যাপনকাল


'Once I was the past and the future, now I am only the present, today, the moment, and that is hard to bear, with no past, no future...'


আকাশ ছিল না। উপুড় করা চ্যাপ্টা বাটি পৃথিবীর ওপর। যা আকাশ নয়। অথচ পাখি ছিল, ডানা ছিল। একঝাঁক পাখি-ক্লান্ত অধৈর্য- ডানা মেলার খোঁজে একদিন ধাক্কা দিতে শুরু করল সেই উপুড় অর্ধগোলকে। আকাশ ভাসে না তবুও। তারা তখন তাদের চঞ্চু দিয়ে, চঞ্চুধৃত বৃক্ষশাখা দিয়ে -যে যেমন পারল-ধাক্কা দিতেই লাগল অনড় আকাশে- মাটিতে পা, চঞ্চু ঊর্দ্ধমুখী-লক্ষ ডানা ঝাপটাচ্ছে একযোগে - অবশেষে ভাসল আকাশ। উঁচুতে, আরও উঁচুতে, পাহাড় পর্বতের মাথা ছাড়িয়ে অনেক অনেক উঁচুতে। নাগালের বাইরে। বাতাসে জাগল ডানার শব্দ, সূর্যের আলো চুঁইয়ে ঢুকল প্রথমে, তারপর ভাসিয়ে নিয়ে গেল পৃথিবীর অন্ধকার। অনেক অনেক নিচে পড়ে রইল, তারপর হালকা হতে হতে মিলিয়েই গেল নিরুদ্ধনি:শ্বাস যাপন।।। ক্লান্তিদিন ।।।
আরো অনেক গল্প বলত জন। বুড়ো জন। সেই সময়ের গল্প। যখন পৃথিবী সদ্যোজাত। প্রাণহীন মাটি। মাটির নিচে চাঁদ, তারা, সূর্য। অস্থিমজ্জা, চর্ম, রোমরাজি,পালক এবং ডানার জালিকা। ঘুমন্ত। নিদ্রা আর জাগর-সময়ে ভেদ ছিল না কোনো। তারপর, একদিন ভাগ হয়ে গিয়েছিল সময়। জেগে ওঠার সময় আলাদা হতে শুরু করেছিল। প্রাণ জাগছিল । মাটির তলা থেকে সূর্য উঠে এসেছিল। রোদ ছুঁয়েছিল জল। জলের থেকে উঠে এসেছিল মানুষ। মানুষী। আমরা জন্মাচ্ছিলাম। জল মাটি মানুষ। এই আমরা। এই ব্রহ্মান্ড। মাটি খসে খসে পড়ছিল। আদিম মাটি। খোলসের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন পূর্বজগণ। আকাশ, বাতাস, ইউক্যালিপটাস, পাখি , মানুষ।।।।
মানুষ-মেঘমানুষ-মেঘমানুষের গল্প। ওয়ারামুরুঙ্গির গল্প। আলমুজের গল্প।
সমুদ্র থেকে উঠে আসা ওয়ারামুরুঙ্গি-হাতে লাঠি , কাঁধে ঝুলি। লাঠি দিয়ে মাটি খুঁড়ে, পুঁতেছিল বীজ-পদ্মবীজ, শাপলা শালুকের কন্দ, ফল ফুল গাছের চারা। মেঘমানুষ-বৃষ্টি এনেছিল।
এই ভূমিখন্ডে, আকাশ, বাতাস, পাখি, গাছ, মানুষে ওয়ারামুরুঙ্গি, আলমুজ আজও আছেন। আছেন পাহাড়ের গায়ে আঁকা ছবিতে। আছেন আমার মধ্যেও। বুড়ো জন বলত-ঈষত্ দুলত আর মন্ত্রের মতো বিড়বিড় করত-আমিই সেই সরীসৃপ, আমিই ক্যাঙারু, আমিই এমু, আমিই সেই আত্মা-পাহাড়ের গায়ে যাঁর ছবি এঁকেছেন পূর্বজ, আমিই মেঘ মানুষ। এ সব জনের ঠাকুর্দা বলেছিল জনকে। জন বলত আমাদের। আমাকে।
বলত-একদিন বন্দুক, বল্লম নিয়ে লড়েছিলাম, তবু পারি নি রাখতে-এখন লড়াই শব্দ দিয়ে, শব্দে শব্দে গাঁথা গল্প দিয়ে-একান্ত আমাদের লড়াই-ধরে রাখার লড়াই।
বুঝতাম না। বুঝতাম ।
আমি টোবি। রক্ষক। এই ভূমিখন্ডের। পবিত্রতার। এই সব গল্পমালার। একদিন আমার সন্তানে বর্তাবে রক্ষণের কর্তব্য। এই পরম্পরা। অতীত, বর্তমান পাশাপাশি অবস্থান করে এই ভূমিখন্ডে। পাথরে , জলে, ইউক্যালিপটাসে। চন্দ্রকলায়। নক্ষত্রমন্ডলীতে। সুপ্রাচীন বালিপাথরের টিলা, কন্দর, বৃষ্টিবন। পাথরের বুক ফাটিয়ে ঝর্ণা নামছে তুমুল, ক্রীকের জলে সূর্য ডুবছে।প্রস্তরগাত্রে পূর্বজর আঁকা ছবি। অজস্র অজস্র পাখি। সব কিছু কেমন বদলে যায় পাহাড় পেরোলেই। সবুজহীন শুকনো মাটি। ছোটো ঝোপঝাড় । জংলী ঝোপের ছোটো পাতা। কালচে বাদামী। সবুজ নেই কোনো। রুক্ষ পাথুরে মাটি। বৃক্ষহীন ধু ধু বিস্তার। তারপরে বিশাল চত্তÄর জুড়ে বার্বড ফেন্স। ফেন্সের ওধারেও ছোটো ঝোপ ঝাড়। ধূসর মাটি পাথর। ধাপে ধাপে খাদ শুরু। তারপর গহ্বর।এ বি সি ডি অর্গানাইজেশনের ইউরেনিয়াম মাইন। দুটো ওপেন পিট। একটা পিটে মাইনিং চলছে। অন্যটায় বোজানোর কাজ। এখানেই কাজ করি আমি। সপ্তাহে তিনদিন। মাথায় হেল্মেট, সেফটি বুট। ইউনিফর্ম। আয়নায় দেখি-চেনা যায় না। জন বলত -এই মাইনিং একদিন সব গ্রাস করবে, দেখিস-মাটি, জল,মানুষ-সব। আমাকে। তোকেও।


'চাইনিজ প্রিমিয়ার এখন এ'দেশে।চুক্তি সাক্ষর হবে। ইউরেনিয়াম বিক্রির পথ আরও সুগম হবে। নেতারা হাস্যমুখ, করমর্দনরত। ক্যামেরার শাটার , প্রচারের তীব্র আলো জুম আউট করে ফ্ল্যাশ ব্যাক।।।১৯৭৫এ ইউরেনিয়াম খনির পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে যে কমিশন বসে , সেখানে খনি অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা বলেছিলেন , " uranium mining has completely upturned our lives-bringing a town, many non-aborigial people, greater access to alcohol and arguments between us-mostly about money....Uranium mining has also taken our country away from us and destroyed it-billabongs and creeks are gone forever, there are hills of poisonous rock and great holes in the ground with poisonous mud...' ।
লিখছিলাম। তাই ঘুমোতে দেরি হয়েছিল অনেক। একটা আর্টিকেল শেষ করার ডেডলাইন। তারপর ব্লগসাইট। অনেক রাত অবধি ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলাম। পিঠে বালিশ, পা লম্বা। লিখতে ভালো লাগছিল কাল। অনেকদিন পরে লিখতে ভালো লাগছিল, ফ্লো আসছিল। এতখানি রাত জাগা এই অবস্থায় ঠিক হবে না। শুয়ে পড়েছিলাম। হাল্কা ঘুম হ'ল। শেষরাত এখন। ঠিক এই সময় , একটা পাখি ডাকে। অদেখা পাখি। না কি অ্যালার্ম বাজে? আমি জানি ওরও ঘুম ভেঙে যাবে ঠিক এই সময়। বেডসাইড টেবিল থেকে চশমা নিয়ে মোবাইল তুলে সময় দেখবে ও। জানি-পাখিই ডেকেছিল। ও-ও জানে-পাখিই। আমি চাদর সরাবো না। চোখ খুলব না।ও আমাকে আলতো জড়াবে এই সময়।গালে চুমু খাবে হয়তো। হাল্কা। আমি ভান করব ঘুমিয়ে আছি। স্বপ্ন দেখছি। কখনও অস্ফুটে কিছু বলব।বোঝা যাবে না। ও বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে ঢুকবে। ফ্লাশ টানার শব্দ পাবো। শাওয়ারের জলের। তারপর মাইক্রো ওয়েভের গোঁ গোঁ আওয়াজ, বীপ। বেড রুমের দরজাটা সামান্য ফাঁক করে ও উঁকি দেবে যখন , ঘড়িতে অবধারিত সাড়ে চার। ও বেরোবে।
ও দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। আমি জানি, স্টেশনে যাওয়ার রাস্তা অ্যাজ ইউজুয়াল জাগবে না । স্ট্রীট লাইটের আলোয় ওর ছায়াই শুধু হাঁটবে ওর সঙ্গে।রাস্তার পাশে পার্ক করা থাকবে সার সার গাড়ি।শিশিরভেজা। নিয়নসাইনে অনুজ্জÄল দেখাবে শেষরাতের চাঁদ। ট্রেন ঢুকবে প্ল্যাটফর্মে। ইন্টারসিটির পুরোনো সবজেটে রেক্সিন সিটে বসে, ব্যাগ থেকে নেকরেস্ট বের ক'রে মাথা হেলাবে ও জানলার কাচে। বাইরে অন্ধকার গাঢ় থাকবে না আর। সামান্য ঘোলাটে হবে।পিছু হাঁটবে শহর। অফিস পৌঁছতে আরো ঘন্টা তিনেক ওর। কানে আইপডের তার গুঁজে চোখ বুজবে ও।গাঢ় নয়, হাল্কা ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হবে -বাইরের অন্ধকারের মতই। চায়ের কড়া লিকারে এক ফোঁটা দুধ চারিয়ে যাবে যেন। ওর স্বপ্নে, ওর আধোঘুমে আমি থাকব না, থাকবে ছটা রিয়াক্টর। আর এক আশ্চর্য সোনালী তরল। গর্ভে ইউরেনিয়াম।


এই ঢালু রাস্তাটা পেরোলেই সমুদ্র। এরকম মনে হয় আমার। অথচ এই ঢাল পেরোলে জাস্ট একটা টার্ন অ্যারাউন্ড, তিনটে রাস্তা চলে গেছে তিনদিকে। তার মধ্যে একটা পথ আমার। প্রতিদিনের চেনা পথ। ট্রেন থেকে নেমে এই পথে অফিস হাঁটি রোজ। প্রতিদিনই মনে হয় সামনে সমুদ্দুর। ছুটি ছুটি করে মন। গত দেড় বছর উন্মাদের মত লড়ে যাচ্ছি এই প্রজেক্টটা নিয়ে। আমাদের অর্গানাইজেশনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট। আমার কাছে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। দু বছর হ'ল জয়েন করেছি এই অর্গানাইজেশনে।মাসখানেকের মধ্যেই এই প্রজেক্টের দায়িত্ব আমার। ফোনটা এসেছিল তখনই। স্বয়ং ভি পির। 'ওয়েলকাম টু এ বি সি ডি ও'।তারপর একটা দুটো মামুলি কথা। কোন্ প্রজেক্ট পেয়েছি - শুনেই বলে উঠলেন-'ওহ দ্যাট প্রজেক্ট! প্রজেক্ট ইম্পসিবল!' সেই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। করে দেখিয়ে দেব বলেছিলাম মনে মনে। পাইলট প্ল্যান্টের ছ'টা রিয়াকটর গ্রাস করে নিয়েছিল আমাকে সেই মুহূর্ত থেকে। ছ'টা রিয়াকটর, কাস্কেডেড, পেরিস্টলটিক পাম্পের টিউব বেয়ে নেমে আসছে ঘন লাল স্লারি, ডোসিমিটার থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় অ্যাসিড-কন্টোল প্যানেলে ডোসিং বদলাচ্ছি, রিয়াক্টারের কাছে দাঁড়ালেই শোনা যাচ্ছে অ্যাসিড আর ঘন লাল তরল সংস্পর্শের আওয়াজ, ইম্পেলরের ব্লেডের অবিরাম গোঁ গোঁ আওয়াজ, টাইটানিয়ামের বাস্কেটে লোডেড রেসিন, এলিউশনের টিউব বেয়ে গড়িয়ে আসছে সোনালী হলুদ প্রেগ্নেন্ট লিকার। এই আমার পৃথিবী। গত দেড় বছর। তুচ্ছ হয়ে গেছে আমার দিনরাত। আমার দৈনিক পথশ্রম, আমার চারঘন্টার ঘুম, আমার ব্যক্তিগত জীবন। এক একটা ক্যামপেন শেষ হয়, অ্যানালিসিস ডেটা আসে, ঘাড় গুঁজে অঙ্ক কষি-পরিশুদ্ধতার হিসেব-ইউরেনিয়াম ডিকে চার্টের দিকে চোখ - টার্গেট রিচ করতে আর কত দেরি? যে কাজ ইম্পসিবল বলেছিলেন ভি পি, এখন তা প্রববেল। শেষ ল্যাপটাই বাকি। আর একটা কি দুটো ক্যামপেন পাইলট প্ল্যান্ট। ব্যাস। আলো দেখা যাবে টানেলের শেষে।
গতকাল আমাদের একটা ক্যাম্পেন শেষ হয়েছে। অ্যানালিসিস ডেটা আসতে শুরু করেছে সবে। আমার কিউবিকেলের জানলা দিয়ে একটা ইয়ুক্যালিপটাস গাছ দেখা যায়।আজ গাছটার ডালে দুটো সাদা পাখি দেখছিলাম। ইয়ুক্যালিপ্টাসের পাতার গন্ধ আসছিল ঘরে। পেয়ারাগাছটার কথা মনে পড়ছিল। পেয়ারাপাতার কষা স্বাদ,গন্ধ। জেঠু বলেছিল-দেশে ওরা সিগারেট খেয়ে চিবোতো পেয়ারাপাতা। দেশের কথা বলত জেঠু। বাবার দেশ, জেঠুর দেশ।
আমার বাবাকে দেশ ছাড়তে হয় ষোলো বছর বয়সে। আমি নিজেই দেশ ছেড়েছি আমার তিরিশে। গবেষণার কাজের একটা সুযোগ আসে এ দেশে। হঠাত্ই। চলে আসি। দেশে কাজকর্ম নিয়ে খুব একটা স্যাটিস্ফায়েড ছিলাম না। পুল অফিসার হয়েছিলাম দীর্ঘদিন। বসের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। ইনস্ট্রুমেন্ট কিনতে চেয়ে বারবার শুনতে হচ্ছিল টাকা নেই- এটা হবে না, সেটা হবে না। চলে এলাম। নিজেকে বোঝালাম-বিজ্ঞানীর দেশ বলে কিছু হয় না কি। ছবি আঁকব -সে যেখানেই হোক। দেওয়াল পেলে দেওয়াল। যদি মনোমত ক্যানভাস পাই, ছেড়ে দেব? চলে এসেছি বছর পাঁচেক। এতদিনে এখানকার সিটিজেনশিপ নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল আমার। সবাই বলে। অমৃতাও। জেদ করে। চাপ দেয়।
আমার বাবার দেশ ছাড়া নিয়ে আক্ষেপ ছিল না কোনো। ঠাকুমার ছিল। আর জেঠুর। জেঠু মেনে নিতে পারে নি দেশ ছেড়ে আসা। মেন্টালি ডিসব্যালান্সড প্রথমে। তারপর বদ্ধ উন্মাদ। বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেত হঠাত্ হঠাত্। কিছুদিন পরে কেউ না কেউ কোথা থেকে যেন ফিরিয়ে আনত জেঠুকে। গোঁফ, দাড়ি, লম্বা চুল, নোংরা শার্ট, পাজামা। অচেনা অজানা রেলস্টেশনে বসে থাকত। সিরাজগঞ্জের টিকিট চাইত টিকিটঘরে। খুব ছোটোবেলায় আমাদের অনেক গল্প বলত জেঠু। জেঠুদের দেশের গল্প- বাতাবিলেবুকে বলত জম্বুরা-তাই দিয়ে ফুটবল, নদীর চর ভাঙা-ভাঙা চরে বাসুদেবের মন্দির, গ্রামের শ্মশান, চিতার পাশের সর্ষেক্ষেত, জঙ্গলের গাবগাছ, বেতফল, সিন্দুক, কৃষেঞ্ঝর হাতের রুপোর বাঁশি -এইসব গল্প বলত। সে দেশ অচেনা লাগত আমার। পুরো অচেনা। আর , গল্পগুচ্ছ থেকে ঠিক দুটো গল্প পড়ে শোনাতো। আর একটা ছোটো আয়্না নিয়ে আসত গল্প পড়ার সময়। দাড়ি কামানোর আয়না। আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটতো -মাথা দুলিয়ে বলতো-এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না।।। এই সময় আমার বোন কেঁদে উঠত ভয় পেয়ে। মা দৌড়ে এসে নিয়ে যেত বোনকে। আমি বসে থাকতাম জেঠুর তক্তপোষে। তক্তপোষের দুটো তক্তায় মাঝে মাঝে চিপটে ধরতো আমার হাফপ্যান্ট। জেঠু তখন রিপিট করেই যাচ্ছে , করেই যাচ্ছে , আয়নার কাঁচে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে আর বলছে--যথাস্থানে পহুঁছিতে লাগিল।।। যথাস্থানে পহুঁছিতে লাগিল ।।। আয়নায় টোকা মেরেই যাচ্ছে আর বলছে -যথাস্থানে যথাস্থানে ।।।যথাস্থানে।।। আমি হাফপ্যান্ট ছাড়িয়ে পালিয়ে আসতাম। মা-র কাছে।
এখানে আমার অ্যাপার্টমেন্ট। বাড়ি নয়। নিজেরও নয়। রেন্টে আছি। এদেশে নিজের বাড়ি নিয়ে একটা দ্বিধা এখনও রয়েই গেছে আমার। ছোটো একটা বাড়ি, দোতলা। গ্যারাজ, বাস্কেটবলের হুপ একটা,লন, ব্যাকইয়ার্ডে ভেজি প্যাচ, সুইমিং পুল। রঙীন বল, একটা ট্রাইসাইকেল। ভাবতে ভালো লাগে । নিজের মত ক্যানভাস পেয়েছি। কিন্তু মাটি, বাড়ি ভাবলেই মনের মধ্যে একটা পাগল চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সিরাজগঞ্জের টিকিট চায়। পাগলটাকে চুপ করাতে হবে। অমৃতা খুব চাইছে ইদানিং। কনসিভ করার পর থেকেই।


গত মাসে কয়েকটা বাড়ি দেখেছিল ওরা। অভি আর অমৃতা।বাড়ি কেনার কথা এবারে সিরিয়াসলি ভাবছে অভিষেক। একটা বাড়ি পছন্দ হয়েছে। শহর থেকে সামান্য দূরে। অভিষেকের লম্বা জার্নির প্রয়োজন হবে না। বাড়িটা দোতলা। ব্যাল্কনিতে দাঁড়ালে দূরে নীলচে সবুজ পাহাড়। গেটের পাশে ম্যাগনোলিয়া গ্র্যান্ডিফ্লোরা-থোপা থোপা ফুল।
গোয়ালন্দের পাগল খুব সম্ভব ঘুমিয়েছে। যাপনদিন মন্থর, মসৃণ। এই মুহূর্তে।

আজ কিউবিকলে একাই ছিল অভিষেক। স্পেড্র্শীটে অঙ্ক কষছিল। লাস্ট ক্যামপেনের ডেটা আসতে শুরু করেছে। ও অংক কষে, ইউরেনিয়াম ডিকে চার্টের দিকে তাকায়-ওর বুকের মধ্যে একটা হাল্কা শিহরণ হয়। টার্গেট রিচ করতে আর দেরি নেই বেশি। মনিটরের ওপরে, পাশে স্টিকি নোট-ইকুয়েশন, ফরমুলা, চটজলদি খুচরো হিসেব, টার্গেট এইসব। ঈষত্ অন্যমনস্ক অভিষেক আলতো টোকা দেয় হলদে স্টিকি নোটে। চশমা খোলে, পরে। এই সময় ওর আউটলুক মেইলবক্সে একটা মেইল আসে। আনএকসপেক্টেড যদিও, মেইলের বক্তব্য সহজ ও স্পষ্ট-অর্গানাইজেশনে সামান্য কিছু রদবদল আসন্ন। শিগ্গিরি ঘোষিত হবে বদল।গুজবে কান না দিতে সমস্ত কর্মচারীকে অনুরোধ করা হচ্ছে।নিয়মিত আপডেট জানানো হবে। ও দুবার পড়ে, তিনবার পড়ে। তারপর বসের নম্বর ডায়াল করে। বিজি ।ও করিডোরে বেরিয়ে আসে। ভেন্ডিং মেশিনের সামনে অ্যানা, আর রাকেশ। অভিষেক এগিয়ে গিয়ে বলল। 'মেইল দেখলে?'
রাকেশ ঝোলা গোঁফে হাত বুলিয়ে খ্যা খ্যা করে হাসল খানিক-'প্যানিক করছ কেন? রিপোর্টিং স্ট্রাকচার বদলাবে। তোমার আমার কি?' রাকেশ ভেন্ডিং মেশিনের বাটন টেপায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
'কিছু প্রবলেম হবে না বলছ?-বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান হাতের পাতায় চাপ দেয় অভিষেক। এটা ওর মুদ্রাদোষ। অ্যানাবেল বলে-মেগ রায়ানের মত অ্যানাবেল-বিয়ে করেছে সদ্য-'দ্যুত্ বাদ দাও। কিস্যু হবে না। এই রকম মাঝে মাঝে এক একটা কথা ওঠে। আগেও হয়েছে। কিছু হবে না। তোমার প্রজেক্ট কদ্দূর?' অভিষেক হাসে। তৃপ্তির হাসি। ভেন্ডিং মেশিনে খুচরো পয়সার ঝনঝন। অভিষেক আর দাঁড়ায় না। টয়লেটে গিয়ে ঘাড়ে চোখে জল দেয়। তারপর সটান ওর বসের ঘরে নক করে। বস সম্ভবত: ফোনে-এ ছিলেন-বাইরে দাঁড়িয়ে আবছা মনে হ'ল অভিষেকের। ফিরে আসবে কি না ভাবল, আর তখনই উনি ওকে ডাকলেন।অভিষেক মাথার চুলে আঙুল চালায়, বলেই ফেলে-'হঠাত্ এই রিস্ট্রাকচারি?'ংঅভিষেকের বস নামজাদা ব্যক্তি। শখ কোটেশন সংগ্রহ। অভিষেক এঁকে প্রায় গুরুদেব মানে। হাস্যময় সর্বদা। আজ ওঁকে সামান্য গম্ভীর লাগল অভিষেকের। ফোন বাজছিল ক্রমাগত। উনি ধরলেন না। অভিষেকের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমিও যেখানে, আমিও সেখানেই। উই আর ইন আ লিম্বো, অনেস্টলি।' আবার ফোন বাজল। উনি আবার ইগ্নোর করলেন। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। দুটো আঙুল দিয়ে কপালের মধ্যিখানটা বোলালেন। তারপর বললেন, 'নেক্স্ট ক্যাম্পেনের বাজেট এখনও অ্যাপ্রুভড হয় নি। মনে হয় দেরি হবে এই সব ডামাডোলে। তুমি কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। কি জানো, হয়তো ভালই হবে। সামটাইমস উই স্টেয়ার সো লং অ্যাট এ ডোর দ্যাট ইজ ক্লোজিং দ্যাট উই সি টু লেট দ্য ওয়ান দ্যাট ইজ ওপেন।' এবার বসের ব্ল্যাকবেরিটি অনবরত জানান দিতে থাকে বার্তার। অভিষেক বেরিয়ে আসে। শুনতে পায়, ফোন বাজছে আবারও, আর কথা বলছেন উনি। কিউবিকলে ফিরে আসে। স্পেড্র্শীটে কনসেন্টেট্র করতে চায়। পারে না। বসের কোট করা লাইনটা খচখচ করে কোথাও। অস্বস্তি হয় ওর। বাইরে চোখ যায়। ইউক্যালিপটাস গাছটা। সেই দুটো পাখি।ও অমৃতাকে ফোন করে। বলে, চলে আসছি।



বিকেলের দিকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় টোবি। যে বিকেলে ওর কাজ থাকে না-সেই সব বিকেলে। জঙ্গলের দিকে যায়, জলের দিকে। ক্রীকের পাশে হাঁটে।
জঙ্গল পেরিয়ে ঘাসজমি। মরা ঘাস, ঈষত্ হলুদ। কোথাও বাদামী।জোলো বাতাস ওর চৌখুপি শার্টের পিঠে লাগে। ও শুয়ে পড়ে। আকাশ দেখে। হাত মেলে দেয় ঘাসে। আকাশ জুড়ে সিউরোকিউম্যুলাস। মেঘে মেঘে প্ল্যাটিপাসের মুখ ভেঙে কখনও ক্যাঙারু কখনও ডিংগো-আবার ভেঙে গিয়ে একদম বুড়ো জনের মুখ। পাখি উড়ে যায় এক ঝাঁক। পাহাড়ের ওপারে লোডার দেখা যায়। ক্রেন। ও গালে হাত বোলায়। খড়ি ওঠা ভারি হাত ওর। বল্কল সদৃশ ত্বক। খস্খসে। শিরা ওঠা।কাঁচা পাকা বড় লোম বাহুময়। ওর কুকুর আজুজু লেজ নাড়ে। দৌড়োয়।মাথা ঘুরিয়ে পিঠের পোকা তাড়ায়। থাবা দিয়ে কান চুলকোয়। তারপর দু থাবা মেলে ঘাসে মুখ রাখে। টোবির বুক টন টন করে অবান্তর মায়ায়। আজুজুর জন্য, এই ঘাস, জল, বাতাস, পাখিগুলির জন্য। বুড়ো জনের কথা মনে হয়।দু হাত ছড়িয়ে দেয় ঘাসের ওপর। পা মেলে দেয়। শিকড় গজায় যেন ওর সর্বাঙ্গে।
আকাশে তারা ফোটে। নক্ষত্রমন্ডলীর ওপর আলতো মেঘ। ওর পায়ের পাতায় পিঁপড়ে বায়। হাতের চেটোয়। মরা আলোয় ও দেখে পিঁপড়ের সারি। কালো পিঁপড়ের লম্বা সারি। পিঁপড়ের সারি ক্রীকের পাশে হেঁটে চলেছে। আশ্চর্য হয় টোবি তারপর হেঁটে চলে ওদের সঙ্গে।ক্রীকের পাশেই একটা মরা পাখি। ফিঞ্চ। তার পাশে কাকাতুয়াটা। পেট উল্টে। পিঁপড়ে থিকথিক করছে সর্বাঙ্গে। সাদা শরীর, সাদা পালক ঢেকে ফেলেছে কালো পিঁপড়ে। ও আকাশ দেখল। হাল্কা মেঘ তারার ওপর। মেঘ সরল। আরও একটা পাখি। তার পাশে আরো একটা।



ইদানিং অমৃতার পায়ের পাতা বেশ ফুলে উঠছে। অফিসে সমস্ত দিন ডেস্কে। জুতো খুলে ফুটরেস্টে পা রেখেই কাজ করে অমৃতা। লেখা, এডিটি,ং গুচ্ছের ফোন।।। সব ডেস্কে বসেই। বাড়ি ফেরার সময় জুতো ঢোকাতে গিয়ে পা ঢোকে না প্রায়শই। এই কসরতের সময়ই ফোনটা এল। অভির।
- বেরোচ্ছো?
-হ্যা ,ঁ এই তো -পাঁচ মিনিট। জুতোর সঙ্গে লড়ছি।
-শোনো, আমার দেরী হবে একটু। অপেক্ষা কোরো না তুমি। খেয়ে নিও।
-কি হয়েছে?
-টেন্শনের কিছু নেই । একটা সাইট মিটিং ডেকেছে হঠাত্ই। কখন শেষ হয়-
-হঠাত্ সাইট মিটি?ং এই অসময়ে? তোমাদের সেই রি স্ট্রাকচারিং এর ব্যাপারে নয়তো?
- হু,ঁ সে নিয়েই। কি ব্যাপার বুঝতে পারছি না।
- হয়তো রিপোর্টিং স্ট্রাকচার নিয়ে অ্যাড্রেস করবে
-আসলে, আজ সকালে আমার বস রিজাইন করেছেন
-সে কি! কেন?
-শোনো, টেন্শনের কিছু নেই। একদম টেন্শন নয়। কেন জানি না। কথা হয় নি। অফিসিয়ালি কোনো কারণ জানানো-ও হয় নি। সব মিলিয়ে একটু ঘোরালো দেখাচ্ছে। আর প্রচুর গুজব বাজারে। এবিসিডি আর আমাদের রাইভ্যাল আইজেকেও মার্জ করবে নাকি।
-অভি, টেন্শন করছ তুমি। তোমার প্রজেক্ট চলা নিয়ে কথা। বস বদল হ'বে তোমার। কি এসে গেল?
- আমি রাখি এখন। পরে ফোন করব। সাবধানে ড্রাইভ কোরো। আর শোনো, প্রপার্টি ডিলারের ঐ ছেলেটার নম্বরটা বের করে -কি যেন নাম-পিটার পিটার-আজ নয় কাল বলে দিও, আমারা জ্যাকারান্ডা অ্যাভিনিউর বাড়িটা নিয়ে আর এগোচ্ছি না। পরে দেখা যাবে। সাবধানে ড্রাইভ কোরো কিন্তু।

অভিষেক যে কথা চেপে গেল ইচ্ছে করেই তা হোলো ওদের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কেউ এই সাইট মিটিং অ্যাড্রেস করছেন না-সি ই ওর তরফে একজন আসছেন যিনি এই গোটা রিস্ট্রাকচারিং হ্যান্ডেল করছেন।ওরা এই ভদ্রলোকের থেকে প্রতি দু সপ্তাহে একটি করে নিউজ লেটার পায় -অত্যন্ত যান্ত্রিক ভঙ্গিতে একই কথা লেখা থাকে তাতে। ওরা আর আজকাল সেভাবে পড়ে না সে মেইল। জাস্ট চোখ বুলিয়ে ডিলিট করে।তিনি আসছেন কেন সাইট মিটিংএ?

সন্ধ্যে নামছে যখন, অমৃতা সিঁড়ি ভাঙছিল। এলিভেটর নেই। একতলা দোতলা তিনতলা। গন্ধ পাচ্ছিল। গেরস্থালির গন্ধ।বারবিকিউর, লন্ডির্র, উথলানো দুধের। ও যখন ওদের অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলল -এই সমস্ত গন্ধ-দুধের গন্ধ, মাছের গন্ধ, ডিটার্জেন্ট-সব গন্ধ একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে ঢুকল ঘরে। কার্পেট শুষে নিল সব গন্ধ-আলাদা করে নিজের সংসারের গন্ধ পেল না ও। অথচ একদম আলাদা-একান্ত নিজস্ব একটা গন্ধ পেতে চাইছিল অমৃতা-বেবি পাউডার,কিম্বা ম্যাগনোলিয়া গ্র্যান্ডিফ্লোরা-
ও বাথরুম গেল, জল দিল চোখে মুখে।তারপর রিসিভার তুলে ডায়াল করল অভিষেকের নম্বর। বিজি। আবার করল। বিজি।একটু অস্থির লাগল শরীর।জল খেয়ে ডায়াল করতে যাবে আবার , অভি-ই ফোন করল।
-অভি?
-খেয়েছ?
-না, কখন আসছ? ঠিক আছে সব?
-স্লাইট ঝামেলা মনে হচ্ছে
-কি ঝামেলা?
-আমাদের এই রিসার্চ ডিভিসন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সামনের মাস থেকে। এবিসিডি আউটসোর্স করে দিচ্ছে রিসার্চ।
শুনছ?
-একে স্লাইট ঝামেলা বলছ তুমি?
- টেন্শন কোরো না ।এই এতগুলো প্রজেক্টের কাজ-কাউকে তো করতে হবেই। আমার প্রজেক্টটা পাচ্ছে একটা গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন। শুনছ? আমাকে খুব সম্ভব ওখানে নিয়ে নেবে। কাল ওখান থেকে লোক আসছে ইন্টারভিউর জন্য। সব ছক করা ছিল। আমরা কিচ্ছু জানতে পারি নি। এই চাকরি যাওয়া, ইন্টার্ভিউ অ্যারেঞ্জ করা কম্পানির তরফ থেকে-এসব একদিনে হয়? কিছু বলছ না?
- কখন আসবে তুমি, অভি?
- রাত হবে। শোনো, আমার নীল ফোল্ডারটা বের করে রেখো তো-যেটাতে পাসপোর্ট আর সার্টিফিকেটগুলো আছে। কাল ইন্টারভিউতে লাগবে।

পরদিন প্রথম পর্বের ইন্টারভিউ নিতে সংস্থার কর্ণধার- বৃদ্ধ বিজ্ঞানী এসেছেন স্বয়ং। মামুলি প্রশ্ন। প্রজেক্টের কথা। কিছু টেকনিকাল ডিটেইল্স। অভিষেক ইতস্তত: করছিল এবিসিডির সঙ্গে ওর আই পি কপিরাইট এগ্রিমেন্টের কথা ভেবে। বৃদ্ধ আশ্বস্ত করলেন। অভিষেক বলে চলল প্রজেক্টের কথা। ওর চোখে ভাসল ছ ছটা কাসকেডেড রিয়াকটর, কানে বাজল ইম্পেলারের অবিরত ঘূর্ণনশব্দ, ও যেন দেখতে পাচ্ছিল স্লারিতে মাখামাখি টাইটেনিয়াম বাস্কেট,সুগোল রেজিন, সোনালী হলুদ প্রেগ্নেন্ট লিকার। অভিষেক বলে চলল-ওর কন্ঠস্বরে কখনও আবেগ, কখনও চাপা গর্ব ওঠাপড়া করতে লাগল-নি:শ্বাস দ্রুততর- ওর ইনভলভমেন্ট সুস্পষ্ট হচ্ছিল প্যানেলের কাছে।
-দিস প্রজেক্ট মেন্ট আ লট টু মি।
-উই নো দ্যাট। বৃদ্ধ মৃদু হাসেন।
অভিষেক গুছিয়ে নিচ্ছিল ওর কাগজপত্র। ইন্টারভিউ শেষ হয়ে এসেছে। মামুলি কথা চলছে। ফুটি লীগ, ক্রিকেট, রাগবি, রিসেন্ট ধুলোর ঝড়।
বৃদ্ধ বললেন, 'দ্বিতীয় দফায় আরো একটা ইন্টারভিউ হবে। আমাদের ওখানে। আমাদের ফেসিলিটিও দেখা দরকার।' হেসে বললেন, ' এতদূর ট্রাভেল করতে হবে না আর তোমার।'
অভিষেকও হাসল। উঠবে এবার। বৃদ্ধ বললেন, হোপ ইউ আর আ সিটিজেন। অভি, আমাদের সংস্থায় কিন্তু সিটিজেনশিপ ছাড়া এলিজিবল গ্রাহ্য করা হয় না। জানো বোধ হয়।
অভিষেকের গলা শুকিয়ে গেল। পেটের ভেতর ফাঁকা।' না, আমি পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট। আমি এলিজিবল নই?'
বৃদ্ধ অবাক হলেন। চশমা খুললেন, পরলেন। কপালে মৃদু টোকা দিয়ে বললেন,'ওয়েল ইন দ্যাট কেস, আমরা তোমাকে কন্ডিশনাল অফার লেটার ইস্যু করতে পারি। বাট ইউ হ্যাভ টু গেট দ্য সিটিজেনশিপ উইদিন আ সার্টেন পিরিয়ড অফ টাইম। ইট'স আপ টু ইউ। হাউ মাচ ডু ইউ ওয়ান্ট ইয়োর বেবি ব্যাক-'

যতবারই ফোন করে অমৃতা, অভির মোবাইল সুইচড অফ। ও জল খায়। বাথরুমে যায় আর বারে বারে অভির নম্বর ডায়াল করে। বাইরের আলো কমে আসে। গৃহস্থের ঘরে আলো জ্বলছে । ওদের সিঁড়িতে মৃদু আলো, গৃহস্থের ঘরে ফেরার শব্দ, গন্ধ -টিভির নিউজ, লন্ডিতে ড্রায়ার চলছে, ফোন বাজছে কোথাও। এ সমস্ত ছাপিয়ে অমৃতা এখন কেবল ওর নিজের হদৃপিন্ডের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছে। নিতান্ত অভ্যাসে বা আদ্যন্ত মনোযোগে অভিষেকের নম্বর ডায়াল করেই চলেছে অমৃতা।

ঠিক এই সময় একটা টানেল পেরোচ্ছে অভিষেক। অখন্ড জমাটবাঁধা অন্ধকার পাথরের দেওয়াল-নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ম্লান আলোকদানগুলি পেরিয়ে যাচ্ছিল সে-দ্রুত থেকে দ্রুততর-দ্রুত থেকে দ্রুততর-পেরিয়ে যাচ্ছিল তার শৈশব, তার বাল্য-পেরিয়ে যাচ্ছিল তার অনন্য পেয়ারাগাছ-তার বারান্দা-তার হাফপ্যান্ট চেপে ধরা তক্তপোষ-দাড়ি কামানো আয়্নায় একটা আঙুল নামছিল-উঠছিল-
দীর্ঘ টানেলের শেষে নিয়নসাইন, আলোজ্বলা বিজ্ঞাপনসমূহ, রেলস্টেশন। পান্থজন, স্থির ম্যুরালচিত্র, চলমান ট্রেনগুলি। দরজা বন্ধ হয়, খোলে। এস্কালেটরের মাথার ওপর ঝুলন্ত আলো, ডিসপ্লে বোর্ড, ট্রেনের সময়। সে কোথায় যায়? রাত বাড়ে। একসময় তার চতুর্পার্শ্বে ধু ধু প্ল্যাটফর্ম, গন্তব্য-ঠিকানাহীন নীল ডিসপ্লে বোর্ড।মুখের ওপর হাজার স্পটলাইট। দর্শকহীন শূন্য বেঞ্চ প্ল্যাটফর্ম জুড়ে। টুপি , দাড়ি-পাগলাটে কেউ পে ফোনের বাক্স হাতড়াচ্ছে খুচরোর আশায়।

পরদিন সকালে অমৃতা তাকে অবিষ্কার করে সেন্টাল স্টেশনের বেঞ্চে। ঝুলন্ত ডান হাত, বুট পরা পা ঝুলছে, গোটানো আস্তিন, মোজা। ঘুমন্ত অভিষেক। বুকের ওপর বাঁ হাত। হাতের তলায় পাসপোর্ট।

এই সব লোকালয়, জনপদ ছাড়িয়ে জল, জঙ্গল, পাহাড়। পাহাড় পেরিয়ে ধু ধু বিস্তার। টোবি এখন বদ্ধমাতাল।মৃত পাখি কুড়িয়ে ফিরছিল সে। শিকড়বিহীন মেঘমানুষ। এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়।।।।
৭ 'The ABCD uranium mine inside the World Heritage park listed is leaking 100,000 litres of contaminated water into the ground beneath the park every day, a Government appointed official has revealed.
The supervising officer appointed to monitor the mine's environmental impact, confirmed at a Senate committee hearing that about 100 cubic metres a day — the equivalent of 100,000 litres or three petrol tankers — of contaminant were leaking from the mine's tailings dam into rock fissures beneath ...
The mine's owner, ABCDO has been repeatedly warned about its management of the mine, with a previous government-appointed personnel declaring that ABCDO was "complacent" about protecting workers and people living near the mine.
...Death of a large number of birds reported..'

লিখছি, পাখি গুণছি-মরা পাখি-নিরাবলম্ব-টুপটাপ খসে পড়ছে-ডানায় জোর নেই।চোখ বুজে আসছে আমার আর শেষরাতের স্বপ্নটা ফিরে আসছে এই সময়।।।
একটা বাড়ি তৈরী হচ্ছে। কোথাও। লম্বা বাঁশের ডগায় ঝুড়ি ঝাঁটা হাওয়াই চপ্পল। সিমেন্টের বস্তা।। ইঁটের পাঁজা। বালির স্তূপ। স্টোনচিপস। বালক অভি। উবু হয়ে বসা।। হাফ প্যান্ট, গোলগলা গেঞ্জি। একটা লোক- তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।।। কোদাল দিয়ে সিমেন্ট বালি মিশিয়ে একটা ঢিপি তৈরি করছে। ঢিপির মাথাটা কেটে ছোটো গর্ত করছে একটা। বালতি এনে জল ঢালছে তাতে।ভাঙা বালতি। বালি সিমেন্ট সে জল শুষে নিচ্ছে। আরো জল ঢালছে লোকটা। জল উপচোচ্ছে। গড়িয়ে আসছে আমার পায়ের কাছে। জলে আঙুল দিয়ে চাতালে দাগ কাটছি। লম্বা দাগ। জ্বালা করে উঠছে আঙুল। আঙুলের ডগা। তর্জনী। মধ্যমা।



মাসতিনেক হ'ল জয়েন করেছি। সব কন্ডিশন মেনে। জাস্ট আ পিস অফ পেপার। বন্ধুরা-এখানকার সব বন্ধুরা-রাকেশ-নন্দিতা, নীরভ, গোপী-সকলেই তাই বলে। আপাতত: রুটিনমাফিক ইন্ডাকশন, ট্রেনিং শেষ। এ বি সি ডি ও এখন আমার ক্লায়েন্ট।তবে কাজ শুরু হয় নি এখনও। কিছু এগ্রীমেন্ট পেপারওয়ার্ক বাকি । খুব সম্ভব। এ ব্যাপারে অন্ধকারে আমি। আপাতত: ছোটো একটা প্রজেক্টের দেখভাল করছি। অন্য ক্লায়েন্টের। আর অপেক্ষায় আছি টু গেট মাই বেবি ব্যাক।
আমার সেই সময়ের পৃথিবী-আমার ছ ছটা রিয়াকটর এখানে পৌঁছে গেছে গতমাসে। ছটা রিয়াকটর, রেজিনের জাল, ইম্পেলরগুলি, ডোসিম্যাট-পাইলট প্ল্যান্টের এক কোণে একা দাঁড়িয়ে। পাইলট প্ল্যান্টে যাই অন্য কাজে আর আলতো হাত বুলিয়ে আসি।
অমৃতার মিসক্যারেজ হয়েছে। গতমাসে।
ইদানিং আমরা আবার বাড়ি দেখছি।পছন্দমত পাই নি এখনও। সেই যে বাড়িটা-গেটের পাশে ম্যাগ্নোলিয়া গ্র্যান্ডিফ্লোরা -বারান্দায় দাঁড়ালে দূরে পাহাড়-কিনে নিয়েছে অন্য কেউ। আমার এক্স বস আইজেকেও তে জয়েন করেছেন। আপাতত: এবিসিডি আর আই জে কে ও -দুই আমাদের ক্লায়েন্ট। রাকেশ ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে। অ্যানাবেল এইমুহূর্তে কিছু করছে না। শি ইজ এক্সপেক্টিং।
ফোন বাজল। ডিরেক্টারের ফোন। বললেন-'ইয়োর বেবি জাস্ট অ্যারাইভড। ফাইল পাঠিয়ে দিচ্ছি। সফ্ট কপিও। দেখে নাও। কাজ শুরু করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এ বি সি ডি ও আমাদের সব থেকে বড় ক্লায়েন্ট।'



মাথার ওপর কালপুরুষ। উত্তরে মাথা, দক্ষিণে পা।তিনতারার কোমরবন্ধনী। জঙ্গল জুড়ে নিকষ আঁধার। পাহাড়ের ওদিকটা আলো। খনি, বসতি, ক্রেন। আমার পিঠের নিচে শুকনো মরা ঘাস, জোলো হাওয়া -পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। বুড়ো জন বলত-পৃথিবী ঘুমোয় যখন, তাকে ছুঁয়ে কানে কানে বোলো। সে শোনে।
আমি ছুঁলাম তাকে। হাতে ঠেকল ভাঙা বোতলের টুকরো, দুর্গন্ধ বমি। আবার হাত বাড়ালাম। ভাঙা কাঁচ এর পাশে মরা ঘাস, মৃত পাখি, বিষজল ঘিরে পিঁপড়ের সারি। সর্বাঙ্গে পিঁপড়ে বাইছে। আমার হাত পা পায়ের পাতা মাথার চুল রোমরাজি। ভরে যাচ্ছে পিঁপড়েয়। অন্তহীন পিঁপড়ের সারি -হেঁটে চলেছে-হেঁটেই চলেছে- থিকথিকে একটানা কালো স্রোত - ঢেকে দিচ্ছে পাহাড়, ইউক্যালিপটাস, ঘাসজমি, আজুজু, উদ্যত চঞ্চু ও ঝাপটানো ডানা। ডানা, গল্পমালা।
আকাশ নেমে আসছে নিচে -



১০
অভিষেক ল্যাপটপ খোলে। এ বি সি ডি র ফাইল। সেই প্রজেক্ট-সেই কোড। ওর বুক কাঁপে। ইউরেনিয়াম ডিকে চার্টে চোখ বুলোয় ও। ফাইল খোলে। প্রথম কটি পৃষ্ঠা এগ্রীমেন্টের শর্ত, নিয়ম-বৃদ্ধর দস্তখত। এ বি সি ডির তরফের কোনো কর্তা ব্যক্তির দস্তখত। অভিষেক তাকে চেনে না। রিসার্চের কেউ নন।
তারপরের পাতা জোড়া গ্যান্ট চার্ট। পাতা উল্টে প্রজেক্ট ডিটেইল্স।
প্রতিটি অক্ষর অচেনা তার। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য অচেনা। সম্পূর্ণ একটি নতুন প্রসেস লিপিবদ্ধ এখানে। অচেনা কন্ডিশন। যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে সে বাজি রেখেছিল তার গোটা পৃথিবী-বিন্দুমাত্র রেফারেন্স নেই কোনো। অথচ সেই ঘন লাল তরল। সেই টার্গেট। অথচ ভিন্ন পন্থা। ক্লায়েন্ট ডিফাইন্ড প্রজেক্ট একটি। তার বাইরে আর কিছু নয়। কিচ্ছু নয়। নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছিল অভিষেকের। ব্যবহতৃও। ওর মস্তিষ্ক, হদৃয় দুই-ই জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল। বুক জ্বলছিল। দুই চোখ। ল্যাপটপের মনিটর ঝাপ্সা দেখাচ্ছিল। গত দেড় বছরের প্রতিটি মুহূর্ত ওর কাছে ফিরে আসছিল। ওর না হওয়া ঘুম, ওর অতৃপ্ত দাম্পত্য সুখ, ওর মৃত সন্তান, সর্বোপরি ওর জন্মভূমি ওর কাছে নিরন্তর জবাব দাবি করছিল।
ফোন বাজছিল। ও দ্বিধা করল। তারপর হাত বাড়ালো। গলা খাঁকরে পরিষ্কার করে নিল রুদ্ধস্বর-'ইয়েস, হ্যাপি ক্লায়েন্টস আর আওয়ার গোল। ইয়েস, আই ডু রেমেমবার।'

আজও অমৃতা অভিকে পাচ্ছিল না ফোনে।বিজি বিজি বিজি। অথচ ওর টেন্শন হচ্ছিল না কোনো। ও পাখি ভাবছিল-বিষজল, পাখিদের মরে যাওয়া।ওর শরীর কাঁপিয়ে কান্না আসছিল। ওর জগতে অভিষেক ছিল না। পাখি ছিল, জল ছিল আর ওর অজাত সন্তান। একটা লম্বা রাস্তা দেখছিল অমৃতা-শেষ নেই। হলদে রং। সিপিয়া আকাশ থেকে পাখি ঝরে পড়ছে। মরা পাখি। অথবা মৃত ভ্রূণ। বিষজল ভাসিয়ে নিচ্ছিল ওর ঘরদোর, সিঁড়ি, চরাচর। বিষজল। বিষাদজল। সেই জল বেয়ে ভেসে আসছিল অক্ষর, শব্দ, বাক্য, কথা, কথামালা।।।

এই সব লোকালয়, জনপদ ছাড়িয়ে জল, জঙ্গল, পাহাড়। পাহাড় পেরিয়ে ধু ধু বিস্তার।
সেখানে আজ বাতাস ছিল সামান্যই। পাতা কাঁপছিল। জংলী ঝোপের ছোটো পাতা। কালচে বাদামী। সবুজ ছিল না কোনো। আকাশে ঝুলে ছিল অবান্তর চাঁদ। রুক্ষ পাথুরে মাটি নুড়ি আসন্ন পূর্ণিমার আলোয় ছাইএর মত লাগছিল। কালচে ধূসর। ধুলো উড়ছিল । অল্প। ধু ধু বিস্তারে গাছ ছিল না।চত্তÄর জুড়ে বার্বড ফেন্স। ফেন্সের ওধারেও ছোটো ঝোপ ঝাড়। ধূসর মাটি পাথর। ধাপে ধাপে খাদ শুরু। তারপর গহ্বর। অতলস্পর্শ।
সে আসে। ভস্মরাশি মাড়িয়ে। ফেন্স টপকায়। তারপর ঝাঁপ দেয়। নুড়িপাথর ভস্মরাশি গড়িয়ে নামে তার পাশে পাশে। পাথরে ঠোক্কর খায় পাথর, দেহ।রক্ত, ঘিলু, মজ্জা। ভল্লবিদ্ধ শিকার যেমন।শব্দ ওঠে।গহ্বর তা শুষে খায়।
দেহটি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। চাঁদের আলোয়।
অনতিপূর্বেও বাতাস ছিল সামান্য। এখন নেই।


ছবি- রোহন কুদ্দুস

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস