শস্যপর্বর চার

গুণীজন বুনে চলেন নকশিকাঁথা। উপলব্ধির নিবিড় বুনোট, পারঙ্গম লেখনীর আশ্চর্য নকশা , মননের ওম। বাংলাদেশের লেখালেখি নিয়ে এই যে আলাপচারিতা ...
 রোব্বারের বিকেল। বৃষ্টি এল জোরে। জলের ছাঁট। হাওয়া মন্থর ও ভিজে। পায়ের ওপর লেপ টানলাম। লেপ বলল লিখলে না হয় ... নকশিকাঁথার এক কোণে একটি দুটি অপটু ফোঁড়- চার নবীন কথাকারের গল্পগুচ্ছের পাঠপ্রতিক্রিয়া ।
তারেক নূরুল হাসানের 'কাঠের সেনাপতি', অমিত আহমেদের ' বৃষ্টিদিন রৌদ্রসময়', মাহবুব আজাদের 'ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প' আর আনোয়ার সাদাত শিমূলের ' অথবা গল্পহীন সময়'। চারটি বইয়েরই প্রকাশক শস্যপর্ব, জিন্দাবাজার, সিলেট।
নকশা তোলা নয় তো আমার, অপটু হাতের সেলাইয়ের দু এক ফোঁড়। একটি দুটি ফোঁড়ে চেষ্টা করি তারেকের 'কাঠের সেনাপতি' বইটির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করানোর। সমালোচনা নয়, পাঠপ্রতিক্রিয়াও নয় সেই অর্থে। তারেকের লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব শুধু।

রশীদ করিমের একটি সাক্ষাৎকার।

-গল্পকে গল্প করে তোলার জন্য কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার?
রশীদ করিমঃ গল্পে থাকে একটি মাত্র ঘটনা। ঐ ঘটনা লেখকের মনে যে অভিঘাত সৃষ্টি করে, যেভাবে তার মনে উপস্থিত হয়েছে, সেটাকে অনুসরণ করে পেছন দিক দিয়ে গল্প লেখা শুরু করতে হয়। পার্শ্ব পরিবেশ, প্রতিক্রিয়া হিসাবে কয়েকটি চরিত্রও সৃষ্টি করতে হয়।

সুতোর এই লাছিটি তুলে নিলাম আমি। যে কাঁথার বুনন শুরু করেছেন গুণীজন, সে কাঁথায় আমার সুতোর ফোঁড় মেলানো চাই তো-

আসুন। শুরু করি। 'কাঠের সেনাপতির' পাতা উল্টাই।
রশীদ করিমের সাক্ষাৎকার অবধারিত মনে পড়ায় অমর মিত্রকে। তাঁর এক গল্প সংকলনের গোড়ায় বলেছিলেন- ' বিষয় নিয়েও তো লিখি না। লেখার পরে তা হয়তো বিষয় হয়ে যায়। লেখার আগে তা তো থাকে সামান্য বেদনার অনুভূতি। হয়তো কিছুই না। শূন্য থেকে যাত্রা। ... শূন্য থেকে বিষয়ে যেতে চাই। অবচেতনায় কী আছে তা তো টের পাই না'।

এই সংকলনে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে তারেক নির্মাণ করেছেন বিষয়। অনায়াস। সংকলনের ছ ছটি গল্পেই। সেহেতু বিপুল বৈচিত্র্য। প্রতিটি গল্প আলাদা কথা বলে। একদম আলাদা একে অপরের থেকে। আরোপিত কোনো শৈলী নেই । অথচ নির্মাণে , বিষয়ে, ভাষার প্রয়োগে যথার্থ আধুনিক গল্প।
প্রথম গল্প 'সমান্তরাল'এর কথাই ধরুন।
একটা মারাত্মক পরিস্থিতি কি অবলীলায় গল্পে আনলেন তারেক। আধখানা বাড়তি শব্দও আসে নি অথচ। শুনুন, পড়ি।
'অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বুঝতে বুঝতেই দেখি বাবা বের হয়ে আসছেন হন্তদন্ত হয়ে, এপাশে আলো না থাকায় আমাকে দেখেন নি-ঘাম দেয়া শরীরে ছুটতে ছুটতে চলে গেলেন নিজের ঘরে। আমি খানিকটা এগিয়ে রান্না ঘরে উঁকি মেরে দেখলাম- আমাদের কাজের ছেলেটা উঠে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশেই পড়ে থাকা লুঙিটায় চোখ মুছছে একটু পর পর। '

পরের গল্প 'বউ'। গল্পের শেষে একটা আলতো মোচড় আছে যা আদৌ নাটকীয় নয়। অথচ সেই ম্যাজিক। শূন্য থেকে কাগজের ফুল বের করে আনে যেমন যাদুকর। 'কাঠের সেনাপতি ' গল্প পিতা পুত্রের দাবা খেলার কথা একটি আদ্যন্ত আধুনিক রাজনৈতিক গল্প। এতটুকু উচ্চকিত না হয়েই। পড়ি একটু?
'রাশেদ দেখে আব্বা কেমন হাঁসফাঁস করে ওঠে, তখুনি হঠাৎ পর্দার ছবি বদলে যায়, এতক্ষণের প্রাণোচ্ছল ছবির লোকটাকে হঠাৎই দেখা যায় সিঁড়ির ওপর অদ্ভূত ভঙ্গিতে বসে আছে, চিরকালীন কালো ফ্রেম নেই চোখে, চোখ দুটো বোজা, চুল এলোমেলো। দেয়াল ধরে উড়তে থাকা চড়ুইগুলো কখন যেন থেমে গেছে, ছাতিমের গন্ধটা ঘরের মাঝামাঝি কোথাও মেঝে অব্দি ঝুলে আছে ছাদ থেকে। আব্বার থমথমে মুখ খেয়াল করে না রাশেদ, ও অস্থির হয়ে ওঠে, কিস্তি মাতের চাল, তবু দেখছে না কেন! ও বলে ওঠে, 'আব্বা, তোমার রাজা বাঁচাও!'
তার পরের গল্প 'ইঁদুর' সামান্য উচ্চকিত সংকলনের বাকি গল্পের তুলনায়। কিন্তু এখানেও সেই ম্যাজিক। বাক্যবিন্যাস, শব্দ কি ফর্মের চতুরালিতে না গিয়ে শুধুমাত্র নিপুণ ঈশারায় সামাজিক অবক্ষয়ের মত বিষয়ে পৌঁছে যাওয়ার ম্যাজিক।
পরের গল্প 'নিমন্ত্রণ'। ভূতের গল্প। এখানেও ভৌতিক পরিবেশ তৈরির জন্য এতটুকু নাটকীয়তা নেই। ছিমছাম। শিরশিরে।
শেষ গল্পটি কথাশিল্পী। এই গল্পটি হয়তো একদম শূন্য থেকে নয় হয়তো। একটা আবছা ভাবনা থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে গল্প-পড়তে পড়তে টের পাই। এই গল্পের শেষটি নাটকীয় অথচ কথনে তার চিহ্নমাত্র নেই। নিরুত্তাপ গল্প বলেছেন তারেক। অসাধারণ ছোটো গল্প একটি।
সংকলনটিকে যথাযথ বর্ণনা করেছেন মাহবুব আজাদ। বইটির ব্লার্বে।
'আমাদের বাঁচিয়ে রাখা এ সময়ের সবকিছুই যেন বড় উচ্চকিত, গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। সশব্দ জনজীবনের নির্যাস নিয়ে লেখা অনেক চড়া তারের গল্পের ভীড়ে তারেক নূরুল হাসানের গল্পগুলি যেন নিঝুম দুপুরে পুকুড়পাড়ে চালতে খসে পড়ার মতো-অতর্কিত মৃদু বোলে যে ইঙ্গিত দেয় ঘটনার চরিত্রের। .... দৃষ্টি আকর্ষণী উন্মত্ত চিৎকার নেই, আপন ঢোল ভেবে যথেচ্ছ বাদনবিভ্রাট নেই, তার গল্পগুলি যেন সন্ধ্যায় পাঠকের দোরে কোমর করাঘাত করে ডাকে, বাড়ি আছ?'

'- তরুণ লেখকদের লেখা পড়েন কি?
-রশীদ করিমঃ শুধু তরুণ কেন, প্রতিষ্ঠিত অনেক লেখকের লেখাই পড়া হয় নি। বয়স হয়েছে তো- .. '

তারেকের কোনো লেখা পড়েছিলেন রশীদ করিম সাহেব?
ফোঁড় দিতে যাই মাহবুব আজাদের ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প নিয়ে। ছুঁচে সূতো পরাবো। মনের মধ্যে গুনগুন করছেন রশীদ করীম সাহেব-
'রশীদ করীমঃ নিরীক্ষাধর্মী ব্যাপারটা আসলে কি? নিরীক্ষার জন্য নিরীক্ষা! ... আমি একটা উপন্যাস লিখতে চাই। উপন্যাসের চরিত্রগুলি যদি উন্মাদ না হয়, তাহলে তাদের আচরণের একটি পরম্পরা আছে, সম্পৃক্ততা আছে, আমার লেখা হতে হবে সেই রকম। ... আমি চাচ্ছি সাহিত্য সৃষ্টি করতে, নিরীক্ষা করতে নয়। ... '

এতটাই কি সরলরৈখিক সব? এই সব লেখালেখি? উত্তর আধুনিক এত কিছু লেখালেখি?
তবে কেন ওরহান পামুক তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা implied author  তুলে আনেন উলফ গ্যাং আইজারের ' implied reader ' কে? এই বক্তৃতার একটি বঙ্গানুবাদ আছে হাতের কাছে-সৈয়দ সমিদুল আলম কৃত। প্রকাশ কবিতীর্থ, আশ্বিন, ১৪১৭।
পামুক বলছেন, " আইজারের মতে , কোনও উপন্যাসের অর্থ নিহিত থাকে, না এর পাঠ্যাংশে, না এর পূর্বাপর প্রাসঙ্গিকতায়, বিশেষত যে পাঠ্যাংশ বা প্রবন্ধের পাঠ পাঠকেরা নিয়ে থাকেন। বরং এর অর্থ নিহিত থাকে , ঠিক এই দুয়ের মধ্যবর্তী কোথাও। ... আমি যখন স্বপ্নে ডুবে ছিলাম, অন্য একটি গ্রন্থের দৃশ্য, বাক্য এবং এর সমস্ত খুঁটিনাটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ... আর সেই মুহূর্তে এই তঙ্কেÄর কথাই আমার মাথায় আসে ও তার ফলাফল হিসেবে যে ইঙ্গিত পাই তা হলঃ স্বপ্নে দেখা কিন্তু না লেখা প্রত্যেকটি উপন্যাস যার ছক তৈরি হয়ে আছে, তার প্রত্যেকটিরই কোনও না কোনও নিহিত পাঠকসত্তা আছে।'
উপন্যাস নয়, উপন্যাসোপম বড় গল্পও( বিজ্ঞাপনের ভাষায় যেমন বলে আর কি)নয়, কেবলমাত্র ছটি ছোটো গল্প মাহবুব আজাদের সংকলনে। অথচ আমার অবস্থা হয় আমার ছোটোবেলার টিকটিকিটার মত। গরমের ছুটি ছিল তখন। দরজা জানলা বন্ধ করে খানিকটা প্রিসম সদৃশ পেপারওয়েট নিয়ে ঘরের দেওয়ালে, সিলিংয়ে আলোর একটা চাকতি তৈরি করছিলাম-রামধনু কখনও আসছিল, কখনও আসছিল না। এক টিকটিকি আকৃষ্ট হয় সে আলোর চাকতিতে। বুঝতে পেরে, আমিও তার সঙ্গে খেলায় মাতি সেই দুপুরে। লুকোচুরি খেলা। আমি আলো ফেলছি এক কোণায়, টিকটিকি সরসরিয়ে ধেয়ে আসছে, আমি সঙ্গে সঙ্গে আলো সরিয়ে নিচ্ছি অন্যখানে, টিকটিকি বেচারা কেমন বেভ্যুল হয়ে যাচ্ছে, আবার দৌড়ছে ঐ চাকতির দিকে। আমি তখন আলোটা তার ওপরে এনে সামান্য একটু ডান বাঁ করছি, সে হতভম্ব-পেয়েছি কি পায় নি বোঝেনা। সঙ্গে সঙ্গেই আমি আলোর চাকতি সরিয়ে নিচ্ছি অন্য কোথাও।
মাহবুবের গল্প সেইরকম। এই কি উলফ গ্যাং আইজার কথিত নিহিত অর্থ?
নিদপিশাচ আর ম্যাগনাম ওপাসকে আমি তাই বলব -যেখানে অর্থ লুকিয়ে আছে আর কোথাও-এই পাঠ্যাংশে নয়, পূর্বাপর প্রাসঙ্গিকতায় নয়, অন্য কোথাও।
বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে এই সময়ে যে সকল গল্প লেখা হয়ে চলেছে,সে সব নিয়ে শ্রেষ্ঠ গল্পের কালেকশন করলে, ম্যাগনাম ওপাস বিবেচিত হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়েছে। সেহেতু এই গল্পটি নিয়ে আরো কিছু বলা দরকার।
মাহবুব আজাদের সংকলনটির শেষ গল্প ম্যাগনাম ওপাস। প্রথম গল্প -'পুরোনো বাড়ি', যেখানে একজন তাঁর পুরোনো বাসস্থান দেখতে এসেছেন। আর তাঁকে গভীর অভিনিবেশে নজর করে চলেছে সে বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা বালকটি। বস্তুতঃ বালকটির চোখ দিয়েই লেখা হয়ে যায় এই গল্প-" ভীষণ ডাকাত" আগন্তুক বালকের চোখের সামনে রূপান্তরিত হয় এক নিঃস্ব মানুষে যে হু হু করে কাঁদে তাদের রান্নাঘরের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে-স্মৃতিঘাতের শোকে। পরের গল্পটি ব্যঙ্গাত্মক। গল্পের শেষ অংশটি আমার অবোধ্য রয়ে গেছে -হয়তো প্রাচীন ইতিহাস না জানার কারণেই। তার পরের গল্প 'তোমার ঘরে বাস করে কারা" অসম্ভব উপভোগ্য। প্রাণবন্ত লেখা। ক্ষুরধার ব্যঙ্গ নয়। হাস্যরসের আবরণে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ পরচর্চাকে। 'নিদপিশাচ' গল্পটি আপাতসহজ। প্রতিবেশী তরুণীর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ধাক্কা খায় তরুণীর পিতার ব্যক্তিত্বে। বিড়ম্বিত সেই তরুণের অবচেতন এগল্পের উপজীব্য। অলৌকিক মাত্রা যোগ করে গল্পটির পরিবেশন অসামান্য। নিদপিশাচ শেষ করে দ্বিতীয়বার পড়তে হয় পাঠ্যাংশের বাইরে নিহিত অর্থ খুঁজে পাবার বাসনায়। এতটাই টান এ গল্পের। 'বিলুপ্তি' গল্পটি সে তুলনায় সাদামাটা। অনুমেয় সমাপ্তি গল্পটির নির্মিত টেন্‌শনকে ধ্বস্ত করেছে কিছুটা হলেও। তারপর ম্যাগনাম ওপাস। শেষ গল্পের ভাষাটি ঈষৎ আলাদা অন্যান্য গল্পের তুলনায়। অনুবাদের ভাষার মত যেন। অন্য রকম রূপকগুলি । এক তরুণ বৈচিত্র্য খোঁজে। একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পায় সে এক চায়ের দোকানে যেখানে 'প্রতিটি টেবিলে নতুন নতুন মুখ ... চায়ের কাপগুলই শুধু পুরোনো ... পুরোনো তাদের ভেতরে বন্দী চায়ের স্বাদটুকুও, কিন্তু তারা যেন তুচ্ছ, যেন আড়তে গোণার বাইরে পড়ে থাকা ছোটো চালের দানার মতো ... ' সেই চায়ের দোকানে ছেলেটির আলাপ হয় এক লেখকের সঙ্গে যিনি বিগত কয়েক বছর স্বেচ্ছা অজ্ঞাতবাসে। লেখকের সঙ্গিনী রমার সঙ্গেও পরিচয় হয়। জানা যায়-লেখক তাঁর মহত্তম কীর্তিটি লিখে চলেছেন। রচিত হচ্ছে তাঁর ম্যাগনাম ওপাস। লেখক বলেন, প্রত্যেক গল্পকার আসলে একটি, কেবল একটি গল্প লেখার অপেক্ষায় থাকে ... গত পাঁচ বছর ধরে আমি ক্ষ্যাপার মত কেবল ঐ গল্পটার সন্ধানে আছি। লিখছি প্রতিটা দিন। ... যে গল্পটা লেখার জন্য আমি জন্মেছি।' সে গল্পটি পাঠের জন্য আকুল ও ক্রমে লোভী হয় লেখক সঙ্গিনী ও এই তরুণ। লেখককে হাজার প্রলোভন, যতেক প্রতিশ্রুতি। 'বৃদ্ধ হাতির মত মাথা নাড়েন তিনি।না। গল্প তিনি পড়তে দেবেন না। ক্রমে অদ্ভূত এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা। ''রমা একটা রিকশা ঠিক করে দিতে বলে, তাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাই নিজের ঘরে। রমা রাজি হয় না আজ, কিন্তু আমার পা জুড়ে তার কূট আঙুলের দিস্তার পর দিস্তা লেখা, আমি জানি সে ক্লান্ত নয়, ব্যস্ত নয়, অরাজি নয়, অপ্রস্তুত নয়। ... রমাকে মনে হয় আমার লোভের সমান, তার দাঁত -ঠোঁট -জিভকে অগ্রাহ্য করে আমি ডুব দি তার ভেতরে।
অন্ধকারে নিজের ভেতরে নিজেরা ফিরে আসার পর রমা হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করে, তোমার কি মনে হয়? আনিস কি দেবে পড়তে?
আমি শীৎকার করি, বলি, দেবে। আজ হোক, কাল হোক, গল্পটা আমরা পড়তে পাবই। '
এরপরে লেখকের আকস্মিক মৃত্যুতে, তাঁর এযাবৎ গোপন আস্তানার খবর পেয়ে সেখানে হাজির হয় দুজনেই। গল্পের খোঁজে।
'ভেতরে যে দৃশ্য অপেক্ষা করছিল, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
কাগজ।
হাজার হাজার পাতা। সাদা, বাদামী, হলুদ রংএর কাগজ .. ঘরে তীব্র গতিতে ঘুরে চলছে সিলিং ফ্যান, তার হাওয়ায় ছত্রাখান হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে , ঘুরে বেড়াচ্ছে কাগজ। তারা যেন কতগুলি হাজার বছর বয়সী প্রজাপতি। ... কাগজের সমস্তটা জুড়ে লেখা। সে হস্তাক্ষর পড়তে কষ্ট হয় আমার। কাগজটা উল্টে দেখি, লেখা আছে উল্টোপিঠেও।কোনো নম্বর নেই কাগজে, বোঝার উপায় নেই, এই কাগজের আগের পাতাটা কোনটি, কোনটি পরের পাতা।"
গল্পের শেষ লাইনটি দুর্বল লেগেছে। পাঠকের ওপর ভরসা না করে কি নিহিত অর্থ বলে দিলেন মাহবুব?
এতদসঙ্কেÄও , এ গল্পের রহস্য ফুরোয় না- ঈষৎ আড়ষ্ট ভাষা, অদ্ভূত কিছু রূপক, আর তিনজনের এই সম্পর্কটি লেখাটিকে এক অনন্য রহস্যময়তা দিয়েছে। এরকম গল্প আমি বহুকাল পড়ি নি। আলোর চাকতির মাঝে ভ্যাবলা টিকটিকি হওয়ার ভবিতব্য এই গল্পে।কোথা থেকে আসে আলো-কেউ জানে না।
অমিত আহমেদের লেখা একেবারে আলাদা। ব্লার্বে যেমন বলা আছে -'চলতি পথের চিরচেনা মানুষ, ... অথবা পাশের ফ্ল্যাটের নিঃসঙ্গ মানুষটির কথা অমিতের গল্পে উঠে আসে দেওয়াল ভেঙে।' ঠিক তাই । সটান গল্প বলেছেন অমিত। কোনো গল্পে ঈর্ষনীয় ডিটেইল্‌স।
প্রথম গল্পে , দীর্ঘ বাসযাত্রায় সহযাত্রীর মুখে তাঁর প্রেমের কাহিনী শুনছেন তরুণ আধুনিক গল্পকার-কিছুটা তাচ্ছিল্য নিয়েই। গল্প ফুরোয় নি সেই যাত্রাপথে। গল্পের শেষটি জানা যায় যখন সেই আধুনিক গল্পকার সংসারে স্থিতু। সহযাত্রীর নাটকীয় প্রেমকাহিনীর পাশে , শ্রোতাটির মনোভাবের আমূল পরিবর্তন গল্পটিকে অন্য মাত্রা দেয়। পরের গল্প 'প্রত্ন তথ্য' । অতীতে নিজের চরম অন্যায়কে ঘিরে মনের অবচেতনে যে গোপন ভয় জন্ম নিয়েছিল এ গল্পের নায়কের, সেই ভয় এ গল্পে অবয়ব ধারণ করে , নায়কের সামনে আসছে বারেবারে। সমাপ্তি সাদামাটা হলেও গল্প বলার ধরণটিতে পাঠক আকর্ষিত হবেন। পরের গল্প ' পালিশ'এর সমাপ্তিতে বৃদ্ধ চর্মকারের শেষ উক্তিটি গল্পটিকে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রা দিতে পারত- অথচ সে উক্তি বৃদ্ধের মনের যে অবস্থান থেকে বাইরে এলো, সেই অবস্থানকে বিশদ করে এ গল্পের সমাপ্তিকে ঈষৎ ধ্বস্ত করলেন অমিত। 'না বলা কথা'য় একদম প্রথম লাইন থেকেই পাঠককে হাত ধরে গল্পে ঢুকিয়ে নেন লেখক। আগাগোড়া 'মতি'র সঙ্গে তার পাশের চেয়ারেই বসে থাকে পাঠক। কথোপকথনে সঙ্গী হয়। শেষের চমকটি তাই পাঠকের কাছে অপ্রত্যাশিত। অমিত এখানে সার্থক। 'বিবর্তনের শহরে অবিবর্তিত দুজনা' শিরোনামে যেমন কিঞ্চিৎ শব্দবাহুল্য, গল্পটিতেও সেইরকমই ঈষৎ অতিকথন। 'স্বপ্নভঙ্গ' গল্পএর বিষয়বস্তু সাধারণ কিন্তু কথন আন্তরিক। পরের গল্প 'কর্পূরসম ভালোবাসা' শিরোনামটি প্রেডিকটিভ। গল্পের পরিণতির ইঙ্গিত করে গোড়া থেকেই। 'প্রতিসরণ' গল্পটি মজার। প্রবাসী এক ছাত্র আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয়। আত্মহত্যার পদ্ধতির প্রায় নিখুঁত পরিকল্পনা করে সে। তার চিন্তার বিস্তারে পাঠক মজা পায় এবং পরিকল্পনার অসাফল্য কামনা করতে থাকে। সমাপ্তি প্রত্যাশিতই তাই। শেষ লাইন আর সহজ আন্তরিক গল্পকথনটি মনে থেকে যায়। সর্বণাশ গল্পটি ছোটো। বাংলাদেশের রাজনীতির খুঁটিনাটি না জানা থাকায় , গল্পটি আমার অবোধ্য রয়ে গেল।
এ' বইয়ের 'প্রারম্ভিকে' অমিত লিখেছেন, ' ... দেখি, অফিসে ফাইলের জঞ্জাল ফেলে আসা মানুষগুলো ফাঁকা চোখে কোনো রেস্তোরায় বসেন, .. শুকনো রুটির মোড়ক আঁকড়ে পথ চলেন বৃদ্ধা। কিংবা হাত পেতে বসে থাকা ভবঘুরের শরীরে উষ্ণতা খোঁজে হাড় জিরজিরে কুকুর। ..... আমার খুব মন খারাপ হয়। অভিমান হয় এই পৃথিবীর ওপর। ... ঠিক তখন, ঠিক সেই সময়, আমি কংক্রিটের মাঝে পথহারা কোনো রঙীন পাখি দেখি। কিংবা বাতাসে উড়ে আসে কোনো গাছের পাতা। ... বাবার হাত ধরে লাফিয়ে চলে ছোট্টো কোনো ছেলে। ... আমার চারপাশের সব রঙীন হয়ে যায়। আমি খুব যত্নে , খুব আদরে আমার রঙীন পৃথিবীকে দু'হাতে মুড়ে আমার ছোট্টো ঘরে নিয়ে আসি।'
আন্তরিক ভানহীন এই সব উচ্চারণ। অমিতের এই বোধটিই গল্পগুলিতে চারিয়ে গেছে। এই বোধ পাঠকের চেনা। এই বোধের অভিব্যক্তিও পাঠক খুব সহজে বোঝেন। সমাদৃত হয় গল্প।
আনোয়ার সাদাত শিমূলের বইটি নিয়ে ইতিপূর্বে দময়ন্তী আলোচনা করেছেন, সে আলোচনায় আরও গুণীজনকে পেয়েছিলাম। সেই লিঙ্কটা এখানে থাক-
http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?font=unicode&portl
etId=8&porletPage=2&contentType=content&uri=content1248158245426

প্রতিটি গল্প ধরে ধরে বিশদে যাবো না আর। পুনরাবৃত্তি করার অর্থ হয় না কোনো।
ছটি গল্পপাঠে শিমূলের লেখার যে বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে তা অমিত আহমেদের বিপ্রতীপ। বস্তুতঃ বইটি খুলেই সুনীল সাইফুল্লাহর কবিতার উদ্ধৃতি -শিমূলের লেখার সুরটিও বোধ হয় এই তারেই-

'অথচ নির্দিষ্ট কোন দুঃখ নেই
উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি নেই
শুধু মনে পড়ে
চিলেকোঠার একটা পায়রা রোজ দুপুরে
উড়ে এসে বসতো হাতে মাথায়
চুলে গুঁজে দিত ঠোঁট
বুক-পকেটে আমার তার একটি পালক।'

অথচ তারেকের লেখার মত , শিমূল শূন্য থেকে বিষয়ে পৌঁছন না। ঘটনাকেই গল্পে সাজান। সময়কে ধরেন গল্পে।
দময়ন্তীর আলোচনায় মার্কেজের প্রভাবের প্রসঙ্গ এসেছে। যদিও ছটি মাত্র গল্প পড়ে এই নিয়ে মন্তব্য বা আলোচনায় অপারগ আমি, তবু উপন্যাস প্রসঙ্গে মার্কেজ বলেছিলেন, একটি সফল ও ভালো উপন্যাস হবে রূঢ় বাস্তবের কাব্যিক প্রতিফলন- শিমূলের গল্প সাজানো এই কথা মনে পড়ায়।
আর তো বেশি কিছু বলার থাকে না আমার। রশীদ করীম সাহেবের সাক্ষাৎকার থেকে সুতোর লাছি ধার নিয়ে শুরু করেছিলাম-
যে দু চারটি ফোঁড় দিলাম, গিঁট দিলাম না সেলাইয়ের শেষে। আশা রাখি কেউ তুলে নেবেন খোলা সুতোর প্রান্ত। নকশা তুলবেন বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যকর্মে ব্লগের ভূমিকা ( এই চার তরুণ গল্পকার মূলতঃ ব্লগ এবং ওয়েবজিনেই লেখেন)নিয়ে, অথবা প্রবাসী বাঙালীর এই অদ্ভূত আড়ম্বরহীন , ঈষৎ নতমুখী সাহিত্যচর্চার।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস