুমারেরই আদেশে হয়তো। সেই সুযোগে রাজকুমার একা পেয়ে গেছেন রাজকন্যেকে-প্রেমালাপে নিমগ্ন প্রাসাদের উচ্চতলে, কিছুটা আত্মপ্রসাদী হাসি রাজকুমারের এই নিভৃতিটুকু তৈরী করে নেওয়ার কৃতিত্বে। শিল্পী ছবি এঁকেছেন উড়ন্ত বিহঙ্গের দৃষ্টিকোণ থেকে। তজ্জনিত সৃষ্ট দূরত্বে, এবং দুটি চরিত্রের মাঝখানে প্রাসাদস্তম্ভের ব্যবহারে রাজকুমার রাজকুমারীর প্রেমপর্বের প্রাথমিক দ্বিধা , মানসিক দূরত্বর সূক্ষ্ম ইঙ্গিত। একই সঙ্গে ছবির গৃহপালিত হাঁসগুলিতে, কিংবা ঈষত্ চিড় ধরা তুষার আবৃত পূর্ণ পুষ্করিণীতে প্রেমপর্বের সুখময় পরিণতির আভাস।

ঊনবিংশ শতকে, জাপানের 'সেন্টালাইজড নেশন'হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে, যখন সাংস্কৃতিক বিদ‡জন আরো আঁকড়ে ধরতে চাইলেন জাপানের ঐতিহ্য,নবজন্ম হ'ল রাজপুত্তুরের। বদলে গেল মাধ্যম স্ক্রীন বা স্ক্রোল থেকে উডব্লক প্রিন্টের চিত্রে, রাজকুমারের বেশভূষা, পরিবেশে লাগল আধুনিকতার ছোঁয়া, কাহিনীর বদলে শিল্পী ছুঁতে চাইলেন অন্তর্নিহিত ভাবকে।একটি রঙীন উডব্লক প্রিন্ট চিত্র-গোধূলি সৌন্দর্য নাম ছবিটির-একটি মেয়ে , প্রাসাদের পরিচারিকাকে ঘিরে পুষ্প পত্র বিস্তার করেছে অযত্নলালিত উদ্যান, মেয়েটির শরীর অঙ্গাঙ্গী হয়ে যাচ্ছে গুল্মে উদ্ভিদে। আকাশে চাঁদ।
এই পর্বে, আখ্যানের রচয়িত্রী মুরাসাকিও কিন্তু উপেক্ষিত থাকছেন না শিল্প মাধ্যমে। উডব্লক প্রিন্টে ধরা থাকছে লেখা শুরুর সময়টি। বিওয়া সরোবর তীরে ইশিয়ামা মন্দিরের বারান্দায় , নীচু ডেস্কোতে তিনি, বেশভূষায় আভিজাত্য স্পষ্ট,আকাশে শরত্শশী। তিনি আনমনে তাকিয়ে আছেন চাঁদের পানে। লেখার সরঞ্জাম পাশেই। একটু পরেই লেখা শুরু করবেন চন্দ্রাহত মুরাসাকি। কালজয়ী আখ্যানের সূচনার এই মিথটি-পূর্ণচাঁদের মায়ায় অভিজাত রমণী, কলম হাতে -মুরাসকির আইকনোগ্রাফ হয়ে রইল।

আধুনিকতার এই পর্যায়ে উডপ্রিন্টে ধরা থাকছে কাবুকি নৃত্যের কুশীলব। একটি ছবিতে একচল্লিশতম অধ্যায়ের অন্তর্নিহিত ভাবটি রূপ ধরেছে একাধিক নট নটীর দৃষ্টি বিনিময়ে। এক একটি খন্ডচিত্রে এক একটি যুগল-পুরুষ ও নারী-অভিজাত, তাকিয়ে আছেন পরস্পরে, বিভিন্ন মুদ্রায়। শিল্পী চরিত্রদের স্থাপন করেছেন কৌণিকভাবে। সামগ্রিক অভিঘাতে দর্শকের স্মৃতিতে জাগছে ইংরিজি অনুবাদটি, এইরকম: ' O seer who roams
the vastness of the heavens,
go and find for me
a soul I now seek in vain
even when I chance to dream'
Chapter 41, The Seer'

ক্রমে টাকারাজুকা মিউজিকালসে উঠে আসছেন রমণীমোহন গেনজি। প্রসঙ্গত: হাজার বছর আগে সেই চন্দ্রাহতা নারী কিন্তু কলম তুলে নিয়েছিলেন মেয়েদেরই জন্য-গবেষকরা জানিয়েছেন। কেননা, প্রায় সামগ্রিক লেখাটিই রচিত জাপানি ফোনেটিক স্ক্রিপ্টে, চৈনিক হরফে পুরুষ প্রাধান্য,সেই সময়। আধুনিক কালে রাজকুমার দেখা দিচ্ছেন অগুন্তি জনপ্রিয় কমিকসে -মাগ্নায়।

এই একবিংশ শতকেও শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করছেন গেনজি। প্রদর্শনীতে , কন্টেম্পোরারি বিভাগে 'ড্রেস কোড, ২০০৮' শিরোণামে রাখা হয়েছে বিভিন্ন আকৃতি, অবয়ব। শিল্পীরা ঐ চুয়ান্ন পর্বের কাছে R্ণী জানিয়ে সেলাম ঠুকেছেন রাজকুমারকে।

বিদ‡জন অন্বেষণ করে ফিরুন সহস্র বছর ব্যেপে বেঁচে থাকা রাজকুমার-মোহের কারণসমূহ। তর্কে উঠে আসুক জাপানের সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। প্রশ্ন জাগুক, নরনারীর প্রেমই কি তবে সেই জাদুকাঠি যা এতদিনেও আকর্ষণ হারায়নি একটুও? গবেষক জানান, আখ্যান সেই অর্থে কোনো পরিণতির দিকে এগোয় নি, শেষও হয়ে গেছে আচম্বিতে, বাক্যের মধ্যপথে-লেখকের অভিপ্রায়ই ছিল না আখ্যান সমাপ্তির-তিনি কেবল চেয়েছিলেন বয়স বাড়ুক চরিত্রগুলির, সময়ের স্রোতে ভেসে চলুক কাহিনী, নিজের মতো। এই কি তবে জনপ্রিয়তার কারণ? অথবা এই বিপুল আখ্যানের সাড়ে চারশো চরিত্রের অধিকাংশের কোনো নামই নেই, তাই কি শিল্পীর কল্পনাবিস্তারের অনুকূল এত বছর যাবত্? শিল্পসমালোচকের কফির কাপে তুফান উঠুক।

আমরা শ্রবণ পেতে থাকি। দর্শনে ভাসুন প্রিয়দর্শন রাজকুমার- শত শত বছরের প্রাচীন স্ক্রীনে, স্ক্রোলে, উডকাটে। সোনালী, কালো, সবুজ, নীল, লাল। পায়ের তলায় হেমন্তের ঝরা পাতার রাশ, কোমরে তরবারি, মাথায় ঝুঁটি, প্রশস্ত ললাট। চন্দ্রাহতা নারীটি পরম যত্নে রচনা করেছিলেন অপরূপ রাজকুমারকে। চোখে চোখ মিলুক আমাদের।
'Life,it is too true,
must end when that moment comes,
but this shifting world
never has known
such a bond as the one
between us two.'
Chapter 34'
পরিবর্তনশীল জগত্। হাজার বছর পার হয়ে যায়। জীবন বয়ে চলে। তারই মাঝে, নয়নে নয়ন রাখেন রাজপুত্তুর আর রসিকজন। শিল্পের জন্ম হতে থাকে।
\

ডিসেম্বর ২১, ২০০৮

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস